0
‘শেখু বাবা’। অনেক সাধনার ধন সম্রাট জাহাঙ্গীরকে শিশুকালে সম্রাট আকবর এই নামে ডাকতেন। সম্রাট আকবরের যমজ দুই ছেলে হাসান ও হোসেন শৈশবে মারা গেলে পুত্র সন্তানের জন্য উদ্গ্রিব হয়ে পড়েন। শেখ সেলিম চিশতী (রঃ)’এর আশীর্বাদে অবশেষে ২০ সেটেম্বর ১৫৬৯ (মতান্তরে আগস্ট ৩১, ১৫৬৯) সালে যোধা বাঈ গর্ভে তিনি জন্ম নেন। (অনেক ইতিহাসবিদ বলেন যে, সবাই জাহাঙ্গীরকে যোধা বাঈর সন্তান ভাবলেও আসলে তিনি তার সন্তান নন) জন্মের পর সম্রাট জাহাঙ্গীরের নাম সেলিম রাখা হয়। কিন্তু সম্রাট আকবর আদর করে তাঁকে শেখু বাবা বলেই ডাকতেন। যার পুরো নাম Abu’l-Fath Nur-ud-din Muhammad Jahangir। শিশুকালে সম্রাট জাহাঙ্গীরকে শেখ সেলিম চিশতী (রঃ)’এর মেয়ে লালন-পালন করেছেন। তখন আকবর ইমোশনাললি শেখ সেলিম চিশতী (রঃ)’র গ্রাম ‘সিক্রি’ যাতায়াত শুরু করেন। একপর্যায়ে তিনি তার দরবার (imperial court and residence) আগ্রা থেকে সিক্রি’তে স্থানান্তর করেন এবং নূতন নাম করণ করা হয় ফতেহপুর সিক্রি। জাহাঙ্গীরের পালক ভাই (পালক মায়ের সন্তান, শেখ সেলিম চিশতী’র নাতি) নবাব কুতুবুদ্দিন খান সম্রাট আকবরের ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন, পরব্তীতে তাঁকে বাংলার দায়িত্ব দেয়া হয়।
সম্রাট জাহাঙ্গীরসম্রাট জাহাঙ্গীর খুব প্রকৃতি প্রেমিক ছিলেন (!), তিনি সপ্তাহে ৫ দিনই শিকারে বের হতেন। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর সপ্তাহে দুই দিন শিকারে যেতেন না। তার সাম্রাজ্যে রবি ও বৃহস্পতিবার দুই দিন পশুহত্যাও ছিল নিষিদ্ধ। রবিবার ছিল পিতা আকবরের জন্মদিন এবং বৃহস্পতিবার তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। জাহাঙ্গীর ১২ বছর বয়সে প্রথম শিকারে যান। পিতা আকবরই তাকে শিকার অভিযানে উৎসাহিত করেছিলেন। আসলে মোগলদের শিকার অভিযান মানে পশু হত্যাই ছিল না। এর পেছনে আরও অনেক কারণ কাজ করত প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে। বিপুলসংখ্যক মানুষ নিয়ে যাওয়া হতো শিকার অভিযানে। সৈন্য-সামন্তও থাকত প্রচুর। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যে সুবেদার মনে মনে বিদ্রোহ করার পরিকল্পনা করছে কিংবা শত্রুভাবাপন্ন কোনো রাজার সীমান্তেই এসব শিকার অভিযান পরিচালনা করা হতো। বিপুলসংখ্যক সৈন্য এবং জাঁকজমকপূর্ণ প্রদর্শনীর মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে জানিয়ে দেওয়া হতো, মোগল সম্রাটের দাপট কেমন। ফলে অনেকেই বিদ্রোহের পরিকল্পনা ত্যাগ করত। তাছাড়া এসব অভিযানের মাধ্যমে সম্রাটরা আশপাশের এলাকা সম্পর্কে অনেক তথ্য সরাসরি জানতে পারতেন।
তিনি কাশ্মীর্ ভ্রমণে গিয়ে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি বলেছিলেন ‘পৃথিবীতে ভূস্বর্গ বলে যদি কিছু থাকে’ তো এই সেই ভূস্বর্গ!’
১৬০০ সালে সম্রাট আকবর যখন এক অভিযানে গিয়েছিলেন, সেই সুযোগে জাহাঙ্গীর নিজেকে সম্রাট ঘোষণা দিয়ে ফেলেন, পরব্তীতে আকবর রাজ্যে ফিরে এসে সেই আদেশ রহিত করেন। সে সময় আকবর সেলিম (জাহাঙ্গীর)’এর পরিবর্তে তার বড় দহিত্র খসরু মির্জা (Khusrau Mirza)’কে সম্রাট করার চিন্তা ভাবনা করেন। কিন্তু পিতার (আকবর) মৃত্যুর ৮ দিন পর সেলিম সিংহাসনে আরোহণ করে (3 November 1605)। সিঙ্ঘাসনে বসে সেলিম থেকে তিনি Abu’l-Fath Nur-ud-din Muhammad Jahangir নাম ধারণ করেন।
খুসরু মির্জা অনুজ খুররম মির্জার (শাহ্‌ জাহান) হাতে নির্মম ভাবে খুন হন, আর রাজ সিংহাসন থেকে তার প্রতি্বন্দ্বীকে চিরতরে সরিয়ে দেন।
বাবার মতন সম্রাট জাহাঙ্গীরও পীর আওলিয়ার ভক্ত ছিলেন। তিনি হজরত মুজাদ্দিদে আলফেসানী (রহ.) কে তাঁর দরবারেআমন্ত্রণ জানান। হজরত মুজাদ্দিদে আলফেসানী (রহ.) দীর্ঘ সাড়ে তিন বছর শাহী দরবারে অবস্থানের পর দ্বীনের প্রতি সম্রাটের আস্থা, আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি প্রেম, ভালোবাসা ও ভয়ভীতির বিষয়টি সম্রাটের ভেতর পুরোপুরি সৃষ্টি করতে পেরে সুযোগ বুঝে তিনি একদিন সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছে ৭ দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাব পেশ করেন। ১. সম্রাটকে সিজদা করার প্রথা রহিত করতে হবে। ২. গরু জবাইয়ের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হবে। ৩. সম্রাট ও তার সভাসদদের তকবিরে উলার সঙ্গে নামাজ আদায় করতে হবে। ৪. শরিয়াহ বিভাগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে কাজির পদ পুনর্বহাল করতে হবে। ৫. সমাজে প্রচলিত সব ধরনের বিদআত, কুসংস্কার ও ইসলামবিরোধী কার্যকলাপ বন্ধ করতে হবে। ৬. ভগ্ন ও বিধ্বস্ত মসজিদগুলো সংস্কার করে সেগুলো আবাদ করতে হবে। ৭. আকবরের যাবতীয় ইসলামবিরোধী আইন পুরোপুরি বাতিল ঘোষণা করতে হবে। সম্রাট তার এসব দাবি মেনে নিয়ে তাত্ক্ষণিকভাবে এ মর্মে শাহী ফরমান জারি করেন। মুজাদ্দিদে আলফেসানী (রহ.) এভাবেই তার সংস্কারমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে এই উপমহাদেশে ইসলামের ওপর চেপে বসা জগদ্দল পাথর অপসারণ করে ফের ইসলাম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইতিহাসের সোনালি অধ্যায় রচনার সৌভাগ্য অর্জন করেন। আর এভাবেই উপমহাদেশ থেকে আকবরের দ্বীনে ইলাহীর পরিসমাপ্তি ঘটে।
সম্রাট জাহাঙ্গীর সুশাসনের জন্য সবার কাছে খুব প্রিয় ছিলেন। তিনি প্রত্যক্ষভাবে প্রজাদের সুবিধা অসুবিধার খোঁজ নিতেন, পজারা স্বয়ং দরবারে উপস্থিত হয়ে তাদের আর্জি জানাত আর সম্রাট জাহাঙ্গীর সে মতে সমস্যা সমাধানে নির্দেশ দিতেন।
সম্রাট জাহাঙ্গীর ও সাদা হাতি
উপমহাদেশে আগত প্রথম মুসলিম অভিজাতরা নিজের দেশে হাতি চোখেও দেখেননি। মুঘলদের আদি বাসস্থানে হাতির নাম নিশানা ছিল না। ঘোড়াই ছিল তাদের প্রধান যুদ্ধাস্ত্র ও চলাচলের বাহন। হাতির সঙ্গে তাদের প্রথম পরিচয় এদেশের মাটিতে পা দিয়ে। প্রাণীটির রাজকীয় মহিমার বিস্ময় উদ্রেককারী শক্তি এবং বিশাল আকার মুঘলদের নজর কেড়েছিল। সারা হিন্দুস্তান থেকে বাছাই করা হাতি মুঘল বাহিনীতে ভর্তি করার রেওয়াজ চালু হলো। আইন-ই-আকবরী থেকে জানা যায় সম্রাট আকবরের নিজের ব্যবহারের জন্য সর্বদা একশ সুশিক্ষিত হাতি প্রস্তুত থাকত। তিনি যে হাতিতে আরোহণ করতেন সে হাতি তিনি নিজেই চালাতেন, মাহুতকে ডাকা হতো না। হাতির দাঁতের ওপর পা রেখে পিঠে উঠে নিজের বিচিত্র বিদ্যা দেখিয়ে অনেক হস্তীবিশারদকে চমৎকৃত করতেন বাদশা আকবর। ইসলাম খান বাংলায় বারো ভূঁইয়াদের সঙ্গে জয়লাভ করার পর পরাজিত ভূঁইয়াদের শর্ত মোতাবেক সব পুরুষ দাঁতাল হাতি মুঘল সুবেদারের প্রতিনিধির হাতে তুলে দিতে হয়। মুসা খান থেকে খাজা ওসমান ও অন্য ভূঁইয়াদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া সব হাতি শাহী দরবারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। জাহাঙ্গীরের সময় মুঘলদের বঙ্গ বিজয় সম্পন্ন হলে বাংলার সেরা হাতিগুলো মুঘল রাজধানীর হাতিশালায় পাঠানো শুরু হয়। মুঘল সম্রাটদের হাতির প্রতি প্রবল আকর্ষণ তাদের স্মৃতিকথা এবং মুঘল ঐতিহাসিকদের লেখায় স্থান করে আছে। জঙ্গলে খেদা দিয়ে বন্য হাতি ধরে রাজধানীতে পাঠানোর জন্য সুবেদারদের নিয়মিত নির্দেশ পাঠাতেন তারা। রাজ্যের যেখানেই হাতি পাওয়া সম্ভব, সেখান থেকেই হাতি সংগ্রহ করে আর শত্রুপক্ষের কাছ থেকে হাতি ছিনিয়ে নিয়ে মুঘল দরবারে পাঠানো ছিল সুবেদারদের অন্যতম দায়িত্ব। কামরূপ পাহাড়ে, আসামে বা ত্রিপুরায় বাংলায় মুঘলদের হাতির ক্ষুধা মেটাতে কম যুদ্ধবিগ্রহ হয়নি। বাহারীস্তান-ই-গায়বী ও সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্মৃতিকথা তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরীতে এ নিয়ে অনেক তথ্য রয়েছে।
সম্রাট জাহাঙ্গীর ৩টি বিয়ে করেছিলেন। তাদের মাঝে ২ জনকে জানা যায়। এরা হলেন- রাজকন্যা মানবতী, বেগম নুর জাহান। বেগম নূর জাহান ছিলেন মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের দ্বিতীয় স্ত্রী। তিনি ছিলেন জাহাঙ্গীরের খুবই পছন্দের। সম্রাট জাহাঙ্গীর ছিলেন নূর জাহানের দ্বিতীয় স্বামী। এই যুগলের একে অন্যের প্রতি মোহ এবং তাদের মধ্যে সম্পর্ক অনেক কিংবদন্তির (প্রশ্ন সাপেক্ষ) জন্ম দিয়েছে। নুরজাহান ছিলেন মুঘল সম্রাট আকবরের একজন সেনাপতির কন্যা। নূর জাহানের প্রকৃত নাম মেহের-উন-নেছা। সম্রাট জাহাঙ্গীর তার রূপগুনে মুগ্ধ হয়ে নাম রাখেন নুর জাহান, যার অথ দুনিয়ার আলো।
তাঁর সন্তান- নিছার বেগম, খসরু, পারভেজ, বাহার বানু বেগম, শাহ জাহান (পরবর্তী সম্রাট), শাহরিয়ার, জাহানদার।
১৬২৭ সালের দিকে তিনি অসস্থ থাকা কালে হাওয়া পরিবর্তনের জন্য কাবুল আর কাশ্মীরে অবস্থান করেন। এক সময় কাশ্মীর থেকে প্রত্যাবর্তন করার সময় সরাই সাদাবাদের কাছাকাছি পৌছলে তীব্রঠাণ্ডা রোগে ভুগে ৮ নভেম্বর ১৬২৭ (মতান্তরে ২৮, অক্টোবর ১৬২৭) সালে মৃত্যুবরণ করেন। প্রথমে তাঁকে কাশ্মীরের চিঙ্গাস ফোর্টে সমাধিস্থ করা হয়। এর পর তার মরদেহ লাহোরের শাহদারাবাগে সমাহিত করা হয়। তাঁর মৃত্যুর পর খুররম মির্জা তথা শাহজাহান মুঘল সাম্রাজ্যের মসনদে বসেন।
সম্রাট জাহাঙ্গীরের সমাধিসৌধ (১৮৭০ সালে তোলা ছবি)
সম্রাট জাহাঙ্গীরের সমাধী সম্রাট জাহাঙ্গীর শাসনামলে সংগঠিত উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ-
Siege of Kandahar (1605–1606) (Mughal victory)
Mughal–Safavid War-1 (1622–1623) (Safavid victory, Kandahar falls to Safavid Iran)

YOUR NAMEAbout Me
আসসালামু আলাইকুম। নবীন বাংলা ব্লগ সাইটে ভিজিট করার জন্য আপনাকে স্বাগতম। আসলে এই ব্লগ সাইটটি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। এবং আমি এই সাইটের এডমিন, মূলত ব্লগিং প্রাকটিস এবং মুক্ত জ্ঞাণ চর্চার জন্যই এই সাইটটি ওপেন করেছি। আমার সাইটের পোস্টগুলো অন্যান্য সুনাম খ্যাত ব্লগ সাইটে সমূহে পাবলিশ করে থাকি তথারুপ টেকটিউন্স, টিউনারপেইজ। ইনশাআল্লাহ যতদিন বেঁচে থাকব নবীন বাংলা ব্লগে লেখালেখি করার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। এখানে অন্যান্য লেখকদের বাছাই করা পোস্টগুলো পাবলিশ করা হয়। এবং ইচ্ছা করলে আপনিও এই ব্লগের অতিথি লেখক হিসাবে শুরু করতে পারেন।পরিশেষে আমার সাইট কিংবা প্রকাশিত লেখা সম্পর্কে কোন আপনাদের অভিযোগ, মতামত, পরামর্শ থাকলে তা সাদরে গ্রহন করা হবে। আবারো ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা সবাইকে!!
Follow : | | Facebook | Twitter

Post a Comment

 
Top