0
সেই বিশেষ দিনটার কথা সবসময়ই মনের পর্দা জুড়ে জ্বলজ্বল করে- রাত ৯টা, ১১জুন, ২০০৬। ছিলাম জার্মানির অন্যতম বৃহত্তম নগরী কোলোনের (Cologne) প্রায় নব্যনির্মিত স্টেডিয়ামে, গ্যালারী ভর্তি কানায় কানায় আর আমি সেই পয়ত্রিশ হাজার দর্শকের ভিড়ের অংশমাত্র। যে কোন মুহূর্তেই রেফারীর বাঁশির সাথে সাথেই বল গড়াবে মাঠে, তার আগেই চট করে আপনাদের জানিয়ে দিই কি করে পৌঁছালাম সেই মাহেন্দ্রক্ষণে।

২০০২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ সবে শেষ হয়েছে, প্রিয় দল ব্রাজিল শিরোপা জিতল পঞ্চমবারের মত, সেই বছরই উচ্চ শিক্ষার্থে পাড়ি জমালাম ইউরোপে, হাজার হ্রদের দেশ ফিনল্যান্ডে। তখন থেকেই মনের ভিতরে আশা, যেহেতু পরের বিশ্বকাপ চার বছরের বিরতি ভেঙ্গে ইউরোপেই অনুষ্ঠিত হবে, ২০০৬-এ জার্মানিতে, চেষ্টা চরিত করে, সব কিছু উল্টিয়ে দিয়ে হলেও যে করেই হোক খেলা দেখতেই হবে, বিশ্বকাপ ফুটবল বলে কথা!
ইন্টারনেটের মাধ্যমে একের পর এক টিকিটের জন্য দরখাস্ত করা শুরু হল, প্রতিবারই নির্দিষ্ট সময় পর উত্তর আসে টিকেটের আবেদন বিবেচনা করা সম্ভব হচ্ছে না নানা কারণে! মনের কোণে উৎসাহের বান কমে না কিছুতেই, চালিয়ে যেতেই থাকি অহর্নিশি চেষ্টা। উল্লেখ্য, সবসময়ই বিশ্বকাপে স্বাগতিক দেশের দর্শকদের জন্য সিংহভাগ টিকিট বরাদ্দ থাকে, আর জার্মানদের মত ফুটবল পাগল জাতির সবাই-ই যে কোন না কোন খেলার জন্য লম্বা লাইন দিবে এতো জানা কথা!
অবশেষে সুদীর্ঘ আড়াই বছরে অগণিতবার ফিফার ওয়েবপেজে দরখাস্ত পূরণের পর একবার তাদের কাছ থেকে স্বর্গীয় বাণী নিয়ে এক সম্মতিসূচক ইমেইল মিলল। কোলোনে অনুষ্ঠিতব্য একটি মাত্র খেলার টিকিট তারা আমাকে দিতে পারে কিন্তু তাতেও মহা ফ্যাঁকড়া, কোন কোন দেশের খেলা তা জানার কোন আগাম উপায় নেই , কারণ বিশ্বকাপের গ্রুপ ভিত্তিক সময়সূচি তখনও ঠিক হয় নি, অর্থাৎ তা হতে পারে মহা আরাধ্য ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার খেলা, আবার বিশ্বকাপের মানদন্ডে নেহাৎ জলো গ্রীস, জ্যামাইকার খেলা। কিন্তু টিকিট কাটতে হবে তখনই, অনেকটা অন্ধের মত, কার খেলা দেখতে এত হাজার মাইল পাড়ি দিব তা না জেনেই!
কিন্তু এই ইমেইল প্রাপ্তিও মহাদুর্লভ, আমার তিন জার্মান স্কুলবন্ধু সারাক্ষণ শাপশাপান্তই করে গেল কারণ বেচারাদের কপালে শিকে তখনও ছিঁড়ে নি। যা আছে কুল কপালে, নাই মামার চেয়ে কানা মামাই ভাল, ফিফার নিয়ম মোতাবেক ইন্টারনেটে কেটে ফেললাম টিকিট আর প্রতীক্ষায় থাকলাম গ্রুপ নির্বাচনের ড্র-য়ের, মনে বিশাল আশা খুব ভাল কোন দলের মনমাতানো খেলা দেখতে পারব। অবশেষে জানা গেল টিকিট পেয়েছি ইউরোপের ব্রাজিল খ্যাত পর্তুগাল আর আফ্রিকার নতুন শক্তি অ্যাঙ্গোলার খেলার। নেহাৎ মন্দ নয়, পর্তুগালের কাণ্ডারি তখন বিশ্বের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় লুই ফিগো, আছে ভবিষ্যতের বিশ্ব সেরা ক্রিস্টিয়ান রোনাল্ডো, সেনসেশন নুন গোমেজ, ভিত্তর বাইয়া আর কোচের দায়িত্বে আগের বিশ্বকাপ জয়ী বিগ ফিল- লুই ফিলিপ স্কলারি! অন্যদিকে পর্তুগালের সাবেক আফ্রিকান কলোনি অ্যাঙ্গোলা ততদিনে পরিশ্রমী আক্রমণপূর্ণ ফুটবল খেলে আফ্রিকার নতুন পরাশক্তি হিসেবে যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছে, কাজেই আশা করা যায় লড়াই হবে জম্পেশ।
এক খেলার টিকেট পেয়েই প্রস্তুত হয়ে গেল বিশাল পরিকল্পনা। বিমানে নয় গাড়ীতে চেপে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে যাব জার্মানিতে খেলা দেখতে, যাওয়া আসার পথে অন্যান্য দেশ পরিভ্রমণের সাথে সাথে জার্মানির বিশাল ভূখণ্ডের নানা নগরীতে ফুটবলপাগল জনতার সাথে মিশে চলবে আনন্দের অবগাহন। অবশেষে জুনের এক সন্ধ্যেয় ফিনল্যান্ডের উপকূলবর্তী শহর হানকো থেকে সমুদ্রপথে ২৪ ঘণ্টার ফেরী যাত্রা শুরু করে নামলাম জার্মানির রোস্টকে, সঙ্গী সিপু ভাই, অপু, মুরাদ। শুরু হল আমাদের ইউরোপের নয়টি দেশের অজস্র জনপদব্যাপী ৫০০০ কিলোমিটারের যাত্রা।
আবার ফিরে আসি কোলোনের স্টেডিয়ামে, ফিফা এবার টিকিটের কালোবাজারি রোধ করবার জন্য পইপই করে বলে দিয়েছিল পাসপোর্ট সাথে নিয়ে আসার জন্য, সেই সাথে প্রতিটি টিকেটের গায়েই ছিল প্রাপকের নাম মুদ্রণ করা। কিন্তু কোলোন মহানগরী তখন জনসমুদ্রের চলমান তরঙ্গে কম্পমান, স্টেডিয়ামের ভিতরে তো মাত্র পয়ত্রিশ হাজার, বাহিরে অন্তত দশ গুণ বেশী মানুষ! একদল শুকনো মুখে ঘুরাঘুরি করছে স্টেডিয়াম চত্বরে, সাথে বহন করা প্ল্যাকার্ডে লেখা- টিকিট। মানে মানে কোনমতে একটা টিকিট যদি কোনমতে জোগাড় করা যায়। আরেকদলের আবার চাক্ষুষ খেলা দেখার প্রতি কোন আগ্রহ নেয়, তারা আছে দলে-বলে ফাঁকা স্থানে রাখা বড় পর্দায় খেলা দেখার ফিকিরে, না হয় পানশালায় ইয়ারদের ভিড়ে জমজমাট আড্ডায় খেলা দেখতে। চারিদিকে তাকিয়ে মনে হল বিশ্বকাপের সময় সবাই-ই চটজলদি প্রাণের বন্ধু হয়ে যায়, কেউ নাম, কোন দেশ থেকে এসেছি এটুকুও জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজনীয়তা দেখায় না, শুধুমাত্র ফুটবল ভালবাস? ব্যস, এটুকুই যথেষ্ট, চলে এস আমাদের আড্ডায়, জমানো খেলা হবে।
স্টেডিয়ামের মূল ফটকে অন্যদের আপাতত বিদায় বলে পাসপোর্ট আর টিকেট ফিফার কর্মীদের দেখাতেই সহজে কি করে নিজ আসনে যেতে পারব তা বুঝিয়ে দিয়েই ব্যস্ত হয়ে গেল পরেরজনকে নিয়ে।
মাঠের মাঝে এক এলাহি ব্যাপার- দর্শক, সাংবাদিক, নিরাপত্তা রক্ষী গিজগিজ করছে আসমুদ্রহিমাচল কিন্তু এর মধ্যেই বজায় আছে জার্মান জাতির লৌহকঠিন শৃঙ্খলা। খুব সহজেই নিজের আসন খুজে, আয়েশ করে বসে মোবাইলে মেসেজ পাঠানো শুরু করলাম বন্ধুদের বিশ্বের সব প্রান্তে। লিখে পাঠাচ্ছি- অমুক গ্যালারীতে গোলকিপারের পিছনে ডান দিকের সারিতে বসে আছি এক কোণে, পরনে ব্রাজিলের হলুদ জার্সি, গায়ে জড়ানো বাংলার লাল-সবুজ পতাকা, হাতে ফিনল্যান্ডের ক্ষুদে নীল-সাদা পতাকা, টিভির পর্দায় চোখ পড়লেই যেন সবাই বুঝতে পারে সেই-ই আমি ! যদিও সেই সম্ভাবনায় শুরুতেই মনে হল গুড়ে বালি, কারণ মাঠ ভর্তি পর্তুগালের পতাকা, যার রঙ লাল ও সবুজ, সেই ভিড়ে কি বাংলার পতাকা আলাদা ভাবে খুজে নেবে টিভি ক্যামেরা, দেখা যাক। তার উপর এমনিতেই সাথে নেই কোন বৈচিত্রময় প্ল্যাকার্ড, মুখে নেই রঙ ঝলমলে আঁকিবুঁকি।
খেলা শুরু হতে যাচ্ছে, রেফারীর বাঁশি বাজল বলে, এই সময় গোটা গ্যালারী জুড়ে হাজার হাজার ক্যামেরার ফ্লাশের ঝিলিক, যেন মাঠের প্রতি ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে প্রকাণ্ড রূপোলী জোনাকির ঝাক। আহা, এমন মুহূর্ত কেবলমাত্র দেখে এসেছি টিভির পর্দায়, কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে সবকিছুই। ফ্লাড লাইটের আলোর বন্যায় ভেসে গেছে বিশ্ব চরাচর, হাজারও ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দ, রক্তে উম্মাদনা জাগানো দর্শকের উল্লাস ধ্বনি, বিদ্যুৎগতিতে চলছে আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ। কেমন করে কলম দিয়ে প্রকাশ করি সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অনুভূতি! বিশ্বকাপ ফুটবল বলে কথা, গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ!
বিরতিসহ দুই ঘণ্টা কেটে গেলে চোখের পলকে। এক নিমিষে চলে গেল জীবনের অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা, চোখ মেলে দেখলাম কোচের জায়গায় দাড়িয়ে স্কলারির খবরদারি, রোনাল্ডোর ব্যর্থ গোলপ্রচেষ্টা, লুই ফিগোর নিখুঁত ডিফেন্স চেরা পাস। খেলার ফলাফল- তুখোড় ফুটবল নৈপুণ্য দেখিয়েও অ্যাঙ্গোলার এক গোলে হার, খেলার চার মিনিটের মাথায় পর্তুগালের পলেতা করেন খেলার একমাত্র গোলটি।
বারকয়েকই মনে হল জেগে থেকে স্বপ্ন দেখছি না তো? কেমন যেন দেহ-মন অবশ করা ঘোর লাগা অপার্থিব অতি ভাললাগার অপার অনুভূতি। সেই সুখক্ষণ নিয়েই জনতার সারিতে মিশে গেলাম খেলা শেষে।
চুপিচুপি জানিয়ে রাখি, এরপরেও বিশ্বকাপ ফুটবলের মঞ্চে উপস্থিত থেকে খেলার দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। ২০১০ সালের দক্ষিণ আফ্রিকায় মিলে ছিল অনেকগুলো টিকিট, ব্রাজিলের সবগুলো খেলার তো বটেই, সেই সাথে আর্জেন্টিনার খেলারও! মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখেছি উত্তর কোরিয়ার সাথে মাইকনের জাদুকরী গোল, লিওনেল মেসির পায়ের কারুকার্য, দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে হিগুয়েনের হ্যাট্রিক,ফুটবল ঈশ্বর দিয়েগো ম্যারাডোনাকে, দিদিয়ের দ্রগবার বল নিয়ে দুর্দান্ত টান, কাকার লাল কার্ড দর্শন, স্নাইডার, রবিনহো, ফ্যাবিয়ানো, রোবেন, ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোর গোল।বিশেষ করে ম্যারাডোনা এবং বাংলার পতাকা একই ফ্রেমে বন্দী করতে পেরে দারুণ লেগেছিল
DSC02949
কিন্তু সেই গল্প অন্য কোনদিন, অন্য কোনখানে।
IMG_3479
IMG_5019
IMG_3538
IMG_3461
DSC03224
DSC03186
IMG_5009
DSC03456
DSC03493
IMG_3831
IMG_3806
IMG_3795
DSC03968
DSC03002
DSC02994
DSC02986
DSC02947
DSC02962
DSC03004
DSC03202

YOUR NAMEAbout Me
আসসালামু আলাইকুম। নবীন বাংলা ব্লগ সাইটে ভিজিট করার জন্য আপনাকে স্বাগতম। আসলে এই ব্লগ সাইটটি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। এবং আমি এই সাইটের এডমিন, মূলত ব্লগিং প্রাকটিস এবং মুক্ত জ্ঞাণ চর্চার জন্যই এই সাইটটি ওপেন করেছি। আমার সাইটের পোস্টগুলো অন্যান্য সুনাম খ্যাত ব্লগ সাইটে সমূহে পাবলিশ করে থাকি তথারুপ টেকটিউন্স, টিউনারপেইজ। ইনশাআল্লাহ যতদিন বেঁচে থাকব নবীন বাংলা ব্লগে লেখালেখি করার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। এখানে অন্যান্য লেখকদের বাছাই করা পোস্টগুলো পাবলিশ করা হয়। এবং ইচ্ছা করলে আপনিও এই ব্লগের অতিথি লেখক হিসাবে শুরু করতে পারেন।পরিশেষে আমার সাইট কিংবা প্রকাশিত লেখা সম্পর্কে কোন আপনাদের অভিযোগ, মতামত, পরামর্শ থাকলে তা সাদরে গ্রহন করা হবে। আবারো ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা সবাইকে!!
Follow : | | Facebook | Twitter

Post a Comment

 
Top