পশ্চিমবঙ্গের মালদহ শহর থেকে দশ কিলোমিটার দক্ষিনে অবস্থিত প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড় ও পান্ডুয়া (প্রাচীন নাম গৌড়নগর ও পান্ডুনগর ) । অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে বৌদ্ধ যুগে পাল বংশের রাজাদের সময় থেকে বাংলার রাজধানী ছিল গৌড়। ১১৯৮ সালে মুসলমান শাসকেরা গৌড় অধিকার করবার পরেও গৌড়েই বাংলার রাজধানী থেকে যায়। ১৩৫০ থেকে রাজধানী কিছুদিনের জন্য পান্ডুয়ায় স্থানান্তরিত হলেও ১৪৫৩ সালে আবার রাজধানী ফিরে আসে গৌড়ে, এবং গৌড়ের নামকরন হয় জান্নাতাবাদ ।
আমার তোলা কিছু ছবি আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম।
তাঁতিপাড়া মসজিদের প্রবেশ পথ।
বড় সোনা মসজিদ বা বারো দুয়ারী।
গৌড়ের স্থাপত্য কির্তীগুলির মধ্যে এটি সবথেকে বড়। সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এটির নির্মান কার্য্য শুরু করলেও তিনি এ কাজ সমাপ্ত করে যেতে পারেন নি। তাঁর পুত্র সুলতান নসরত শাহ ১৫২৬ সালে এই কাজ সম্পন্ন করেন। এর উচ্চতা ২০ ফুট, দৈর্ঘ্য ১৬৮ ফুট ও প্রস্থ ৭৬ ফুট।
দাখিল দরোয়াজা
এটি গৌড় দুর্গে প্রবেশের প্রধান দ্বার। এটি ৬০ ফুট উঁচু ও ৭৩ ফুট চওড়া এই দরওয়াজাটি ছোট ছোট ইঁট ও পাথর দিয়ে তৈরী করেছিলেন সম্ভবতঃ সুলতান বারবক শাহ। ভিতরের পথটি বেশ চওড়া, তাই সওয়ারী সহ হাতি অনায়াসে এই দরওয়াজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতে পারত। এই দরজার দুপাশ থেকে তোপধ্বনি করে সুলতান ও উর্ধতন রাজপুরুষদের সম্মান প্রদর্শন করা হত। তাই এই দরওয়াজার আর এক নাম সেলামী দরওয়াজা।
লোটন মসজিদ
কোতোয়ালি দরোয়াজা থেকে ১ কি.মি. উত্তরে রয়েছে এই লোটন মসজিদ। এখানে ইঁটের উপর রং-বেরঙ্গের মীনার কারুকার্য ছিলো, বর্তমানে যার প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই, তবে খুব ভাল করে দেখলে বোঝা যায় এর সামান্য অস্তিত্ব । ছাদের গম্বুজের নিচের দিককার সৌন্দর্য অপূর্ব।
লুকোচুরি দরোয়াজা
১৬৫৫ খ্রীষ্টাব্দে বাংলার সুবেদার শাহ সুজা গৌড় দুর্গে প্রবেশ করবার জন্য এই দরোয়াজাটি তৈরি করেন। উচ্চতা ৬৫ ফুট ও চওড়া ৪২ ফুট। দুইদিকে প্রহরীদের ঘর ও ওপরে নহবতখানা আছে।
কদম রসুল মদজিদ
লুকোচুরি ফটক বা দরোয়াজা দিয়ে গৌড় দুর্গে ঢোকার পর ডানদিকে রয়েছে কদমরসুল সৌধ। এখানে রয়েছে হজরত মহম্মদ(সাঃ) এর পদচিহ্ন, যেটা সুদূর আরব থেকে পীর শাহ জালাল তাবরেজী এনেছিলেন পান্ডুয়া-র বড় দরগায়, সেখান থেকে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এটিকে নিয়ে আসেন গৌড় দুর্গে। তাঁর পুত্র সুলতান নসরত শাহ ১৫৩০ সালে একটি কষ্ঠি পাথরের বেদির ওপর পদচিহ্নটি স্থাপন করে তার ওপর কদম রসুল সৌধ নির্মান করেন।
পান্ডুয়ার আদিনা মসজিদ।
১৩ আগষ্ট ২০১২ তারিখে এই লেখার প্রথম পর্ব আমি পোস্ট করেছি।
প্রাচীন বাংলার রাজধানী : প্রথম পর্ব – গৌড়
মালদহে গৌড় ভ্রমন পর্ব সমাপ্ত করে আমাদের আজকের গন্তব্য হল আর এক ঐতিহাসিক জায়গা পান্ডুয়া, যার পৌরানিক নাম পুন্ড্রবর্ধন।
হিউয়েন সাং এর রচনা থেকে জানা যায় যে প্রাচীন কালে এখানে প্রচুর বৌদ্ধ ভিক্ষু বাস করতেন। পরবর্তীকালে মুসলিম শাসকেরা ভেঙ্গে পড়া মন্দির, স্তুপ, বৌদ্ধ বিহার প্রভৃতি থেকে বিভিন্ন জিনিস সংগ্রহ করে ব্যবহার করতেন প্রাসাদ, মসজিদ, মিনার নির্মানে।
পৌরানিক নাম পুন্ড্রবর্ধন কালের প্রবাহে বিভিন্ন সময়ে “পান্ডুয়া”, “হজরত পান্ডুয়া” ও “ফিরুজাবাদ” এই সব বিভিন্ন নামে ইতিহাসে নিজের স্থান করে নিয়েছে। ১৩৫০ থেকে ১৪৫৩ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার রাজধানী ছিল এই পান্ডুয়া। পরে আবার রাজধানী ফিরে আসে গৌড়ে।
আমার তোলা পান্ডুয়ার কয়েকটি ঐতিহাসিক সৌধের ছবি আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করলাম।
আদিনা মসজিদ
৩৪ নং জাতীয় সড়কের ধারে রয়েছে এই আদিনা মসজিদ। এটি সিরিয়ার উমাইয়া মসজিদের আদলে তৈরি। এটি তৎকালীন দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম মসজিদ।
স্থাপত্য শিল্প , কারুকার্য ও বিশালতায় এই মসজিদ অতুলনীয়। এই মসজিদটি সুলতান সেকেন্দার শাহ প্রচুর অর্থ ব্যয় করে নির্মান করেন এবং সময় লেগেছিলো ১০ বছর (১৩৬৪ – ১৩৭৪ )। এই মসজিদটিতে সুলতান , তার পারিষদবর্গ ও পান্ডুয়ার সকল অধিবাসীরা ( কথিত আছে দশ হাজার ) একত্রে জুম্মার নামাজ পড়তেন। ভিতরে ৪০০ ফুট লম্বা ও ১৫৫ ফুট চওড়া প্রাঙ্গন আছে যেটা পুরু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। এখানে ৯৮ টি খিলান ছিলো। এখন অনেকটাই ধ্বংসপ্রাপ্ত, তবে ভারতীয় প্রত্নতত্ব বিভাগের পক্ষ থেকে সারাইয়ের কাজ চলছে। মেঝে থেকে ৮ ফুট উচুতে “বাদশা কি তখত” নামে একটি মঞ্চ রয়েছে, যার পিছনের পাথরের জালির আড়ালে সুলতান পরিবারের মহিলারা নামাযে অংশগ্রহন করতেন।
সুলতান সিকান্দার শাহের সমাধি
আদিনা মসজিদের পাশেই রয়েছে সুলতান সিকান্দার শাহের সমাধি। এই সৌধটির গঠনে বৌদ্ধ যুগের ছাপ রয়েছে। দেওয়ালে টেরাকোটা ও ইঁটের কারুকাজ , পাথরের নকশা ও সুক্ষ জালির কাজ অতুলনীয়।
সোনা মসজিদ বা কুতুবশাহী মসজিদ
অতীতে এর মিনার ও দেওয়ালে সোনালি গিলটি করা কারুকার্য ছিলো বলে এর আর এক নাম সোনা মসজিদ। মসজিদটি আয়তকার এবং নির্মান করেন মখদুম শেখ ১৮৫২ সালে ।
একলাখি সমাধি
সোনা মসজিদ থেকে অল্প একটু দূরে রাজা গনেশের ধর্মান্তরিত পুত্র যদু যিনি পরবর্তী কালে সুলতান জালালুদ্দিন মহম্মদ শাহ নামে পরিচিত হন, নিজের মৃত্যুর আগেই একলাখ টাকা খরচ করে নিজের জন্য এই সমাধি সৌধ নির্মান করেন (১৪১৪ –- ১৪২৮ খ্রীষ্টাব্দ)। তখনকার দিনে এই সমাধি নির্মানে একলাখ টাকা খরচ হয়েছিল বলে এই সমাধির নাম একলাখি সমাধি। এখানে সুলতানের পত্নী ও পুত্রের সমাধিও আছে। এটির স্থাপত্য অপুর্ব সুন্দর এবং এই সৌধ ২৭ ফুট উঁচু।
তুলাভিটা
মালদা থেকে প্রায় ৪৬ কি.মি. দূরে, এই তুলাভিটা মালদা জেলার হবিবপুর থানায় পড়ে, (অঞ্চল: বৈদ্যপুর জগজীবনপুর)। জগজীবনপুরে একটি বৌদ্ধবিহার সম্প্রতি আবিষ্কার হয়েছে। এটি পাল যুগের মহেন্দ্র দেব পালের আমলের (যিনি নবম বা দশম শতাব্দীতে এখানে রাজত্ব করতেন)। মহেন্দ্র দেব পাল এই অঞ্চলটি বৌদ্ধদের দান করেন এবং এটি বৌদ্ধবিহার নামে পরিচিত হয়। খনন কার্যের সময় এই দান পত্র পাওয়া গেছে এখানেই ১৯৮৭ সালের ১৩ ই মার্চ। এটি পালি ভাষায় তামার প্লেটের উপর লেখা, ওজন ১১ কে জি ৮০০ গ্রাম, আনুমানিক ১৮ ইঞ্চি লম্বা ও ২২ ইঞ্চি চওড়া। বিভিন্ন ধরনের পোড়ামাটির মূর্তি ও টেরাকোটার ফলক এখান থেকে পাওয়া গেছে, যার কিছু মালদা-র মিউজিয়ামে ও কিছু কলকাতার প্রত্নতাত্বীক মিউজিয়ামে রাখা আছে।

Post a Comment