0
(মূল লেখক: তারেক-অনু, সচালায়তন ব্লগ)




সৌম্য দর্শন একজন আলিঙ্গনের জন্য দুই হাত বাড়িয়ে দাড়িয়ে আছেন পাহাড় চূড়োয়, ঠোটের কোণে স্মিত হাসি, মুখে অভয় প্রদানের চিহ্ন, চোখের দৃষ্টি কোথায় যেয়ে ঠেকেছে তা বলার উপায় নেই, কখনো মনে হয় সামনের অতলান্তিক মহাসাগরের নীলে কখনো মনে হয় অন্তহীন মহাকাশের দূরের কোন রূপোলী নক্ষত্রে। মানুষটি একা, দাঁড়াবার ভঙ্গিতে বন্ধুত্বের আহবানের সাথে সাথে খানিকটে একাকীত্বও মিশে আছে। কিন্তু সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপই নেই তার, দিন নেই, রাত নেই বছরের পর বছর রোদ-ঝড়-বৃষ্টি মাথায় দাড়িয়ে আছেন তিনি ব্রাজিলের সমুদ্র তীরবর্তী এক বিশাল মহানগরীর কোটি মানুষের আশা ভরসার প্রতীক হয়ে। মহানগরীর নাম রিও দ্য জেনিরো।
ব্যস, বুঝে ফেলেছেন নিশ্চয়ই রিওর সেই বিখ্যাত যীশু মূর্তি নিয়ে কথা হচ্ছে ! আর সারা বিশ্বে স্ট্যাচু অব লিবার্টি বাদে আর কোন বিশালাকার মূর্তিই বা এত বিখ্যাত ! তার উপর আবার সম্প্রতি এটি বিশ্বের নতুন সপ্তাশ্চর্যে স্থান করে নিয়েছে বেশ ঢাক ঢোল পিটিয়েই। ধর্মপ্রচারকদের নিয়ে বালখিল্যতাজনক উৎসাহ নেই আমার কিন্তু এই সম্পর্কিত স্থাপত্য দেখার ইচ্ছে আছে ষোল আনা, বিশেষ করে প্রাচীন ইতিহাসময় হলে তো কথাই নেই, যদিও এই যীশুমূর্তি এমন প্রাচীন কিছু না। চলুন ঘুরে আসি, এই বিশ্বের বিস্ময়ের পাদদেশ থেকে।
প্রবল ঝড়ের কারণে বিমানযাত্রার দেরী হওয়ায় রিওতে প্রবেশ ঘটেছিল বেশ আঁধার রাতে, তখনই অনেক অনেক দূর থেকে চলন্ত অবস্থাতেই চোখে পড়েছিল এই বিস্ময়ের দিকে, গাঢ় আঁধারের মাঝে শূন্যে দাড়িয়ে আছে ধবধবে সাদা যীশু, বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে। আসলে বিশেষ ভাবে আলো ফেলা হয় মূর্তিটিতে যাতে আঁধারে একেবারে ফ্লোরেসেন্ট লাইটের মত ঝকঝক করে, আর দেখা যায় সবখান থেকেই।
আর দিনের আলোতেও রক্ষে নেই, রিওর যেখানেই যান না যেন, কোপাকাবানার সৈকতে, লাপার নাচের আসরে অথবা উপত্যকার ফাঁকে গজিয়ে ওঠা ফ্যাভেলায়, যীশুর পাথুরে নীরব দৃষ্টি তাড়া করবেই আপনাকে। পরিত্রাণ নেই সেখানে না যাওয়া পর্যন্ত।
431144_10151407250065497_608590496_23577305_274643310_n
অবশ্য যাবার ব্যবস্থা দুটি, এক সড়ক পথে, দুই উড়ে! সবসময়ের জন্য প্রস্তত আছে হেলিকপ্টার, আবহাওয়া ভাল থাকলেই যীশুর একেবারের নাকের ডগা থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে আপনাকে বিন্দুমাত্র ঘাম না ঝরিয়েই, সেইসাথে মুফতে পারেন বিশ্বের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন নগরীগুলোর একটির অপূর্ব আদিকচক্রবাল প্যানোরোমা, তবে মানিব্যাগ থেকে কয়েকশ ডলার ঝরে যাবে সেই কয়েক মিনিটেই। কাজে কাজেই সড়কে ফিরে আসি!
404520_10151207397205497_608590496_22919380_1352176917_n
সেই সাথে খেয়াল রাখতে হবে আবহাওয়ার কথা, দেখা গেল নিচে ঝকঝকে রোদে, কিন্তু ঐ প্যাঁচানো পাহাড়ের মাথায় উঠতে উঠতে যে মেঘের ভেলা এসে যীশুসহ সারা শহরকে হতভম্ব আপনার সামনে ডেভিড কপারফিল্ডের মত উধাও করে দেবে না তার কোন নিশ্চয়তা নেই। তাই, আবহাওয়ার পূর্বাভাস মন দিয়ে শুনে, সারা দিন মেঘমুক্ত আকাশ আর শুকনো বালির সৈকতের ( কর্দমাক্ত আকাশ আর মেঘাচ্ছন্ন মাঠ না আবার! ) প্রতিশ্রুতি পেলেই না যাওয়ার কথা উঠে!
এমন এক রোদেলা চনমনে আলো ভরা দিনেই আপাত আস্তানা লেবননের লেমন স্পিরিট হোস্টেল থেকে স্থানীয় ( লোকাল) বাসে চেপে করকোভাডো পাহাড়ে যাবার ট্রেন ষ্টেশনে পৌঁছালাম আমরা তিন মূর্তি, (করকোভাডো পাহাড়ের মাথাতেই যীশুমূর্তি অবস্থিত) , কিন্তু বিধি বাম! পর্যটকদের দল বিশাল লাইন দিয়ে দাড়িয়ে আছে, পরের ট্রেনের টিকেট পেতে হলে অন্তত ঘণ্টা তিনেক অপেক্ষা করতেই হবে! এই হল বেশী বিখ্যাত কিছু দেখতে যাবার সমস্যা- সবাই হাভাতের মত ছুটে যায় এই জিনিসগুলো দেখে সেগুলোর সাথে ছবি তুলতে, কাজেই অনেক বেশী বুদ্ধিমান ভ্রমণপিপাসু এমন মার্কামারা গন্তব্য এড়িয়েও চলেন সময় এবং অর্থ দুই-ই বাঁচানোর জন্য।
এই সময় যীশুর বার্তাবাহক হয়ে স্বর্গ না হলেও পাশের রাস্তা থেকে আবির্ভূত হলে সিনর আলভ্যারেজ লুইজ কস্টা ! পেশায় ট্যাক্সি চালক তিনি, একটি বিশেষ কোম্পানির পোশাক পড়ে আছেন, যারা দর্শনার্থীদের নিয়ে পাহাড়ের চুড়োয় নিয়ে যায় আবার ফেরৎ নিয়ে আসে, যীশুর কাছে কয়েক ঘণ্টা থাকার মাঝে বোনাস হিসেবে মিলবে পথের মাঝেখানে একাধিক জায়গার থামার সুযোগ, যেখানে ছবির মত সাজানা শহরটির ছবিতোলার অদ্বিতীয় সুযোগ তো মিলবেই আর আছে Tijuca বনের নিসর্গ উপভোগের সুযোগ!
430008_10151323042470497_608590496_23257220_975442424_n
এখন বলেন, রিও মহানগরীতে বন আসল কোথা থেকে? আসলে Tijuca বন সারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় শহরঘেঁষা বন যাকে ইংরেজিতে বলে Urban Forest, আর সেই করকোভাডো পাহাড় কিন্তু এই বনের মাঝেই অবস্থিত!
538673_10151479216780497_608590496_23867009_1700665929_n
তাই ট্রেন ধরার ঝামেলার বদলে সিনর কস্টার জানে সওয়ার হলে রথ দেখার সাথে সাথে কলা তো বেচা হবেই ফাঁকতালে রথে চড়ার আনন্দও উপভোগ করা যেতে পারে একাদশীর কৃষ্ণের মত ! তার ট্যাক্সির ভাড়াও যথেষ্ট ন্যায্য, আর কি চড়ে বসলাম হলদে- কালো ট্যাক্সিতে, প্যাঁচানো রাস্তা দিয়ে ঘুরে ঘুরে উঠতে থাকলাম পাহাড় শীর্ষে।
মাঝে দুইবার যাত্রা বিরতি নেওয়া হল, একবার বিশেষ এক জায়গায় থেকে রিওর রূপ উপভোগের জন্য, এক পাশে দেখা গেল বিশ্বের বৃহত্তম স্টেডিয়াম মারকানা, যেখানে একসময়ে ২ লক্ষ দর্শক একসাথে ফুটবল উপভোগ করতে পারত! এখন সেই ধারণক্ষমতা কিছুটা কমিয়ে আনা হয়েছে।
409464_10151206053125497_608590496_22914716_637730951_n
তখনও যীশু বেশ দূরে, কিন্তু তার আসে পাশে হেলিকপ্টারের দলের আনাগোনা বোঝা যাচ্ছে বেশ, সেই সাথে রসিক মেঘের দলের অবস্থানের কারণে মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে শূন্যে ভেসে আছে কোন অলৌকিক জাদুকর!
403070_10151190666460497_608590496_22861831_532914680_n
যদিও সাথের পাড় নাস্তিক ইয়াইয়াস সেরণা মুচকি হাসি দিয়ে বলল- যীশু বাবা মনে হচ্ছে ব্যাঞ্জি জাম্পিং দেবার জন্য দাঁড়িয়েছে!
আরেকবার দাঁড়ানো হল রাস্তার পাশেই এক ঝাঁকড়া গাছের ডালে দুটো ছোট্ট বাঁদর দেখায়, একেবারে ক্ষুদে প্রজাতির, কয়েক ইঞ্চি মাত্র লম্বা, ঝুলে থাকা লেজটা দেহের সমানই বলা চলে! কিন্তু বেশী মাত্রায় লাজুক আর ক্ষিপ্রতার দিক থেকে স্পাইডারম্যানের পরদাদাকে হার মানানো জীবদুটো জাদুবলে উধাও হয়ে গেল ঘন সবুজ বনে!
এর পরে থামা হল একেবারে পাহাড়ের মাঝামাঝি এক বিশেষ বাসস্টপে, যেখান থেকে এক মাত্র অনুমতিপ্রাপ্ত মাইক্রোবাস উপরে যেতে পারে, তাতেই মুরগীর খাঁচার মত চাপাচাপি করে কয়েক মিনিটের যন্ত্রণা সয়ে আমরা পৌঁছালাম যীশুর পাদদেশে।
425839_10151303050060497_608590496_23207257_955135582_n
বেশ ছড়ানো জায়গা, সেখানে কিছু রেস্তোরাঁ আর রকমারি দোকানের অবস্থান, এবং সেখানে মূল দ্রব্য অবশ্যই নানা পদার্থের, নানাকৃতির যীশুর ক্ষুদে মডেল।
427534_10151323044905497_608590496_23257241_1813310222_n
আর সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে ১৩০ ফুট লম্বা এবং ৯৮ ফুট চওড়া( মানে ছড়ানো হাতের মাপ অনুযায়ী) মূর্তিটার পিছন দিক, মনে হল তার মাথায় কি যেন কাটার মত বসানো আছে ? কাঁটার মুকুট নাকি!
401220_10151210250155497_608590496_22928101_1194510273_n
সাথের দূরবীন দিয়ে ফোকাস করতে দেখি মুকুট নয় কিন্তু বেশ কয়েকটা অ্যান্টেনা জাতীয় ধাতব শলাকা, নিশ্চয়ই কোন ব্যবহারিক কাজের জন্য। তার পাশের সিঁড়ি বেয়ে বেশ কিছু ধাপ অতিক্রম করে অবশেষে পৌঁছানো গেল বিশ্বের বিস্ময়ের নিচে, চোখ তুলে তাকালাম পাথুরে মুখের দিকে, সেখানে তখনো হেলিকপ্টারের ভিড়, আর চারপাশে গিজগিজ করছে মাছের বাজারের চেয়েও ভয়াবহ জনতার দঙ্গল, মোটামুটি সবাইই ব্যস্ত যীশুর মূর্তির সামনে তারই দুহাত ছড়ানো ভঙ্গিমায় দাড়িয়ে একটা মুহূর্ত ক্যামেরায় বন্দী করা।
IMG_8340
IMG_8337
IMG_8388
ব্যক্তিগত অভিমত ব্যক্ত করার অভয় দিলে বলতে পারি, আমার প্রথমেই মনে হল এটি এত জনপ্রিয় কেন! সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২,৩০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ৬৩৫ টন ওজনের মূর্তিটির চেয়ে আরও বড় যীশুমূর্তি বিশ্বে আছে চার খানা, তাদের কোনটাইতো এত জনপ্রিয় নয়! কিন্তু ১৯২২ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হবার পর ১৯৩১ সালে যীশু দুহাত মেলে দাঁড়াবার পর থেকেই এই বিশেষ স্থানটির জনপ্রিয়তা ব্যপক- এটি কি এর সামনের-পিছনের অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্যের জন্য? নাকি বারংবার অসংখ্য চলচ্চিত্র- কার্টুন- পত্রিকায় এর ছবি আসার জন্য!

বিশালাকার মূর্তিটি নিরেট, কেবল নিচ থেকে দেখা যায় কাছে গেলে, ভিতরে যাবার কোন উপায় নেই। সেখানে মিনিট পনের থাকতেই বেড়া ভাঙ্গা ভেড়ার পালের মত শুভ্র মেঘের দল ছুটে এল নানা উপত্যকার ফাঁক দিয়ে নিজেদের রাজত্ব বিস্তার করতে করতে।
395791_10151272651970497_608590496_23125268_1482819882_n
খানিক পরেই যীশুকে মন হল রহস্যময় কোন আগন্তক, যার মুখমণ্ডল ঘিরে আছে পাতলা মেঘের পর্দা।
404444_10151341348250497_608590496_23320668_1212650116_n
সেই সাথে চোখ পড়ল তার বিশাল হাতের পাঁচ আঙ্গুলের দিকে, নিখুঁত কাজ বটে কিন্তু কেমন যেন প্রাণহীন, ভাস্কর্যকলার সৌষ্ঠব, মাধুর্য অনুপস্থিত সেখানে। ভাবছি, যীশু আমার মনের কথা টের পেলে ঐ হাতের একটা থাবড়া দিলেই আমার ২৮ দাঁতের হাসি তো বটেই চরম উদাসের ছবির দুই ওরাং ওটাং শিশু পর্যন্ত ফোকলা মুখো হয়ে যাবে।
421226_10151407250310497_608590496_23577308_1478895215_n
421622_10151407250160497_608590496_23577307_2037634417_n
সেই সাথে বলতেই হবে খৃস্টান ধর্মকে নিজেদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে যে কদর্য ইতিহাস রচনা করেছিল উপনিবেশিক প্রভুরা তার গণ্ডী থেকে এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি ল্যাতিন আমেরিকা। যত্রতত্র গির্জা স্থাপন করে, যীশুর মূর্তি গড়ে, ক্রুশের ভয় দেখিয়ে তারা দখল করে নিয়েছিল দুইটি মহাদেশ। যীশু নামের কেউ যদি বলেও থাকে ২০০০ বছর আগে, কেউ তোমার একগালে চড় মারলে অপর গালটিও এগিয়ে দিও, সেই শান্তির বাণী ভুলে সন্ত্রাসময় কলঙ্কই রচনা করে গেছে ইউরোপিয়ানরা। এখনো করে যাচ্ছে তাদের বংশধরেরা, যে দেশে মানুষ না খেয়ে থাকে আকছার, সেখানে গড়া হয় এমন হাজার গির্জা আর বিশালাকার ক্রুশ। যার উপরে ক্ষুদ্ধ হয়ে এই ব্রাজিলেরই বিখ্যাত রেভারেন্ড হেলডের কামারা বলেছিলেন “When I give food to the poor, they call me a saint. When I ask why they are poor, they call me a communist.”
তাই আমরা এসেছি কোন পুণ্য অর্জনের মিথ্যে আশায় নয় কেবলমাত্র বিখ্যাত একটি স্থাপত্যকে কাছে থেকে দেখার জন্য। সেখানেও ঝিরঝিরে বৃষ্টি আর মেঘের দল বিশ্বাসঘাতকতা করাই সেই অবস্থানটুকুও সংক্ষিপ্ত করে কিছু মুহূর্ত ফ্রেমবন্দী করে আবার নিচের পানে-
395896_10151199757215497_608590496_22887910_1842121518_n

YOUR NAMEAbout Me
আসসালামু আলাইকুম। নবীন বাংলা ব্লগ সাইটে ভিজিট করার জন্য আপনাকে স্বাগতম। আসলে এই ব্লগ সাইটটি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। এবং আমি এই সাইটের এডমিন, মূলত ব্লগিং প্রাকটিস এবং মুক্ত জ্ঞাণ চর্চার জন্যই এই সাইটটি ওপেন করেছি। আমার সাইটের পোস্টগুলো অন্যান্য সুনাম খ্যাত ব্লগ সাইটে সমূহে পাবলিশ করে থাকি তথারুপ টেকটিউন্স, টিউনারপেইজ। ইনশাআল্লাহ যতদিন বেঁচে থাকব নবীন বাংলা ব্লগে লেখালেখি করার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। এখানে অন্যান্য লেখকদের বাছাই করা পোস্টগুলো পাবলিশ করা হয়। এবং ইচ্ছা করলে আপনিও এই ব্লগের অতিথি লেখক হিসাবে শুরু করতে পারেন।পরিশেষে আমার সাইট কিংবা প্রকাশিত লেখা সম্পর্কে কোন আপনাদের অভিযোগ, মতামত, পরামর্শ থাকলে তা সাদরে গ্রহন করা হবে। আবারো ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা সবাইকে!!
Follow : | | Facebook | Twitter

Post a Comment

 
Top