ওয়াসা বিশুদ্ধ পানির নাম করে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকাতে আজকাল যে খয়েরী বর্ণের তরল সরবরাহ করছে, তার সাথে নিউমার্কেটের সামনে বিক্রী হওয়া সাগুর সরবতের চেহারাগত কোনও পার্থক্য বের করা মুশকিল! পানি ছাড়াও এতে অন্যান্য উপকরণ এতো বেশী যে আর দশটা পণ্যের মতোন এটারও গায়ে লেবেল এঁটে Main Ingredients জাতীয় কিছু তথ্য সংযোজন করা জরুরী হয়ে পরেছে। তাহলে লিস্টি দেখে চট করে জেনে নেওয়া যাবে পানিতে ক্লোরিন ছাড়াও উদ্ভিজ্জ ময়লা, প্রাণিজ্জ ময়লা, কারখানার ময়লা, অন্যান্য ময়লা ইত্যাদি কতোটুকু করে মিশ্রিত আছে। সেদিন টিভিতে পানি-সঙ্কটাপন্ন মিরপুর এলাকায় জনৈক ভুক্তোভোগীর সাক্ষাৎকার দেখানো হলো। কয়েক সেকেন্ডের ক্লিপ। রিপোর্টার
সাহেব মহিলার সামনে মাইক্রোফোন বাড়িয়ে ধরতেই মহিলা জলসঙ্কটের বয়ান দিতে শুরু করলেন। মন্ত্রী আমলাদের জীবনে মিডিয়া ডেইলি সোপ নাটকের মতোন বিরক্তিকর বিষয় হলেও এই সব আটপ্রৌঢ়ে মানুষ চট করে মিডিয়া হজম করতে পারে না। একদিকে জলসঙ্কটে দূর্বিষহ জীবনযাপনের যন্ত্রণা, আরেকদিকে টিভিতে নিজেকে দেখানোর অপরিশোধিত আনন্দ! দুইয়ের মধ্যে শেষমেষ সেলিব্রিটি হবার আনন্দই জয়যুক্ত হলো – গত কয়েকদিন ধরে গোসল বন্ধ, খাওয়ার পানিতে ভাসমান আবর্জনা, সাথে উৎকট গন্ধ! ভয়াবহ এই সমস্যা গুলোর কথা মহিলা বর্ণনা করলেন হাসি হাসি আনন্দিত মুখে! দেখে যে কেউ মনে করবে, পানি-সমস্যার বিষয়টা পুরোটাই গুজব, এদের কল দিয়ে নিয়মিত জমজম কূপের মতোন বিশুদ্ধ পানি বের হয়!
‘যন্ত্রণা’ আর ‘আনন্দ’র টানাটানির মধ্যে ‘আনন্দ’র এভাবে উৎড়ে যাওয়াটা নতুন কিছু না। টানাটানিটা যখন আনন্দর সাথে ভয়ের, তখনও জয়ের পাল্লাটা ভারী থাকে ঐ আনন্দের দিকেই! ফ্যান্টাসী কিংডোমে গিয়ে আমি নিজে এই ঘটনার সাক্ষী হয়েছি! তবে এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম শুধু আমি। সাহসের অভাবে ছোটবেলা থেকেই শিশুপার্ক জাতীয় জায়গাতে গিয়ে আমি ট্রেন বা নাগরদোলা ছাড়া অন্য কিছুতেই উঠতে চাইতাম না। চিড়িয়াখানায় গিয়ে জীবিত প্রাণীর কাঁধে ওঠার সাহস হতো না বলে শিশুপার্কের নির্জীব হাতি-ঘোড়ার ওপর চড়ে স্বাধ মেটাতাম। বড়বেলায় এসে অবশ্য বন্দুবান্ধবদের ওসওসায় পরে এমন কিছু রাইডে চড়তে বাধ্য হয়েছি যেগুলোতে ওঠার জন্য আমি মানসিক বা শারিরীক, কোনওভাবেই ফিট নই।
অনেকদিন পর্যন্ত দেশে শিশুপার্ক বা ওয়ান্ডারল্যান্ড-ই ছিলো এইসব শারীরিক বিনোদনের প্রাণকেন্দ্র। ফ্যান্টাসী কিংডোমের আবির্ভাব এসবকিছুকে একেবারে প্রস্তরযুগে পাঠিয়ে দিলো। ঐখানে যেসকল রাইডের সমাগম ঘটলো সেগুলো দেশের বিনোদন জগতে একেবারেই নুতন। কিন্তু সেগুলাও হজম করতে বাঙালীর বেশিদিন সময় লাগলো না। আজকাল দেখি, আসামীরা রিমান্ডে গিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে রাখে, সহজে খুলতে চায় না। আমার মনে হয়, ঐসব রাইডে নিয়মিত চড়ার ফলেই লোকজনের যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতা দিন দিন বেড়ে গিয়ে এই বিপত্তির সৃষ্টি হয়েছে!
আমার ছোট শ্যালিকা অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি পাওয়ার পরে উপহার হিসেবে তাকে ফ্যান্টাসী কিংডোমে নিয়ে যাবার আইডিয়া দিলো আমার হবু স্ত্রী। এতে করে শ্যালিকা মহলে আমার ইজ্জত বাড়বে এবং বহুত ফায়দা হবে। এই লোভে পা দিয়ে আমি আমার গোটা চারেক শ্যালিকা সমভিব্যাহারে ফ্যান্টাসী কিংডোমে গমন করলাম। এর আগে কখনও না গেলেও এর সু- এবং কুক্ষ্যাতি দুইই আমার কানে এসেছিলো। তবে কোনও রাইড সম্পর্কেই পূর্ণাঙ্গ নসিহত কারো কাছে পাইনাই। ফলে নিজেকে পুরোপুরি খোদার হাতে সমর্পন করে ঢুকলাম সেই কিংডোমে।
ঢোকার খানিক পরে বাম্পিং কার, দোলনা এসব পার করে আমরা আনন্দদিত চিত্তে এসে পৌছালাম রোলার কোস্টারের সামনে। বনভোজন করতে গিয়ে শালবনের মধ্যে চিতাবাঘ দেখলে যেমন ভড়কে যাওয়াই নিয়ম, আনন্দ করতে এসে এই জিনিস দেখেও আমি নিয়মমাফিক ভড়কে গেলাম! কারণ একটু আগেই মরনপণ চিৎকার করতে থাকা একদল নারী-পুরুষ নিয়ে মাথার ওপর দিয়ে ঐ জিনিসটাকে উড়ে যেতে দেখেছি। তখন ‘ঐপথ মাড়াবো না’ বলে ঠিক করে রাখলেও ভাগ্যের ফেরে একসময় ঐটার সামনেই এসে হাজির হলাম! সবাই মিলে অনেক জোড়াজুড়ি এবং মূলতঃ পৌরুষে আঘাত করায় একরকম বাধ্য হলাম উঠতে। এখানে আসার আগে শুনেছিলাম কে বা কারা যেন কোনও এক রাইডে উঠে কীটনাশক ছিটানোর ভঙ্গীতে চারিদিকে বমি ছিটিয়েছে – খানিক পরে যখন আকাশ আর পাতালের মাঝখানে দুলতে লাগলাম তখন মনে হলো, ‘এইটা সেই রাইড না হয়েই যায় না’। মোকসেদুল মো’মেনিন-এ কঠিন দিল নরম করার একটা দোয়া ছিলো, দেরী না করে আমি রোলার কোস্টারের চালকের উদ্দেশ্যে সেই দোয়া পরে গায়েবানা ফুঁ দেওয়া শুরু করলাম। এতে কাজ না হওয়ায় কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ রেখে ভয় কমাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু চোখের খোলা বা বন্ধ থাকার সাথে হৃৎপিন্ডের কোনও সম্পর্ক নাই; সুতরাং হৃদযন্ত্রের মাধ্যমে ভয়ের উদ্রেক হওয়া অব্যহত থাকলো।
মনে হলো, বাংলাদেশে বিদ্যুত জিনিসটা আরোও দুষ্প্রাপ্য হওয়া উচিৎ, তাইলে অন্ততঃ এইসব বিদ্যুতচালিত রাইডের মেয়াদ খানিকটা করে কমবে বলে আশা করা যায়। যাইহোক, কেমনে যেনো এক সময় রোলার কোস্টারের ‘জার্নি টু ইটার্নিটি’ শেষ হলো, কোনওরকমের হার্ট এ্যাটাক ছাড়াই অক্ষতভাবে নীচে নেমে আসায় নফল নামাজের নিয়ত করছিলাম মনে মনে। হঠাৎ কে যেন চিৎকার দিয়ে উঠলো “ম্যাজিক কার্পেট! ম্যাজিক কার্পেট!” জিনিসটার নাম শুনেছি। দিব্যচোখে দেখার পর মনে হলো, ‘ও এইটাই ম্যাজিক কার্পেট?’ জিনিসটা দিয়ে কি হয় সেটা তখনও বুঝিনাই। নামকরণ শুনে ধারণা করেছিলাম যে, হয়তো ফ্লাইং সিমুলেশন (উড্ডয়ন অভিজ্ঞতা) টাইপের কিছু হতে পারে। বলতে দ্বীধা নেই, জিনিসটার প্রতি একরকমের আগ্রহও বোধ হচ্ছিল। সবাই এগিয়ে গেলাম। কাছে গিয়ে দেখি ৮ বছরের কম শিশুদের ওঠা নিষেধ করা আছে। এটা দেখে একটু দমে গেলাম – আট বছর পর্যন্ত কি কি জিনিসে সবচেয়ে বেশী ভয় পেতাম, মনে করতে চেষ্টা করলাম। ভূত আর ছেলেধরা ছাড়া আর কিছুই মাথায় আসলো না। বেশী চিন্তাভাবনার সুযোগ নেই, পেছন থেকে সবাই ঠেলছে। সুতরাং ওঠা হলো ম্যাজিক কার্পেটে।
‘কার্পেট’ নাম দেওয়া হয়েছে যে জিনিসটার সেটা মূলতঃ একটা কাঠের বেন্চ। আশেপাশে কোথাও কার্পেটের চিন্হ পর্যন্ত নাই। কথায় কাজে এইরকম অমিল দেখে শুরুতেই খানিকটা ঘাবড়ে গেলাম। কিন্তু যাইহোক, এই পর্যায়ে এসেও আমি ঠাহর করতে পারছিলাম না কি ঘটতে যাচ্ছে। তবে যখন কার্পেট নাম্নী সেই বেন্চটা আমাদের সবাইকে নিয়ে উর্দ্ধমুখে ধাবমান হলো তখন হঠাৎ করে মনে হলো আত্মীয়-স্বজনদের সাথে ঈদের ছুটিতে চাঁদে যাচ্ছি। এতো দ্রুত এতো উপরে এর আগে উঠিনাই! কে জানি পাশ থেকে বলে উঠলো ‘এইবার কিন্তু নামবে, সাবধান’! বিনোদন করতে এসে এইরকম সাবধান বাণী শুনতে হলে ভয় তো লাগবেই। আমি দুই হাতে সামনের রডটা এমনভাবে আঁকড়ে ধরলাম যে হাত আর রডের মধ্যে কোন পার্থক্যই রইলো না। দুইটাই জবরজং শক্ত! যাহোক, আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতেই বেন্চ নিম্নগামী হলো। অনেকটাই অভিকর্ষজ ত্বরণে মুক্ত-পতন। মরতে মরতে বেঁচে যাবার একটা অনুভুতি টের পেলাম। হাশরের ময়দানে নাকি বারবার মৃত্যুর স্বাদ দেওয়া হবে। মরা মানুষকে জিন্দা করে আবার মেরে ফেলা হবে। ঘটনা সত্যি হলে তখন যন্ত্রণা কিঞ্চিত কম হবে বলেই আশা রাখি! কারণ, আমি যে জিনিসকে ফ্লাইট সিমুলেশন ভেবে ভুল করেছিলাম, ওঠার পরে বুঝলাম সেটা আসলে রোজ কেয়ামতের সিমুলেশন! আগেপিছে সবাই আর্তচিৎকার করছে, যেমনটা হাশরের দিন করার কথা! যন্ত্রটা একদম উপরে ওঠার পরে খানিক ক্ষনের জন্য দাঁড়ায়। ঐ সময়টার মধ্যে কেবল ‘কুলহুয়াল্লাহ’ সূরাটা পড়া সম্ভব, আমি সেটাই করছিলাম। পাশে থেকে আমার ছোট শ্যালিকা ভয়ার্ত গলায় বললো, ভাইয়া কখন থামবে? প্রশ্ন কমন পড়লেও উত্তর দিতে পারলাম না! হাশরের দিনে নাকি পিতা সন্তানকে চিনবে না, আমি অবশ্য তখনও আমার শ্যালিকাকে চিনতে পারছিলাম; বললাম, ‘হাত দিয়ে রডটা যতো জোরে সম্ভব ধরে রাখ, ভয় পাইস না’। বারবার ঘুরেফিরে চললো এই আযাবের পর্ব। মনে মনে ভাবছিলাম, আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে মাফ-ছাফ নিয়ে আসা দরকার ছিলো, এইখান থেকে বেঁচে ফেরাটা ঢাকা মেডিকেলের জরুরী বিভাগ থেকে জীবিত ফেরার মতোই বিস্ময়কর হবে!!
সেদিন বেঁচেই ফিরেছিলাম। কিন্তু আমার সেই মৃত্যু আতঙ্ক জার্মান দেশ পর্যন্ত তাড়া করেছে। এখানে বসন্ত- আর গ্রীষ্মকালে ফোল্কস ফেস্ট (Volks Fest) বলে একটা মেলা হয়। ৭দিনের মধ্যে এরা একটা খোলা জায়গাতে ফ্যান্টাসী কিংডোমের মতোন সেটা-আপ দাঁড় করিয়ে ফেলে! সেখানে আরোও ভয়ঙ্কর দর্শন সব রাইডও থাকে। দুই সপ্তাহ মতোন মেলা চলে। আমরা দলবেঁধে একবার গেলাম সেই মেলায়। আর সবারটা জানি না, আমার উদ্দেশ্য ছিলো নিরাপদ দূরত্বে থেকে কেয়ামত সম্পর্কে আরোও বিস্তৃত জ্ঞান লাভ করা! মনজু ভাই দেখলাম আমারই মতোন মুরগী-কলিজা বিশিষ্ট। আমাদের সঙ্গীসাথীরা একের পর এক বিভিন্ন রাইডে উঠছে। আমি আর মনজু ভাই যদ্দূর সম্ভব ওদের এড়িয়ে চলার চেষ্টা করলাম।
যাহোক, আমাদের এই সহজ সরল বিনোদন একদল পোলাপানের পছন্দ হলো না। একটা রাইডের সামনে এসে ঠেসে ধরলো, ‘এইটাতে সব্বাইকে একসাথে উঠতে হবে’। কোনোরকম আপত্তিই কেউ কানে তুললো না। জিনিসটা দেখতে মূলতঃ একটা বিশালাকার বালতির মতো – খালি গভীরতা একটু কম। বালতির একদম ধার দিয়ে বৃত্তাকারে বেন্চ পাতা আছে। এবং ঐটুকুই; অন্যান্য রাইডের মতোন এটাতে ধরার জন্য একটা রেলিং থাকলেও বেল্ট বা ঐ জাতীয় কোন কিছুর বালাই নেই। রেলিংটা বেন্চের পেছন দিকে হওয়ায় পিছমোড়া করে ধরে রাখতে হয়। বালতি ঘুরতে শুরু করলে কেন্দ্রবিমুখী বলের কারণে সবাইকে ঠেলে ফেলে দিতে চাইবে, আর যাত্রী সাধারনকে রেলিং ধরে সেই পতন ঠেকাতে হবে। আমি এর মধ্যে আত্মরক্ষার একটা বিষয় খুঁজে পেলেও মজার জায়গাটা চিন্হিত করতে পারলাম না।
সবাই মিলে বালতিতে উঠলাম। একটু পরে আবিষ্কার করলাম বালতির ঘোরাটা কোনও সাধারণ ঘোরা নয়। অর্থাৎ শুরুর দিকে নিষ্পাপ ভাবে ঘুরতে থাকলেও একটু পরে ঘূর্ণনের সাথে সাথে ২য় আরেকটা গতি যুক্ত হলো। দ্বিতীয় গতিটাকে বলা হয় ‘ইয়োইং’। এটা অনেকটাই আমাদের দেশের কুলো দিয়ে চাল ঝাড়ার সাথে তুলনীয়। সমস্যা হচ্ছে কুলোয় চাল ঝাড়া হলেও সেখানে চালকে কুলোর ভেতরেই রাখার একটা চেষ্টা থাকে, এখানে আদম সন্তানদের শুধু ঝাড়াই হচ্ছে না, ফেলে দেবারও একটা প্রচেষ্টা আঁচ করা যাচ্ছে। ঘড়ি, মোবাইল আর ওয়ালেট রাইডে ওঠার আগেই বন্ধক রেখেছিলাম। এবার খোদার দেওয়া দুই পিস পা নিয়ে পরলাম বিপাকে। বসার জন্য বেন্চ থাকলেও মনে হচ্ছিল কেউ কৌটা ভর্তি বোরিক পাউডার ঢেলে ফেলেছে বেঞ্চের ওপর; সেটার সাথে পশ্চাদদেশের নিবিঢ় কোনও সম্পর্কই স্থাপন করা যাচ্ছিল না! ফলে বালতির ঝাঁকুনীর তোপে পদযুগল গ্যাস বেলুনের মতোন খালি আকাশমুখো হতে চাইছে; গোটা শরীরকে সেই আকাশ-বিহার থেকে বিরত রাখার দায়িত্ব চেপেছে দুইটামাত্র হাতের উপরে। ছোটবেলায় বাবা যখন দুইটা হাত ধরে ঝোলুই খেলতেন তখনও তেমন একটা উপভোগ করিনাই বাবার প্রতি অশেষ ভরসা থাকা সত্বেও। এই যন্ত্রের প্রতিও ভরসা কম বোধ করছি না। সমস্যা হলো, যন্ত্রটার কাজই হচ্ছে মানুষজন যাইই উঠুক, সব ঝেড়ে ফেলা – আর কাজটা যে খুবই সম্ভব সেই বিশ্বাসও পুরোপুরি ছিলো! আমি হন্য হয়ে আশেপাশে আশ্রয় খুঁজতে থাকলাম।
সব ঘুর্ণিঝড়েরই নাকি ‘চোখ’ বলে একটা জায়গা থাকে – আশপাশ উল্টে গেলেও ঐ চোখ থাকে শান্তশিষ্ট। পার্শ্ববর্তি গাট্টাগোট্টা এক বড়ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মনে হলো এই ঝড়ের চোখটা ওনার ‘ইয়ে’র নীচেই চাপা পরেছে! আমরা সবাই ব্যপক ওজনহীনতায় ভুগলেও অন্ততঃ ওনার পাছার নীচের জায়গাটায় মাধ্যাকর্ষণের কোনও অভাব আছে বলে মনে হলো না। ওনাকে সরিয়ে চোখের ওপর নিজের দখল নেবো এই সাহস আমার হলো না। তবে গোটা শরীর না হলেও অন্ততঃ পা দুটোকে চোখের মধ্যে ঢুকানোর পাঁয়তাড়া করতে লাগলাম। উনি যে জিন্স প্যান্ট পড়েছিলেন সেটাকে আমরা বলি ‘হাগা প্যান্ট’। বাচ্চা পোলাপাইন প্যান্টের মধ্যে হেগে ফেললে পেছন দিকে একটা স্ফীত ভাব সৃষ্টি হয় যেটা এইসব প্যান্টের ক্ষেত্রে হাগা ছাড়াই তৈরি হয়!! এই সাদৃশ্যের কথা ভেবেই এরকম নামকরণ। সাধারণ প্যান্টের পকেট পাছা বরাবর থাকলেও এই জাতীয় প্যান্টের পকেটগুলা থাকে হাটুর কাছাকাছি! তদুপরি পকেটের আকারও হয় বাজারের ব্যাগের মতোন বড়সর। সুতরাং আমি সুযোগ বুঝে দুই খান পা-ই ঠেসে দিলাম ওনার পকেটের মধ্যে! এর ফলে পাদু’টো অন্ততঃ খাবি খাওয়া থেকে রেহাই পেলো!
নিজে খানিকটা স্থিত হতেই চোখ পরলো মনজু ভাইয়ের ওপর। ওনার ঠোট দেখে মনে হলো অনবরত বিরবির করে কিছু জপছেন। ভূমিকম্প হলে মা বলতেন কালেমা পড়তে। মনজু ভাইও নিশ্চয়ই এখন কালেমাই পড়ছেন। উনি স্বাভাবিক অবস্থাতেই সোজা হয়ে ঠিকঠাকভাবে হাটাচলা করতে পারেন না। প্রশস্ত রাস্তাতেও ওনার হাঁটা দেখলে যে কেউ ভাববে উনি সার্কাসের দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটছেন। সুতরাং এরকম অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ওনার অবস্থাই যে সবচেয়ে বেশী বেসামাল হবে সেটা সহজেই অনুমেয়। বাস্তবেও তাইই হলো। বাসাবাড়ির ছাদে দড়ির সাথে সারি বেঁধে কাপড় শুকানোর দৃশ্য আমরা সবাই দেখেছি। প্রবল ঝড়ের মধ্যে পরলে দড়িতে ঝুলানো সবচেয়ে লম্বা প্যান্টটার যে অবস্থা হয় মনজু ভাইয়ের অবস্থা তথৈবচ মনে হলো। লম্বায় ছয়ফুটের মতোন হওয়াতে বালতির কুদৃষ্টি ওনার ওপরেই বেশি করে পরেছে! মনজু ভাইয়ের চেহারাই বলে দিচ্ছে, উনি জীবনের আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন! যাহোক, একসময় বালতির চালক যখন নিশ্চিত হলো যে, এদের ঝাঁকুনী যথেষ্ট হয়েছে তখন ঝর থামলো। বিনোদনের আরেক নাম যে এইরকমের প্রান বাঁচানোর যুদ্ধ সেটা আরেকবার টের পেলাম।
যাহোক, চরম হেনস্তা হয়ে আমরা যখন বালতি থেকে নামলাম, তখনই রাইডে চড়ার প্রণোদনা দাতাদের একজন বলে উঠলো, ‘এই তো! ভেরি সিম্পল! কি মনজু ভাই? বলছিলাম না ব্যাপার না!? ঠিকই তো পারলেন, শুধু শুধু ভয় পাচ্ছিলেন’! একটু আগে জীবন-মৃত্যূর মাঝখান থেকে অলৌকিক উপায়ে বেঁচে ফেরা মনজু ভাই অবশ্য এই ‘চিয়ারআপ’ বক্তব্যে খুশী হতে পারলেন না। উল্টো উনি চটে গেলেন। মাছ, পাখি এইসব প্রাণীকূলের চোখের ওপরে ভ্রুঁ না থাকায় তারা রাগ বা বিরক্তি প্রকাশ করতে পারে না। মনজু ভাইয়ের সেই সমস্যা নাই। সুতরাং, উনি পঞ্চ ইন্দ্রীয় কুঁচকে নিজের উষ্মা ঝাড়লেন – ‘শাট আপ! দিস ইজ নো জোক! দিস ইজ এ ম্যাটার অব (টু-ট্) লাইফ এন্ড ডেথ!!’
সাহেব মহিলার সামনে মাইক্রোফোন বাড়িয়ে ধরতেই মহিলা জলসঙ্কটের বয়ান দিতে শুরু করলেন। মন্ত্রী আমলাদের জীবনে মিডিয়া ডেইলি সোপ নাটকের মতোন বিরক্তিকর বিষয় হলেও এই সব আটপ্রৌঢ়ে মানুষ চট করে মিডিয়া হজম করতে পারে না। একদিকে জলসঙ্কটে দূর্বিষহ জীবনযাপনের যন্ত্রণা, আরেকদিকে টিভিতে নিজেকে দেখানোর অপরিশোধিত আনন্দ! দুইয়ের মধ্যে শেষমেষ সেলিব্রিটি হবার আনন্দই জয়যুক্ত হলো – গত কয়েকদিন ধরে গোসল বন্ধ, খাওয়ার পানিতে ভাসমান আবর্জনা, সাথে উৎকট গন্ধ! ভয়াবহ এই সমস্যা গুলোর কথা মহিলা বর্ণনা করলেন হাসি হাসি আনন্দিত মুখে! দেখে যে কেউ মনে করবে, পানি-সমস্যার বিষয়টা পুরোটাই গুজব, এদের কল দিয়ে নিয়মিত জমজম কূপের মতোন বিশুদ্ধ পানি বের হয়!
‘যন্ত্রণা’ আর ‘আনন্দ’র টানাটানির মধ্যে ‘আনন্দ’র এভাবে উৎড়ে যাওয়াটা নতুন কিছু না। টানাটানিটা যখন আনন্দর সাথে ভয়ের, তখনও জয়ের পাল্লাটা ভারী থাকে ঐ আনন্দের দিকেই! ফ্যান্টাসী কিংডোমে গিয়ে আমি নিজে এই ঘটনার সাক্ষী হয়েছি! তবে এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম শুধু আমি। সাহসের অভাবে ছোটবেলা থেকেই শিশুপার্ক জাতীয় জায়গাতে গিয়ে আমি ট্রেন বা নাগরদোলা ছাড়া অন্য কিছুতেই উঠতে চাইতাম না। চিড়িয়াখানায় গিয়ে জীবিত প্রাণীর কাঁধে ওঠার সাহস হতো না বলে শিশুপার্কের নির্জীব হাতি-ঘোড়ার ওপর চড়ে স্বাধ মেটাতাম। বড়বেলায় এসে অবশ্য বন্দুবান্ধবদের ওসওসায় পরে এমন কিছু রাইডে চড়তে বাধ্য হয়েছি যেগুলোতে ওঠার জন্য আমি মানসিক বা শারিরীক, কোনওভাবেই ফিট নই।
অনেকদিন পর্যন্ত দেশে শিশুপার্ক বা ওয়ান্ডারল্যান্ড-ই ছিলো এইসব শারীরিক বিনোদনের প্রাণকেন্দ্র। ফ্যান্টাসী কিংডোমের আবির্ভাব এসবকিছুকে একেবারে প্রস্তরযুগে পাঠিয়ে দিলো। ঐখানে যেসকল রাইডের সমাগম ঘটলো সেগুলো দেশের বিনোদন জগতে একেবারেই নুতন। কিন্তু সেগুলাও হজম করতে বাঙালীর বেশিদিন সময় লাগলো না। আজকাল দেখি, আসামীরা রিমান্ডে গিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে রাখে, সহজে খুলতে চায় না। আমার মনে হয়, ঐসব রাইডে নিয়মিত চড়ার ফলেই লোকজনের যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতা দিন দিন বেড়ে গিয়ে এই বিপত্তির সৃষ্টি হয়েছে!
আমার ছোট শ্যালিকা অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি পাওয়ার পরে উপহার হিসেবে তাকে ফ্যান্টাসী কিংডোমে নিয়ে যাবার আইডিয়া দিলো আমার হবু স্ত্রী। এতে করে শ্যালিকা মহলে আমার ইজ্জত বাড়বে এবং বহুত ফায়দা হবে। এই লোভে পা দিয়ে আমি আমার গোটা চারেক শ্যালিকা সমভিব্যাহারে ফ্যান্টাসী কিংডোমে গমন করলাম। এর আগে কখনও না গেলেও এর সু- এবং কুক্ষ্যাতি দুইই আমার কানে এসেছিলো। তবে কোনও রাইড সম্পর্কেই পূর্ণাঙ্গ নসিহত কারো কাছে পাইনাই। ফলে নিজেকে পুরোপুরি খোদার হাতে সমর্পন করে ঢুকলাম সেই কিংডোমে।
ঢোকার খানিক পরে বাম্পিং কার, দোলনা এসব পার করে আমরা আনন্দদিত চিত্তে এসে পৌছালাম রোলার কোস্টারের সামনে। বনভোজন করতে গিয়ে শালবনের মধ্যে চিতাবাঘ দেখলে যেমন ভড়কে যাওয়াই নিয়ম, আনন্দ করতে এসে এই জিনিস দেখেও আমি নিয়মমাফিক ভড়কে গেলাম! কারণ একটু আগেই মরনপণ চিৎকার করতে থাকা একদল নারী-পুরুষ নিয়ে মাথার ওপর দিয়ে ঐ জিনিসটাকে উড়ে যেতে দেখেছি। তখন ‘ঐপথ মাড়াবো না’ বলে ঠিক করে রাখলেও ভাগ্যের ফেরে একসময় ঐটার সামনেই এসে হাজির হলাম! সবাই মিলে অনেক জোড়াজুড়ি এবং মূলতঃ পৌরুষে আঘাত করায় একরকম বাধ্য হলাম উঠতে। এখানে আসার আগে শুনেছিলাম কে বা কারা যেন কোনও এক রাইডে উঠে কীটনাশক ছিটানোর ভঙ্গীতে চারিদিকে বমি ছিটিয়েছে – খানিক পরে যখন আকাশ আর পাতালের মাঝখানে দুলতে লাগলাম তখন মনে হলো, ‘এইটা সেই রাইড না হয়েই যায় না’। মোকসেদুল মো’মেনিন-এ কঠিন দিল নরম করার একটা দোয়া ছিলো, দেরী না করে আমি রোলার কোস্টারের চালকের উদ্দেশ্যে সেই দোয়া পরে গায়েবানা ফুঁ দেওয়া শুরু করলাম। এতে কাজ না হওয়ায় কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ রেখে ভয় কমাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু চোখের খোলা বা বন্ধ থাকার সাথে হৃৎপিন্ডের কোনও সম্পর্ক নাই; সুতরাং হৃদযন্ত্রের মাধ্যমে ভয়ের উদ্রেক হওয়া অব্যহত থাকলো।
মনে হলো, বাংলাদেশে বিদ্যুত জিনিসটা আরোও দুষ্প্রাপ্য হওয়া উচিৎ, তাইলে অন্ততঃ এইসব বিদ্যুতচালিত রাইডের মেয়াদ খানিকটা করে কমবে বলে আশা করা যায়। যাইহোক, কেমনে যেনো এক সময় রোলার কোস্টারের ‘জার্নি টু ইটার্নিটি’ শেষ হলো, কোনওরকমের হার্ট এ্যাটাক ছাড়াই অক্ষতভাবে নীচে নেমে আসায় নফল নামাজের নিয়ত করছিলাম মনে মনে। হঠাৎ কে যেন চিৎকার দিয়ে উঠলো “ম্যাজিক কার্পেট! ম্যাজিক কার্পেট!” জিনিসটার নাম শুনেছি। দিব্যচোখে দেখার পর মনে হলো, ‘ও এইটাই ম্যাজিক কার্পেট?’ জিনিসটা দিয়ে কি হয় সেটা তখনও বুঝিনাই। নামকরণ শুনে ধারণা করেছিলাম যে, হয়তো ফ্লাইং সিমুলেশন (উড্ডয়ন অভিজ্ঞতা) টাইপের কিছু হতে পারে। বলতে দ্বীধা নেই, জিনিসটার প্রতি একরকমের আগ্রহও বোধ হচ্ছিল। সবাই এগিয়ে গেলাম। কাছে গিয়ে দেখি ৮ বছরের কম শিশুদের ওঠা নিষেধ করা আছে। এটা দেখে একটু দমে গেলাম – আট বছর পর্যন্ত কি কি জিনিসে সবচেয়ে বেশী ভয় পেতাম, মনে করতে চেষ্টা করলাম। ভূত আর ছেলেধরা ছাড়া আর কিছুই মাথায় আসলো না। বেশী চিন্তাভাবনার সুযোগ নেই, পেছন থেকে সবাই ঠেলছে। সুতরাং ওঠা হলো ম্যাজিক কার্পেটে।
‘কার্পেট’ নাম দেওয়া হয়েছে যে জিনিসটার সেটা মূলতঃ একটা কাঠের বেন্চ। আশেপাশে কোথাও কার্পেটের চিন্হ পর্যন্ত নাই। কথায় কাজে এইরকম অমিল দেখে শুরুতেই খানিকটা ঘাবড়ে গেলাম। কিন্তু যাইহোক, এই পর্যায়ে এসেও আমি ঠাহর করতে পারছিলাম না কি ঘটতে যাচ্ছে। তবে যখন কার্পেট নাম্নী সেই বেন্চটা আমাদের সবাইকে নিয়ে উর্দ্ধমুখে ধাবমান হলো তখন হঠাৎ করে মনে হলো আত্মীয়-স্বজনদের সাথে ঈদের ছুটিতে চাঁদে যাচ্ছি। এতো দ্রুত এতো উপরে এর আগে উঠিনাই! কে জানি পাশ থেকে বলে উঠলো ‘এইবার কিন্তু নামবে, সাবধান’! বিনোদন করতে এসে এইরকম সাবধান বাণী শুনতে হলে ভয় তো লাগবেই। আমি দুই হাতে সামনের রডটা এমনভাবে আঁকড়ে ধরলাম যে হাত আর রডের মধ্যে কোন পার্থক্যই রইলো না। দুইটাই জবরজং শক্ত! যাহোক, আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতেই বেন্চ নিম্নগামী হলো। অনেকটাই অভিকর্ষজ ত্বরণে মুক্ত-পতন। মরতে মরতে বেঁচে যাবার একটা অনুভুতি টের পেলাম। হাশরের ময়দানে নাকি বারবার মৃত্যুর স্বাদ দেওয়া হবে। মরা মানুষকে জিন্দা করে আবার মেরে ফেলা হবে। ঘটনা সত্যি হলে তখন যন্ত্রণা কিঞ্চিত কম হবে বলেই আশা রাখি! কারণ, আমি যে জিনিসকে ফ্লাইট সিমুলেশন ভেবে ভুল করেছিলাম, ওঠার পরে বুঝলাম সেটা আসলে রোজ কেয়ামতের সিমুলেশন! আগেপিছে সবাই আর্তচিৎকার করছে, যেমনটা হাশরের দিন করার কথা! যন্ত্রটা একদম উপরে ওঠার পরে খানিক ক্ষনের জন্য দাঁড়ায়। ঐ সময়টার মধ্যে কেবল ‘কুলহুয়াল্লাহ’ সূরাটা পড়া সম্ভব, আমি সেটাই করছিলাম। পাশে থেকে আমার ছোট শ্যালিকা ভয়ার্ত গলায় বললো, ভাইয়া কখন থামবে? প্রশ্ন কমন পড়লেও উত্তর দিতে পারলাম না! হাশরের দিনে নাকি পিতা সন্তানকে চিনবে না, আমি অবশ্য তখনও আমার শ্যালিকাকে চিনতে পারছিলাম; বললাম, ‘হাত দিয়ে রডটা যতো জোরে সম্ভব ধরে রাখ, ভয় পাইস না’। বারবার ঘুরেফিরে চললো এই আযাবের পর্ব। মনে মনে ভাবছিলাম, আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে মাফ-ছাফ নিয়ে আসা দরকার ছিলো, এইখান থেকে বেঁচে ফেরাটা ঢাকা মেডিকেলের জরুরী বিভাগ থেকে জীবিত ফেরার মতোই বিস্ময়কর হবে!!
সেদিন বেঁচেই ফিরেছিলাম। কিন্তু আমার সেই মৃত্যু আতঙ্ক জার্মান দেশ পর্যন্ত তাড়া করেছে। এখানে বসন্ত- আর গ্রীষ্মকালে ফোল্কস ফেস্ট (Volks Fest) বলে একটা মেলা হয়। ৭দিনের মধ্যে এরা একটা খোলা জায়গাতে ফ্যান্টাসী কিংডোমের মতোন সেটা-আপ দাঁড় করিয়ে ফেলে! সেখানে আরোও ভয়ঙ্কর দর্শন সব রাইডও থাকে। দুই সপ্তাহ মতোন মেলা চলে। আমরা দলবেঁধে একবার গেলাম সেই মেলায়। আর সবারটা জানি না, আমার উদ্দেশ্য ছিলো নিরাপদ দূরত্বে থেকে কেয়ামত সম্পর্কে আরোও বিস্তৃত জ্ঞান লাভ করা! মনজু ভাই দেখলাম আমারই মতোন মুরগী-কলিজা বিশিষ্ট। আমাদের সঙ্গীসাথীরা একের পর এক বিভিন্ন রাইডে উঠছে। আমি আর মনজু ভাই যদ্দূর সম্ভব ওদের এড়িয়ে চলার চেষ্টা করলাম।
যাহোক, আমাদের এই সহজ সরল বিনোদন একদল পোলাপানের পছন্দ হলো না। একটা রাইডের সামনে এসে ঠেসে ধরলো, ‘এইটাতে সব্বাইকে একসাথে উঠতে হবে’। কোনোরকম আপত্তিই কেউ কানে তুললো না। জিনিসটা দেখতে মূলতঃ একটা বিশালাকার বালতির মতো – খালি গভীরতা একটু কম। বালতির একদম ধার দিয়ে বৃত্তাকারে বেন্চ পাতা আছে। এবং ঐটুকুই; অন্যান্য রাইডের মতোন এটাতে ধরার জন্য একটা রেলিং থাকলেও বেল্ট বা ঐ জাতীয় কোন কিছুর বালাই নেই। রেলিংটা বেন্চের পেছন দিকে হওয়ায় পিছমোড়া করে ধরে রাখতে হয়। বালতি ঘুরতে শুরু করলে কেন্দ্রবিমুখী বলের কারণে সবাইকে ঠেলে ফেলে দিতে চাইবে, আর যাত্রী সাধারনকে রেলিং ধরে সেই পতন ঠেকাতে হবে। আমি এর মধ্যে আত্মরক্ষার একটা বিষয় খুঁজে পেলেও মজার জায়গাটা চিন্হিত করতে পারলাম না।
সবাই মিলে বালতিতে উঠলাম। একটু পরে আবিষ্কার করলাম বালতির ঘোরাটা কোনও সাধারণ ঘোরা নয়। অর্থাৎ শুরুর দিকে নিষ্পাপ ভাবে ঘুরতে থাকলেও একটু পরে ঘূর্ণনের সাথে সাথে ২য় আরেকটা গতি যুক্ত হলো। দ্বিতীয় গতিটাকে বলা হয় ‘ইয়োইং’। এটা অনেকটাই আমাদের দেশের কুলো দিয়ে চাল ঝাড়ার সাথে তুলনীয়। সমস্যা হচ্ছে কুলোয় চাল ঝাড়া হলেও সেখানে চালকে কুলোর ভেতরেই রাখার একটা চেষ্টা থাকে, এখানে আদম সন্তানদের শুধু ঝাড়াই হচ্ছে না, ফেলে দেবারও একটা প্রচেষ্টা আঁচ করা যাচ্ছে। ঘড়ি, মোবাইল আর ওয়ালেট রাইডে ওঠার আগেই বন্ধক রেখেছিলাম। এবার খোদার দেওয়া দুই পিস পা নিয়ে পরলাম বিপাকে। বসার জন্য বেন্চ থাকলেও মনে হচ্ছিল কেউ কৌটা ভর্তি বোরিক পাউডার ঢেলে ফেলেছে বেঞ্চের ওপর; সেটার সাথে পশ্চাদদেশের নিবিঢ় কোনও সম্পর্কই স্থাপন করা যাচ্ছিল না! ফলে বালতির ঝাঁকুনীর তোপে পদযুগল গ্যাস বেলুনের মতোন খালি আকাশমুখো হতে চাইছে; গোটা শরীরকে সেই আকাশ-বিহার থেকে বিরত রাখার দায়িত্ব চেপেছে দুইটামাত্র হাতের উপরে। ছোটবেলায় বাবা যখন দুইটা হাত ধরে ঝোলুই খেলতেন তখনও তেমন একটা উপভোগ করিনাই বাবার প্রতি অশেষ ভরসা থাকা সত্বেও। এই যন্ত্রের প্রতিও ভরসা কম বোধ করছি না। সমস্যা হলো, যন্ত্রটার কাজই হচ্ছে মানুষজন যাইই উঠুক, সব ঝেড়ে ফেলা – আর কাজটা যে খুবই সম্ভব সেই বিশ্বাসও পুরোপুরি ছিলো! আমি হন্য হয়ে আশেপাশে আশ্রয় খুঁজতে থাকলাম।
সব ঘুর্ণিঝড়েরই নাকি ‘চোখ’ বলে একটা জায়গা থাকে – আশপাশ উল্টে গেলেও ঐ চোখ থাকে শান্তশিষ্ট। পার্শ্ববর্তি গাট্টাগোট্টা এক বড়ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মনে হলো এই ঝড়ের চোখটা ওনার ‘ইয়ে’র নীচেই চাপা পরেছে! আমরা সবাই ব্যপক ওজনহীনতায় ভুগলেও অন্ততঃ ওনার পাছার নীচের জায়গাটায় মাধ্যাকর্ষণের কোনও অভাব আছে বলে মনে হলো না। ওনাকে সরিয়ে চোখের ওপর নিজের দখল নেবো এই সাহস আমার হলো না। তবে গোটা শরীর না হলেও অন্ততঃ পা দুটোকে চোখের মধ্যে ঢুকানোর পাঁয়তাড়া করতে লাগলাম। উনি যে জিন্স প্যান্ট পড়েছিলেন সেটাকে আমরা বলি ‘হাগা প্যান্ট’। বাচ্চা পোলাপাইন প্যান্টের মধ্যে হেগে ফেললে পেছন দিকে একটা স্ফীত ভাব সৃষ্টি হয় যেটা এইসব প্যান্টের ক্ষেত্রে হাগা ছাড়াই তৈরি হয়!! এই সাদৃশ্যের কথা ভেবেই এরকম নামকরণ। সাধারণ প্যান্টের পকেট পাছা বরাবর থাকলেও এই জাতীয় প্যান্টের পকেটগুলা থাকে হাটুর কাছাকাছি! তদুপরি পকেটের আকারও হয় বাজারের ব্যাগের মতোন বড়সর। সুতরাং আমি সুযোগ বুঝে দুই খান পা-ই ঠেসে দিলাম ওনার পকেটের মধ্যে! এর ফলে পাদু’টো অন্ততঃ খাবি খাওয়া থেকে রেহাই পেলো!
নিজে খানিকটা স্থিত হতেই চোখ পরলো মনজু ভাইয়ের ওপর। ওনার ঠোট দেখে মনে হলো অনবরত বিরবির করে কিছু জপছেন। ভূমিকম্প হলে মা বলতেন কালেমা পড়তে। মনজু ভাইও নিশ্চয়ই এখন কালেমাই পড়ছেন। উনি স্বাভাবিক অবস্থাতেই সোজা হয়ে ঠিকঠাকভাবে হাটাচলা করতে পারেন না। প্রশস্ত রাস্তাতেও ওনার হাঁটা দেখলে যে কেউ ভাববে উনি সার্কাসের দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটছেন। সুতরাং এরকম অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ওনার অবস্থাই যে সবচেয়ে বেশী বেসামাল হবে সেটা সহজেই অনুমেয়। বাস্তবেও তাইই হলো। বাসাবাড়ির ছাদে দড়ির সাথে সারি বেঁধে কাপড় শুকানোর দৃশ্য আমরা সবাই দেখেছি। প্রবল ঝড়ের মধ্যে পরলে দড়িতে ঝুলানো সবচেয়ে লম্বা প্যান্টটার যে অবস্থা হয় মনজু ভাইয়ের অবস্থা তথৈবচ মনে হলো। লম্বায় ছয়ফুটের মতোন হওয়াতে বালতির কুদৃষ্টি ওনার ওপরেই বেশি করে পরেছে! মনজু ভাইয়ের চেহারাই বলে দিচ্ছে, উনি জীবনের আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন! যাহোক, একসময় বালতির চালক যখন নিশ্চিত হলো যে, এদের ঝাঁকুনী যথেষ্ট হয়েছে তখন ঝর থামলো। বিনোদনের আরেক নাম যে এইরকমের প্রান বাঁচানোর যুদ্ধ সেটা আরেকবার টের পেলাম।
যাহোক, চরম হেনস্তা হয়ে আমরা যখন বালতি থেকে নামলাম, তখনই রাইডে চড়ার প্রণোদনা দাতাদের একজন বলে উঠলো, ‘এই তো! ভেরি সিম্পল! কি মনজু ভাই? বলছিলাম না ব্যাপার না!? ঠিকই তো পারলেন, শুধু শুধু ভয় পাচ্ছিলেন’! একটু আগে জীবন-মৃত্যূর মাঝখান থেকে অলৌকিক উপায়ে বেঁচে ফেরা মনজু ভাই অবশ্য এই ‘চিয়ারআপ’ বক্তব্যে খুশী হতে পারলেন না। উল্টো উনি চটে গেলেন। মাছ, পাখি এইসব প্রাণীকূলের চোখের ওপরে ভ্রুঁ না থাকায় তারা রাগ বা বিরক্তি প্রকাশ করতে পারে না। মনজু ভাইয়ের সেই সমস্যা নাই। সুতরাং, উনি পঞ্চ ইন্দ্রীয় কুঁচকে নিজের উষ্মা ঝাড়লেন – ‘শাট আপ! দিস ইজ নো জোক! দিস ইজ এ ম্যাটার অব (টু-ট্) লাইফ এন্ড ডেথ!!’
Post a Comment