(সচলায়তন ব্লগ হতে সংগৃহিত)
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অণু এলো যেবার আমার এখানে, ওর সাথে রোম গিয়েছিলাম বেড়াতে। তাঁর আগে দেশ থেকে প্রথম ইটালিতে এলাম যখন, রোমের মাটিতে এই বান্দার পা ভিড়েছিল বটে কিন্তু এয়ারপোর্ট থেকে ছাড়া পাইনি। আরেকটি প্লেনে করে রোম থেকে বোলোনিয়া চলে এসেছিলাম। তো অণুর সাথে কণকণে শীতের মধ্যে রোম ভ্রমন ছিল এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা।কোলোসিয়ামের ভেতরে ঢুকে অণু কিসব ভিডিও টিডিও করা শুরু করল আর আমাকে ক্যামেরার সামনে দাঁড় করিয়ে অল্পবিস্তর কিছুমিছু বলতে বলল, আমি নাদান পাবলিক ওর এহেন অত্যাচারে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম খুব, তবে ওর সাথে সিস্টিন চ্যাপেল দেখতে গিয়ে চোখ সত্যিই ছানাবড়া হয়েছিলো, ভ্যাটিকান সিটি যাবার পথে টিকেট না কাটার অপরাধ হিসেবে ষাট ইউরো অর্থদণ্ড দেয়াটা ভুলতে পারিনি আজ অব্ধি!এর পরে বিভিন্ন কাজে আড়াই হাজার বছরের এই তিলোত্তমা নগরীতে যাওয়া হয়েছে ঠিকই কিন্তু মনের সুখে রোম দেখা হয়নি। দেখতে দেখতে ইটালিতে চার বছর কেটে গেল অথচ রোম তৃপ্তি সহকারে আর দেখা হলনা, এর মাঝে যে একটু সময় করে রোমে গিয়ে ছবিটবি তুলবো, তাও হয়ে উঠলনা।বোলোনিয়া থেকে রোম যাওয়া আসার খরচ নেহাত কম নয়, ওই খরচে ইউরোপের যে কোনও বড় শহরে দিব্যি ঘুরে আসা যায়, এই দুশ্চিন্তা থেকে আরও যাওয়া হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এইবার কি হল, হঠাৎই একটা ছুটি পেয়ে যাওয়াতে তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্তে রোম যাওয়া হয়ে গেল।এরই মাঝে দেশে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে শাহবাগ সহ পুরো দেশ উত্তাল হয়ে উঠেছে, সব মনোযোগ তখন সেদিকেই, তারপরেও রোম যাবার সুযোগটা আর হাতছাড়া করতে ইচ্ছে করলনা।
রোম আসলে দুই তিন দিনে দেখে শেষ করা সম্ভব নয়, কেউ একজন বলেছেন সারাজীবনেও নাকি সম্ভব নয়।রোম বিশাল নগরী, এর প্রতিটি গলির খানা-খন্দতে প্রতিটি ভবনের আনাচে-কানাচে রয়েছে সভ্যতার বিকাশের কথামালা, ষড়যন্ত্র-রক্তপাত-রাজতন্ত্র- গণতন্ত্রের ইতিহাস আর কলাজগতের শ্রেষ্ঠ সব উদাহরণ।যেহেতু আমার হাতে আছে দুইদিন, কাজেই আগে থেকেই নেট ঘেঁটে ঘেঁটে ঠিক করে নিয়েছি কি কি দেখবো।এই তালিকায় কোলোসিয়াম আর ভ্যাটিকান সিটির অভ্যন্তর না থাকলেও রয়েছে নানান পিয়াজ্জা, নানান প্রাচীন সড়ক, ভবন, জাদুঘর, স্তম্ভ এবং গির্জা।ইটালির দ্রুতগামী ট্রেনে আড়াই ঘণ্টায় সহজেই বোলোনিয়া থেকে রোম পৌঁছে গেলাম। আড়াইশো ইউরো বাজেট, দুই দিন এক রাত্রি থাকা হবে।সাথে মানচিত্র আগে থেকেই প্রিন্ট করে নিয়েছি। স্টেশনের পাশের হোটেলগুলি তুলনামূলক সস্তা, কাজেই ট্রেন থেকে সকাল নটায় বেরিয়ে হোটেলে পৌঁছে বেরিয়ে পড়লাম রোমের পথে। আগে থেকেই ঠিক করা ছিল যে প্রথমে যাব কোলোসিয়াম, ভেতরে না ঢুকে বাইরে থেকে ছবি তবি তুলবো।পকেটে কিছু টাকা, দুটো ক্যামেরা আর একটি প্রিন্টেড মানচিত্র থাকায় বেশ ফুরফুরে অবস্থায় ঘুরতে লাগলাম কোলোসিয়াম এর সামনের প্রখ্যাত চওড়া রাস্তায়।হঠাৎই চোখে পড়ল একটি টুরিস্ট বুথ।সেখানে ঢুকে দেখলাম এক ধরনের রোমা পাস পাওয়া যাচ্ছে ত্রিশ ইউরোতে, তিন দিনের জন্য সকল পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ফ্রি, তিনটি জাদুঘর এবং কোলোসিয়াম ও রোমান ফোরামের ভেতরে প্রবেশ ফ্রি।আর যায় কোথায়, পড়িমরি করে রোমা পাস কিনে আবার হাঁটা ধরলাম।
তো মোটামুটি ২৫০ ইউরো বাজেটে ( বোলোনিয়া থেকে রোম আসাযাওয়া ১২০ ইউরো এবং ৩০ ইউরো ব্যায়ে সিটি পাস এর ভেতর অন্তর্ভুক্ত) এক রাত্রি হোটেল যাপন এবং পুরো দুইদিন ঘুরাঘুরি প্লাস খাওয়া দাওয়া করে কি কি দেখা হল তার সচিত্র একটি বিবরণ দেয়া যাক।
প্রথমে সিটি পাস টা দেখে নিই।হাতে অল্প সময় কিন্তু দেখার ইচ্ছে রোমের অনেক দর্শনীয় স্থান- এমন ক্ষেত্রে এই পাসের বিকল্প নেই।এই পাস একখানা এ্যালবামের মতন, ভেতরে দুর্দান্ত একটি মানচিত্র, একটা মেট্রো কার্ড। আমি হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হবার চাইতে মেট্রো ট্রেনে করে ঘুরে অনেক স্বাচ্ছন্দ্য পেলাম। সুযোগ বুঝে বাসেও ফ্রি চড়া হল অনেক।কোলোসিয়ামের ভেতরে ঢুকতে আর রোমান ফোরাম দেখতে গেলেই ২৫ ইউরো এমনিই চলে যায়, তাই ৩০ ইউরোর পাসটা আসলেই কাজে দিয়েছে বেশ।
প্রথম গন্তব্যটা ছিল কোলোসিয়ামের চারিধার।মেট্রো ধরে হাজির হলাম স্টেশন থেকে সোজা কোলোসিয়ামে। এর আশেপাশে প্রাচীন সব রোমান কীর্তি, ছোট বড় নানান মাপের নানান আকৃতির ভবন, কলাম, চার্চ, মার্কেট, মূর্তি।প্রথমে ছবি তোলা বাদ দিয়ে শুধু দেখে নিলাম রোম নগরীর এই প্রাচীন অংশটি যেখান থেকে পুরো ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল এক সময় শাসিত হয়েছিল।এখানে দেখলাম দুই ভারতীয় ধ্যান মগ্ন সন্ত।বেশ অভিনব তাঁদের আসন।
এরপরে কোলোসিয়াম থেকে চলে এলাম পান্থিয়ন।এটা যদিও আমার প্রথম পান্থিয়ন দর্শন নয়, এর আগে এর ঠিক সামনেই একটি হোটেলে সেমিনারের উদ্দেশে থাকা হয়েছিল দুই রাত্রি। তবে কি যেন এক জাদু আছে খৃষ্টাব্দ ১২৬ সালে নির্মিত এই প্রাচীন ভবনের!এর নির্মাণ শৈলী যে খুবই নয়ন মনোহর সেটা তো বলার অপেক্ষাই রাখেনা।এর মাথাটা ডোমের মতন যার মাঝখানে একটা গোল অংশ ফাঁকা।এই ফাঁকা অংশ দিয়ে যখন রোদ এসে ঢোকে ভবনের ভেতরে, কেমন অদ্ভুত লাগে! আবার ভেতরে অসাধারণ সব কারুকাজ। ই ভবন না দেখলে আমার রোম ভ্রমন অসম্পূর্ণই থেকে যায়।
পান্থিয়নের এক ব্লক দূরত্বে একটি গির্জা দেখার শখ আমার অনেক দিনের, কিন্তু দেখা হয়নি কখনও।এটির নাম সান্তা মারিয়া সোপরা মিনেরভা।এই গির্জাটির নির্মাণ কাল ১৩৭০। আমি যে কারণে খুব আগ্রহী ছিলাম তা হল এর ইন্টেরিয়র।এত সুন্দর নীল রঙের সিলিং সমৃদ্ধ গির্জা পুরো ইটালিতে আমি একটিও দেখিনি।বাইরে থেকে দেখলে এই গির্জাকে খুব সাধারণ মনে হয়, তবে ভেতরটা অবিশ্বাস্য রকম বর্ণীল।মূল গির্জার প্রবেশদ্বারের সামনে বাইরেও গির্জার সম্মুখে একটি ভাস্কর্য রয়েছে যা বের্নিনি নির্মাণ করেছিলেন।ভাস্কর্যটি হল হাতির পিঠে একটি অবেলিস্ক।শোনা যায় এই অবেলিস্ক মিশর থেকে নিয়ে আসা হয়েছিলো। এমন অদ্ভুত ভাস্কর্য নাকি এই শহরে আর একটিও নেই! গির্জার ভেতর মিকেল এঞ্জেলোর একটি ভাস্কর্য আছে যেটা আমার মিস হয়ে গেছে। আফসুস!
পিয়াজ্জা নাভোনা একটি অনন্য দর্শনীয় স্থান।এর ঠিক মাঝখানে একটি ঝর্না যার নাম ফন্তানা দি কোয়াত্রো ফিউমি।এই ঝর্ণা পৃথিবীর চারটি মহাদেশের চারটি নদীকে নির্দেশ করে।নাইল, দানিউব, গঙ্গা এবং রিও দেলা প্লাতা। এই ঝর্নার মাঝখানে একটি দীর্ঘদেহী কলাম, কলামের নিচে অনেকগুলি ভাস্কর্য। অনেক বিকিকিনির জোয়ার দেখলাম সেখানে।নানান ধরণের পেইন্টিং, ছবি আঁকাআঁকি চলছে।
পিয়াজ্জা নাভোনা দেখার পরই মোটামুটি দুপুর গড়িয়ে গেল। সেখান থেকে গেলাম কাম্পো দি ফিওরি নামক একটি খোলা ময়দানে যা জনপ্রিয় একটি বাজার হিসেবে খ্যাত। সেখানে প্রচণ্ড ভিড়ে হাঁটাই মুশকিল। তারপরেও ভিড় ঠেলে একটু ছবি তুলে নিলাম।
সেখানেই একটা দোকানে পিজ্জা খেয়ে রওনা দিলাম সেন্ট পিটার’স বাসিলিকার উদ্দেশে। বাসিলিকা পৌঁছার পর ওখান থেকে হেঁটে এলাম তিবের নদীর তীরে অবস্থিত হাদ্রিয়ানের মুসোলিয়ামে যা “কাস্তেল সান্ত এঞ্জেলো” নামে অধিক পরিচিত।দুর্গটির আকৃতি সিলিন্ডারের মতন।পুরোটাই একটি জাদুঘর।জানতাম এই দুর্গের মাথায় উঠলে রোমের একটা চমৎকার দৃশ্য দেখা যাবে।হতাশ হলাম না।রোমা পাস ছিল, টিকেট কাটতে হলনা তাই (প্রবেশ মূল্য ১২ ইউরো)। রোমান সম্রাট হাদ্রিয়ানের নামাঙ্কিত এই দুর্গের নির্মাণ কাল খ্রিস্টাব্দ ১২৩ থেকে ১৩৯।তিবের নদীর ওপর একটি ব্রিজ দ্বারা রোম নগরীর সাথে এটি যুক্ত। ব্রিজটির দুই পাশেই নানান দেব দেবীর অপূর্ব সব মূর্তির স্থাপনা রয়েছে।এই দেবদেবীর মূর্তিগুলিও বের্নিনি নির্মাণ করেছিলেন।
আমি সেন্ট পিটার’স বাসিলিকার সন্ধ্যাকালীন ছবি তুলতে চেয়েছিলাম, এইজন্যে অপেক্ষাও করেছি অনেক।অবশেষে তুলেও ফেলেছি এক খানা।এর আগে অণুর সাথে এই গির্জার ভেতরে গিয়েছিলাম, দেখেছিলাম মিকেল এঞ্জেলোর অসাধারণ “লা পিয়েতা।” তবে এবার শনিবারে এত লম্বা লাইন দেখলাম যে ভেতরে যাবার আর সাহস হলনা।
সেন্ট পিটার’স থেকে চলে এলাম পিয়াজ্জা দেল্লা রিপাব্লিকায়।এখানে রয়েছে অসাধারণ একটি ঝর্ণা যার ঠিক পেছনেই রোমের সবচাইতে বিখ্যাত গির্জার একটি সান্তা মারিয়া।রাতের আলোয় ঝর্ণাটি অপূর্ব লাগলো।
সেখান থেকে এলাম পিয়াজ্জা দি এস্পানিয়ায়।রোমান হলিডে চলচ্চিত্রের শুটিং এই জায়গাটির জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে অনেক।তবে এটি মূলত ১৩৫ টি সিঁড়ি সম্বলিত একটি প্রাচীন গির্জা আর এর তলদেশে একটি সুন্দর ঝর্ণা রয়েছে।আমি যখন গিয়েছি তখন ঝর্ণাটির মেরামত চলার কারণে চারদিক ঘেরা দেখলাম। এখানে তরুণ তরুণীদের সমাগম দেখলাম রাত্রিতে।ওপর থেকে নাকি রোমের চমৎকার দৃশ্য দেখা যায়! তবে ক্লান্ত আমি আর সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে চাইলাম না।পরে শুনলাম এর সাথে লাগোয়া একটি ভবনে ইংরেজ কবি জন কিটস তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন আর এখন যেটি একটি জাদুঘর। তবে অন্ধকারে ভালো করে কিছু চোখে পড়লোনা।

Post a Comment