(মূল লেখক: তারেক-অনু, সচালয়তন ব্লগ)
হিমশীতল উচ্চতায় আন্দেজের ধূসর সন্ধ্যায় পুনো শহরের পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথের বাঁকে প্রথম বারের মত দৃষ্টিসীমায় আবির্ভাব ঘটল টিটিকাকা হ্রদের। সাগর পৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাড়ে বার হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত বিশ্বের উচ্চতম বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহৃত এই হ্রদ দক্ষিণ আমেরিকার বৃহত্তম হ্রদতো বটেই সেই সাথে আমাদের গ্রহের ২১তম বৃহত্তম।
বিশাল তার ব্যপ্তি, যে এবড়ো-থেবড়ো পাহাড় ঘুরে আমরা সবেগে নিচের দিকে চলেছি তার পাদদেশ থেকে শুরু করে দূরের আন্দেজের সুমহান তুষার ছাওয়া আকাশছোঁয়া পর্বতমালার প্রান্তসীমা পর্যন্ত তার অস্তিত্ব সেই মেঘময় গোধূলিতেও স্পষ্ট বোঝা গেল।
আমাদের আপাত গন্তব্য পেরুর পুনো শহর, ৩৮৬০ মিটার (১২,৪২১ ফিট) উচ্চতায় অক্সিজেনের বেশ ঘাটতি, গত কদিন ধরেই সমানে আমরা তিন বন্ধু ( বাকি দুজন মেক্সিকান ইসায়াস সেরণা এবং হুয়ান ভিদাল) আন্দেজ পর্বতমালার এই কম অক্সিজেনের রাজত্বে খাপ খাওয়ানোর জন্য সমানে কোঁকা পাতা চিবুচ্ছি । পেরুতে পা দেবার আগেই আমাদের সুহৃদরা বলে দিয়েছিল প্রচুর পরিমাণে কোঁকা পাতায় ব্যাগ বোঝাই করতে, আর সুযোগ পাওয়া মাত্রই মুখে চালান করতে( তবে কেবল চিবানোর জন্য, গিলে ফেলার জন্য নয় )। এই পাতার নির্যাস রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়াতে অতি কার্যকরী, যা এত পাতলা বাতাসে টিকে থাকতে অপরিহার্য। সেই সাথে যাত্রাবিরতিতে চলছে কোঁকা চা, ইসায়াসতো এক ইনকা গ্রামের শামানের কাছ থেকে কোঁকা লিকার পর্যন্ত জোগাড় করে আনল, যদিও সেই সোমরস মাথা ব্যাথা তাড়াতে কোন ভূমিকাই রাখতে পারে নি ! সাধে কি আর ইনকা সাম্রাজ্যে কোঁকা পাতার মূল্য সোনা- রূপার চেয়ে বেশী ছিল ! অবশ্য উচ্চতাজনিত অসুস্থতার কারণে মাথা ব্যাথায় এযাত্রা আক্রান্ত হয়েছিল কেবল হুয়ান ভিদাল। যাই হোক, হোটেল ব্যাগবোঁচকা রেখে প্রথমেই ঠিক করতে যাওয়া হল পরদিনের গন্তব্যে পৌঁছানোর উপায়- গন্তব্য এই বিশাল হ্রদের মাঝেই!
হ্যাঁ, এই বিশাল জলসীমার মাঝেই, তবে কেবল নৌবিহার নয়, টিটিকাকার মাঝে অবস্থিত মানবসৃষ্ট নলখাগড়ার তৈরি কিছু ভাসমান দ্বীপে, যেখানে আদিম পদ্ধতিতে এখনো বসবাস করে আদিবাসী সম্প্রদায়রা! আমাদের যাত্রাতো কাল ভোরে, চলুন তার আগে শুনি সেই ভাসমান দ্বীপের কাহিনী-
আসলে আমাদের যাত্রা ছিল ইনকাদের প্রাচীন রাজধানী কুজকো থেকে সরাসরি বিমানে বলিভিয়ার রাজধানী লাপাজ, কিন্তু এই অপূর্ব হ্রদ আর সেই ভাসমান দ্বীপের অধিবাসীদের একবার চর্মচক্ষে দেখার জন্যই নিস্ফলা মস্তিষ্ক কুবুদ্ধি জোগাল- কুজকো থেকে ১০টি ঘণ্টা বাসে করে পুনো চলে যাও না বাপু, সেখানে টিটিকাকা দর্শন সেরে আরো ঘণ্টা ছয়েক গাড়ির চাকায়, না হয় রিকশায় চেপে, না হয় লামার পিঠে কষ্ট করে বসলেই তো সেই লাপাজই পৌঁছাবে, মাঝখান থেকে এই তীর্থ দর্শনটাও হয়ে গেল! ব্যস, এই উচাটন কুবুদ্ধি আমরা গিলে ফেললাম ক্ষুধাক্রান্ত হাঙরের মত, এখন বসে খাবি খাচ্ছি এই বিচ্ছিরি পাতলা বাতাসে!
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় ৫৮,০০০ বর্গ কিলোমিটারের এই জলক্ষেত্রের উর্বর তীরে অনেক জাতিরই বসত গড়ে উঠেছিল পেরু এবং বলিভিয়ার ভূখণ্ডে। তার মধ্যে কিছু গোত্র কোন সময়ই প্রবল প্রতাপশালী ইনকাদের বশ্যতা স্বীকার করে নি, ফলে প্রায়শই লেগে থাকত সংঘর্ষ , শক্তিশালী ইনকাদের বারংবার আক্রমণে টিকতে না পেরে এক কার্যকরী বুদ্ধি আবিস্কার করে অন্যান্য রেড ইন্ডিয়ান গোত্র- জলযান! এরপর থেকে আক্রমণের আভাস পেলেই তারা বিশাল ভেলা বা জাহাজে করে হ্রদের মাঝে চলে যেত, হানাদার ইনকারা জলসীমায় আক্রমণের ব্যাপারে ছিল চরম অপটু। কাজেই এক পর্যায়ে কিছু রেড ইন্ডিয়ান গোত্র পাকাপাকি ভাবেই জলের উপর আক্রমণমুক্ত ভাসমান জীবন বেছে নেই, তাদেরই কিছু বংশধর এখনো সেই জীবনযাপন করে চলেছে। এই ভাসমান দ্বীপদের বলা হয় উরোস।
পরদিন সকালে ভুট্টার রুটি আর নানা গাছপাকা ফলের ফলাহার শেষ করেই রওনা হয়ে গেলাম আগের রাতে ঠিক করে রাখা গাইডের সাথে। হ্রদের কিনারেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল আধুনিক জলযান, সেখানে নানা দেশের নানা জাতির পর্যটকদের ভিড়। ইঞ্জিন চালু হবার প্রায় সাথে সাথেই শুরু হয়ে গেল গাইডের বিশাল ফিরিস্তি, কিছু ঐতিহাসিক সত্য, কিছু জনপ্রিয় বিশ্বাস আর কিছু বা মনগড়া! মিনিট দশেক পরে তার বয়ানের ঠেলা থেকে রেহাই পেতে এবং অপূর্ব এই জলাভূমিকে উপভোগের আশায় চলে এলাম ছাদের উপরে, খানিকপরেই দেখি যাত্রীদের অধিকাংশই আমার সঙ্গী!
সে এক অন্য ভুবন, দূর দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে লালচে ইটের পুনো শহর, চারধারে ভিড় বাড়ছে নলখাগড়ার দলের, থেকে থেকেই দেখা মিলছে স্থানীয় রেড ইন্ডিয়ান কোন বালক বা চওড়া টুপি পরা রমণীর , যারা নিপুন অভিজ্ঞ হাতে নৌকা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেই জলজ উদ্ভিদের দঙ্গলের মাঝেই জীবিকার তাগিদে।
পাখির কলকাকলির সাড়া মিলছে সর্বক্ষণই, যাদের কিছু আন্দেজের বুকের বাসিন্দা।
অবশেষে ঘণ্টাখানেক নলখাগড়ার দঙ্গল পেরোবার পর দূরে কিছু সোনালি কুটিরের আভাস মিলল, কোন কোন বাড়ি থেকে উঠছে ধোঁয়া, স্বপ্নের মত সাজানো গোছানো গ্রাম একটি, কিন্তু জলের উপরে!
কোন কোনটা থেকে ভেসে আসছে রূপকথার ময়ূরকণ্ঠী নাওয়ের মত অপূর্ব কিছু নৌকা আর প্রতিটি গ্রামের সামনেই রঙ ঝলমলে পোশাক পরে ঐতিহ্যবাহী সাজে স্থানীয় মহিলারা।
জানা গেল এখানে প্রায় পঞ্চাশটার মত গ্রাম আছে, প্রতি গ্রামেই আছে একজন মোড়ল। সেই সাথে এই এলাকার গ্রামের অধিবাসিরা কেচোয়া ভাষায় কথা বলে থাকে, আবার কোন কোন দ্বীপের বাসিন্দারা কথা বলে আইমারা ভাষায়। এখন পর্যন্ত আমরা পেরুর জলসীমানায় আছি, টিটিকাকা হ্রদের প্রায় ৬০ % পেরুর অন্তর্গত, বাকি ৪০ % বলিভিয়ার, সেখানে আবার রেড ইন্ডিয়ানরা স্থায়ী দ্বীপে বসবাস, চাষাবাদ সবই করে থাকে।
এমনই এক গ্রামে ভিড়ল আমাদের ইঞ্জিনের নৌকা, খুব সমাদর করে সবার সাথে হাত মিলিয়ে এক কুঁড়ের সামনে গোল করে বসতে বললেন মোড়ল। তার নিজের ভাষায় জানালেন তাদের ইতিহাস, প্রাচীন বিশ্বাস, লোকজ সংস্কৃতি, খাদ্যাভাস, যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে, গাইড সেখান থেকে ইংরেজিতে বলে গেল আমাদের জন্য। সেই সাথে হাতে কলমে আমাদের দেখালেন সেই তোতোরা নামের জাদুর নলখাগড়া, যাকে বিশেষ পদ্ধতিতে বেশ কয় স্তরে বেঁধে একেবারে শতভাগ জলনিরোধক প্লাটফর্ম তৈরি করা হয়, এরপরে এমন অসংখ্য ছোট ছোট খণ্ড একত্রে বেঁধে চলনসই আকারের দ্বীপ নির্মিত হয়। এরপরে আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা, কুটির স্থাপন ইত্যাদি শেষ হলে তা সুবিধামত স্থানে নিয়ে গিয়ে নোঙর ফেলে সেখানেই রাখা হয় আপাতত, আবার কোন সময় যুদ্ধবিগ্রহ দেখা দিলে যেন নোঙর তুলে গোটা দ্বীপ সরিয়ে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা থাকে!
সেই সাথে আমাদের প্রত্যেকের হাতে একটি করে তোতোরা দিয়ে গোঁড়ার দিকটা অনেকটা ইক্ষুর মত ছিলে খেতে বললেন, খানিকটা পানসে হলেও খাওয়া চলে! আবার এই নলখাগড়া দিয়ে কপালে ব্যান্ডেজের মত জলপট্টি দেয় স্থানীয়রা জ্বর আসলে, মানে এর ভেষজ গুণও বর্তমান!
প্রতিটি গ্রামের মাঝে একটি করে ফাঁকা জায়গা, সেখানে হ্রদের টলটলে জল দেখা যায়, এক ধরনের জাল দিয়ে ঘেরা। জিজ্ঞেস করতেই জানা গেল এই তাদের জীবন্ত খাদ্য ভাণ্ডার, মাছের আড়ৎ! মানে মাছ ধরে জিইয়ে রাখা হয়, পরে ইচ্ছে মত রান্না চলে।
তাদের খাবার হিসেবে কিছু শুকনো মাছ আর পাখির ডিমও দেখা গেল।
শুনেছিলাম বিশ্বের সবচেয়ে বৃহদাকৃতির মিঠা পানির ব্যাঙ Telmatobius culeus কেবলমাত্র এই হ্রদেই থাকে, যার চামড়া শরীরের তুলনায় অনেক বড় কারণ চামড়া দিয়েই তার শ্বাসপ্রশ্বাস চালাতে হয়! কিন্তু তার দেখা মিলল না, মানুষের লোভের ও বোকামির স্বীকার হয়ে হ্রদে ছাড়া নতুন দ্রুত বর্ধনশীল মাছেদের দৌরাত্মে সেই অতিবিরল প্লবগ আজ নিজভূমে পরবাসী।
বিখ্যাত নল খাগড়ার নৌকার দেখা মিলল অবশেষে, জানা যায় অন্তত তিন হাজার বছর ধরেই এমন নৌকার ব্যবস্থা চালু ছিল এই অঞ্চলে, অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে প্রায় একই ধরনের নৌকার চল ছিল মিশরের নীলনদে, সেগুলো ছিল প্যাপিরাসের তৈরি। অভিযাত্রীথর হেয়ারডালতো প্যাপিরাসের তৈরি নৌকা ২য়-রা নিয়ে অতলান্তিক মহাসাগর পর্যন্ত পাড়ি দিলেন তার তত্ত্ব প্রমাণের আশায় যে কুয়াশা ঢাকা অতীতে এই দুই মহাদেশের নানা সভ্যতার মাঝে যোগাযোগ ঘটেছিল!
খানিক পরেই গাইড প্রস্তাব দিল আমরা চাইলে সামান্য অর্থের বিনিময়ে এমন নৌকায় চেপে মিনিট চল্লিশেক ঘোরাঘুরি করে অন্য দ্বীপে যেতে পারি! এ তো সোনায় সোহাগা, এমন সুযোগ কি জীবনে ২য়বার আসে!
তরতর করে নৌকা চলল চকচকে জল চিরে অন্য গ্রামের দিকে। হঠাৎই মনে পড়ল অনেক পুরনো এক ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকার মলাটে ছবি দেখে ছিলাম এর চেয়ে ছোট এক নৌকায় একজন রেড ইন্ডিয়ান পুরোহিত একটি জ্যান্ত লামা নিয়ে চলেছেন! কিন্তু এখানের কোন গ্রামেই তো এমন কোন গৃহপালিত জন্তু চোখে পড়ল না! এই ব্যাপারে প্রশ্ন করতেই উম্মোচিত হল টিটিকাকার হ্রদের আরেক রহস্য! বিশেষ বছরে বিশেষ দিনক্ষণ বিচার করে সেই লামার রক্ত নৈবদ্য দেওয়া হত হ্রদের দেবতাদের, সেই নৌকা করে পুরোহিত পবিত্র এলাকায় যেয়ে বিশেষ ভঙ্গীতে ছুরি চালাত নিরীহ লামার গলায়, যেন অধিকাংশ রক্তই হ্রদের জলে পড়ে! কিন্তু সেই লামার মাংস! উত্তরে হে হে করে হেসে চোখ টিপে গাইড জানাল রক্ত দেবতার কিন্তু মাংস জনগণের, মানে ভুরিভোজের কাজে ব্যবহৃত হয়!
অপর গ্রামটিও একটি ধাঁচের, সেখানের মহিলারা কেবলমাত্র তাদের হাতে তৈরি চমৎকার সব পণ্য সাজিয়ে বসেছেন, রঙধনুর সাত রঙ যেন ঠাই নিয়েছে তাদের পরনের পোশাকে আর নির্মিত দ্রব্যে।
এইখানেও চোখে পড়ল সৌর বিদ্যুৎ তৈরির ব্যবস্থা! পেরু সরকার নাকি বছর পনের আগে এই সৌরপ্যানেলগুলী উপহার হিসেবে দিয়েছে। এমনকি এই গ্রামের সর্দারের ঘরে তো টেলিভিশন পর্যন্ত দেখলাম!
দুরন্ত স্বাস্থ্যবান শিশুদের চোখে পড়ল সর্বদাই, ওদের দেখিয়ে মোড়ল দুঃখী দুঃখী গলায় বললেন, আমরাই হয়ত এমন আদি জীবন ধারায় বসবাসরত শেষ প্রজন্ম, আমাদের শিশুরা চায় ডাঙ্গায় নামতে, শহরবাসী হতে, এই বিশাল টিটিকাকার বাইরেও যে বিশালতর জগৎ আছে সেটিকে জানতে।
দেখতে দেখতে বিদায়ের সময় হয়ে এল, আমাদের অবাক করে তিন জন রেড ইন্ডিয়ান রমণী অদ্ভুত সুরেলা গলায় বিদায় সঙ্গীত শুরু করলেন নাচের তালে তালে,
মনে পড়ে গেল চাবাগানের গান, একই সুর, যেন একই কথা! প্রকৃতির সন্তানেরা বুঝি সারা বিশ্বে একই ভাবে চিন্তা করে! ফেরার পথে কানের পর্দায় সারাক্ষণই বেজে গেলে সেই অপূর্ব সুরলহরী।
( সতর্কীকরণ- কয়েকজন ভ্রমণবিদ বন্ধু জানিয়েছেন, রেড ইন্ডিয়ানরা ইনকাদের কাছ থেকে রক্ষা পাবার জন্য জাহাজ ব্যবহার করত বটে, কিন্তু এই ধরনের দ্বীপের ব্যবহার ছিল কিনা কেউ বলতে পারে না। তারা জানাল, পেরু সরকার পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য স্থানীয়দের দ্বারা এই ব্যবস্থা হাতে নিয়ে ছিল বেশ ক বছর আগে এবং তা প্রচণ্ড ভাবে সফল! যদিও, কাদের দাবী ঠিক তা আমার জানা নেই )
হিমশীতল উচ্চতায় আন্দেজের ধূসর সন্ধ্যায় পুনো শহরের পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথের বাঁকে প্রথম বারের মত দৃষ্টিসীমায় আবির্ভাব ঘটল টিটিকাকা হ্রদের। সাগর পৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাড়ে বার হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত বিশ্বের উচ্চতম বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহৃত এই হ্রদ দক্ষিণ আমেরিকার বৃহত্তম হ্রদতো বটেই সেই সাথে আমাদের গ্রহের ২১তম বৃহত্তম।
বিশাল তার ব্যপ্তি, যে এবড়ো-থেবড়ো পাহাড় ঘুরে আমরা সবেগে নিচের দিকে চলেছি তার পাদদেশ থেকে শুরু করে দূরের আন্দেজের সুমহান তুষার ছাওয়া আকাশছোঁয়া পর্বতমালার প্রান্তসীমা পর্যন্ত তার অস্তিত্ব সেই মেঘময় গোধূলিতেও স্পষ্ট বোঝা গেল।
আমাদের আপাত গন্তব্য পেরুর পুনো শহর, ৩৮৬০ মিটার (১২,৪২১ ফিট) উচ্চতায় অক্সিজেনের বেশ ঘাটতি, গত কদিন ধরেই সমানে আমরা তিন বন্ধু ( বাকি দুজন মেক্সিকান ইসায়াস সেরণা এবং হুয়ান ভিদাল) আন্দেজ পর্বতমালার এই কম অক্সিজেনের রাজত্বে খাপ খাওয়ানোর জন্য সমানে কোঁকা পাতা চিবুচ্ছি । পেরুতে পা দেবার আগেই আমাদের সুহৃদরা বলে দিয়েছিল প্রচুর পরিমাণে কোঁকা পাতায় ব্যাগ বোঝাই করতে, আর সুযোগ পাওয়া মাত্রই মুখে চালান করতে( তবে কেবল চিবানোর জন্য, গিলে ফেলার জন্য নয় )। এই পাতার নির্যাস রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়াতে অতি কার্যকরী, যা এত পাতলা বাতাসে টিকে থাকতে অপরিহার্য। সেই সাথে যাত্রাবিরতিতে চলছে কোঁকা চা, ইসায়াসতো এক ইনকা গ্রামের শামানের কাছ থেকে কোঁকা লিকার পর্যন্ত জোগাড় করে আনল, যদিও সেই সোমরস মাথা ব্যাথা তাড়াতে কোন ভূমিকাই রাখতে পারে নি ! সাধে কি আর ইনকা সাম্রাজ্যে কোঁকা পাতার মূল্য সোনা- রূপার চেয়ে বেশী ছিল ! অবশ্য উচ্চতাজনিত অসুস্থতার কারণে মাথা ব্যাথায় এযাত্রা আক্রান্ত হয়েছিল কেবল হুয়ান ভিদাল। যাই হোক, হোটেল ব্যাগবোঁচকা রেখে প্রথমেই ঠিক করতে যাওয়া হল পরদিনের গন্তব্যে পৌঁছানোর উপায়- গন্তব্য এই বিশাল হ্রদের মাঝেই!
হ্যাঁ, এই বিশাল জলসীমার মাঝেই, তবে কেবল নৌবিহার নয়, টিটিকাকার মাঝে অবস্থিত মানবসৃষ্ট নলখাগড়ার তৈরি কিছু ভাসমান দ্বীপে, যেখানে আদিম পদ্ধতিতে এখনো বসবাস করে আদিবাসী সম্প্রদায়রা! আমাদের যাত্রাতো কাল ভোরে, চলুন তার আগে শুনি সেই ভাসমান দ্বীপের কাহিনী-
আসলে আমাদের যাত্রা ছিল ইনকাদের প্রাচীন রাজধানী কুজকো থেকে সরাসরি বিমানে বলিভিয়ার রাজধানী লাপাজ, কিন্তু এই অপূর্ব হ্রদ আর সেই ভাসমান দ্বীপের অধিবাসীদের একবার চর্মচক্ষে দেখার জন্যই নিস্ফলা মস্তিষ্ক কুবুদ্ধি জোগাল- কুজকো থেকে ১০টি ঘণ্টা বাসে করে পুনো চলে যাও না বাপু, সেখানে টিটিকাকা দর্শন সেরে আরো ঘণ্টা ছয়েক গাড়ির চাকায়, না হয় রিকশায় চেপে, না হয় লামার পিঠে কষ্ট করে বসলেই তো সেই লাপাজই পৌঁছাবে, মাঝখান থেকে এই তীর্থ দর্শনটাও হয়ে গেল! ব্যস, এই উচাটন কুবুদ্ধি আমরা গিলে ফেললাম ক্ষুধাক্রান্ত হাঙরের মত, এখন বসে খাবি খাচ্ছি এই বিচ্ছিরি পাতলা বাতাসে!
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় ৫৮,০০০ বর্গ কিলোমিটারের এই জলক্ষেত্রের উর্বর তীরে অনেক জাতিরই বসত গড়ে উঠেছিল পেরু এবং বলিভিয়ার ভূখণ্ডে। তার মধ্যে কিছু গোত্র কোন সময়ই প্রবল প্রতাপশালী ইনকাদের বশ্যতা স্বীকার করে নি, ফলে প্রায়শই লেগে থাকত সংঘর্ষ , শক্তিশালী ইনকাদের বারংবার আক্রমণে টিকতে না পেরে এক কার্যকরী বুদ্ধি আবিস্কার করে অন্যান্য রেড ইন্ডিয়ান গোত্র- জলযান! এরপর থেকে আক্রমণের আভাস পেলেই তারা বিশাল ভেলা বা জাহাজে করে হ্রদের মাঝে চলে যেত, হানাদার ইনকারা জলসীমায় আক্রমণের ব্যাপারে ছিল চরম অপটু। কাজেই এক পর্যায়ে কিছু রেড ইন্ডিয়ান গোত্র পাকাপাকি ভাবেই জলের উপর আক্রমণমুক্ত ভাসমান জীবন বেছে নেই, তাদেরই কিছু বংশধর এখনো সেই জীবনযাপন করে চলেছে। এই ভাসমান দ্বীপদের বলা হয় উরোস।
পরদিন সকালে ভুট্টার রুটি আর নানা গাছপাকা ফলের ফলাহার শেষ করেই রওনা হয়ে গেলাম আগের রাতে ঠিক করে রাখা গাইডের সাথে। হ্রদের কিনারেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল আধুনিক জলযান, সেখানে নানা দেশের নানা জাতির পর্যটকদের ভিড়। ইঞ্জিন চালু হবার প্রায় সাথে সাথেই শুরু হয়ে গেল গাইডের বিশাল ফিরিস্তি, কিছু ঐতিহাসিক সত্য, কিছু জনপ্রিয় বিশ্বাস আর কিছু বা মনগড়া! মিনিট দশেক পরে তার বয়ানের ঠেলা থেকে রেহাই পেতে এবং অপূর্ব এই জলাভূমিকে উপভোগের আশায় চলে এলাম ছাদের উপরে, খানিকপরেই দেখি যাত্রীদের অধিকাংশই আমার সঙ্গী!
সে এক অন্য ভুবন, দূর দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে লালচে ইটের পুনো শহর, চারধারে ভিড় বাড়ছে নলখাগড়ার দলের, থেকে থেকেই দেখা মিলছে স্থানীয় রেড ইন্ডিয়ান কোন বালক বা চওড়া টুপি পরা রমণীর , যারা নিপুন অভিজ্ঞ হাতে নৌকা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেই জলজ উদ্ভিদের দঙ্গলের মাঝেই জীবিকার তাগিদে।
পাখির কলকাকলির সাড়া মিলছে সর্বক্ষণই, যাদের কিছু আন্দেজের বুকের বাসিন্দা।
অবশেষে ঘণ্টাখানেক নলখাগড়ার দঙ্গল পেরোবার পর দূরে কিছু সোনালি কুটিরের আভাস মিলল, কোন কোন বাড়ি থেকে উঠছে ধোঁয়া, স্বপ্নের মত সাজানো গোছানো গ্রাম একটি, কিন্তু জলের উপরে!
কোন কোনটা থেকে ভেসে আসছে রূপকথার ময়ূরকণ্ঠী নাওয়ের মত অপূর্ব কিছু নৌকা আর প্রতিটি গ্রামের সামনেই রঙ ঝলমলে পোশাক পরে ঐতিহ্যবাহী সাজে স্থানীয় মহিলারা।
জানা গেল এখানে প্রায় পঞ্চাশটার মত গ্রাম আছে, প্রতি গ্রামেই আছে একজন মোড়ল। সেই সাথে এই এলাকার গ্রামের অধিবাসিরা কেচোয়া ভাষায় কথা বলে থাকে, আবার কোন কোন দ্বীপের বাসিন্দারা কথা বলে আইমারা ভাষায়। এখন পর্যন্ত আমরা পেরুর জলসীমানায় আছি, টিটিকাকা হ্রদের প্রায় ৬০ % পেরুর অন্তর্গত, বাকি ৪০ % বলিভিয়ার, সেখানে আবার রেড ইন্ডিয়ানরা স্থায়ী দ্বীপে বসবাস, চাষাবাদ সবই করে থাকে।
এমনই এক গ্রামে ভিড়ল আমাদের ইঞ্জিনের নৌকা, খুব সমাদর করে সবার সাথে হাত মিলিয়ে এক কুঁড়ের সামনে গোল করে বসতে বললেন মোড়ল। তার নিজের ভাষায় জানালেন তাদের ইতিহাস, প্রাচীন বিশ্বাস, লোকজ সংস্কৃতি, খাদ্যাভাস, যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে, গাইড সেখান থেকে ইংরেজিতে বলে গেল আমাদের জন্য। সেই সাথে হাতে কলমে আমাদের দেখালেন সেই তোতোরা নামের জাদুর নলখাগড়া, যাকে বিশেষ পদ্ধতিতে বেশ কয় স্তরে বেঁধে একেবারে শতভাগ জলনিরোধক প্লাটফর্ম তৈরি করা হয়, এরপরে এমন অসংখ্য ছোট ছোট খণ্ড একত্রে বেঁধে চলনসই আকারের দ্বীপ নির্মিত হয়। এরপরে আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা, কুটির স্থাপন ইত্যাদি শেষ হলে তা সুবিধামত স্থানে নিয়ে গিয়ে নোঙর ফেলে সেখানেই রাখা হয় আপাতত, আবার কোন সময় যুদ্ধবিগ্রহ দেখা দিলে যেন নোঙর তুলে গোটা দ্বীপ সরিয়ে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা থাকে!
সেই সাথে আমাদের প্রত্যেকের হাতে একটি করে তোতোরা দিয়ে গোঁড়ার দিকটা অনেকটা ইক্ষুর মত ছিলে খেতে বললেন, খানিকটা পানসে হলেও খাওয়া চলে! আবার এই নলখাগড়া দিয়ে কপালে ব্যান্ডেজের মত জলপট্টি দেয় স্থানীয়রা জ্বর আসলে, মানে এর ভেষজ গুণও বর্তমান!
প্রতিটি গ্রামের মাঝে একটি করে ফাঁকা জায়গা, সেখানে হ্রদের টলটলে জল দেখা যায়, এক ধরনের জাল দিয়ে ঘেরা। জিজ্ঞেস করতেই জানা গেল এই তাদের জীবন্ত খাদ্য ভাণ্ডার, মাছের আড়ৎ! মানে মাছ ধরে জিইয়ে রাখা হয়, পরে ইচ্ছে মত রান্না চলে।
তাদের খাবার হিসেবে কিছু শুকনো মাছ আর পাখির ডিমও দেখা গেল।
শুনেছিলাম বিশ্বের সবচেয়ে বৃহদাকৃতির মিঠা পানির ব্যাঙ Telmatobius culeus কেবলমাত্র এই হ্রদেই থাকে, যার চামড়া শরীরের তুলনায় অনেক বড় কারণ চামড়া দিয়েই তার শ্বাসপ্রশ্বাস চালাতে হয়! কিন্তু তার দেখা মিলল না, মানুষের লোভের ও বোকামির স্বীকার হয়ে হ্রদে ছাড়া নতুন দ্রুত বর্ধনশীল মাছেদের দৌরাত্মে সেই অতিবিরল প্লবগ আজ নিজভূমে পরবাসী।
বিখ্যাত নল খাগড়ার নৌকার দেখা মিলল অবশেষে, জানা যায় অন্তত তিন হাজার বছর ধরেই এমন নৌকার ব্যবস্থা চালু ছিল এই অঞ্চলে, অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে প্রায় একই ধরনের নৌকার চল ছিল মিশরের নীলনদে, সেগুলো ছিল প্যাপিরাসের তৈরি। অভিযাত্রীথর হেয়ারডালতো প্যাপিরাসের তৈরি নৌকা ২য়-রা নিয়ে অতলান্তিক মহাসাগর পর্যন্ত পাড়ি দিলেন তার তত্ত্ব প্রমাণের আশায় যে কুয়াশা ঢাকা অতীতে এই দুই মহাদেশের নানা সভ্যতার মাঝে যোগাযোগ ঘটেছিল!
খানিক পরেই গাইড প্রস্তাব দিল আমরা চাইলে সামান্য অর্থের বিনিময়ে এমন নৌকায় চেপে মিনিট চল্লিশেক ঘোরাঘুরি করে অন্য দ্বীপে যেতে পারি! এ তো সোনায় সোহাগা, এমন সুযোগ কি জীবনে ২য়বার আসে!
তরতর করে নৌকা চলল চকচকে জল চিরে অন্য গ্রামের দিকে। হঠাৎই মনে পড়ল অনেক পুরনো এক ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকার মলাটে ছবি দেখে ছিলাম এর চেয়ে ছোট এক নৌকায় একজন রেড ইন্ডিয়ান পুরোহিত একটি জ্যান্ত লামা নিয়ে চলেছেন! কিন্তু এখানের কোন গ্রামেই তো এমন কোন গৃহপালিত জন্তু চোখে পড়ল না! এই ব্যাপারে প্রশ্ন করতেই উম্মোচিত হল টিটিকাকার হ্রদের আরেক রহস্য! বিশেষ বছরে বিশেষ দিনক্ষণ বিচার করে সেই লামার রক্ত নৈবদ্য দেওয়া হত হ্রদের দেবতাদের, সেই নৌকা করে পুরোহিত পবিত্র এলাকায় যেয়ে বিশেষ ভঙ্গীতে ছুরি চালাত নিরীহ লামার গলায়, যেন অধিকাংশ রক্তই হ্রদের জলে পড়ে! কিন্তু সেই লামার মাংস! উত্তরে হে হে করে হেসে চোখ টিপে গাইড জানাল রক্ত দেবতার কিন্তু মাংস জনগণের, মানে ভুরিভোজের কাজে ব্যবহৃত হয়!
অপর গ্রামটিও একটি ধাঁচের, সেখানের মহিলারা কেবলমাত্র তাদের হাতে তৈরি চমৎকার সব পণ্য সাজিয়ে বসেছেন, রঙধনুর সাত রঙ যেন ঠাই নিয়েছে তাদের পরনের পোশাকে আর নির্মিত দ্রব্যে।
এইখানেও চোখে পড়ল সৌর বিদ্যুৎ তৈরির ব্যবস্থা! পেরু সরকার নাকি বছর পনের আগে এই সৌরপ্যানেলগুলী উপহার হিসেবে দিয়েছে। এমনকি এই গ্রামের সর্দারের ঘরে তো টেলিভিশন পর্যন্ত দেখলাম!
দুরন্ত স্বাস্থ্যবান শিশুদের চোখে পড়ল সর্বদাই, ওদের দেখিয়ে মোড়ল দুঃখী দুঃখী গলায় বললেন, আমরাই হয়ত এমন আদি জীবন ধারায় বসবাসরত শেষ প্রজন্ম, আমাদের শিশুরা চায় ডাঙ্গায় নামতে, শহরবাসী হতে, এই বিশাল টিটিকাকার বাইরেও যে বিশালতর জগৎ আছে সেটিকে জানতে।
দেখতে দেখতে বিদায়ের সময় হয়ে এল, আমাদের অবাক করে তিন জন রেড ইন্ডিয়ান রমণী অদ্ভুত সুরেলা গলায় বিদায় সঙ্গীত শুরু করলেন নাচের তালে তালে,
মনে পড়ে গেল চাবাগানের গান, একই সুর, যেন একই কথা! প্রকৃতির সন্তানেরা বুঝি সারা বিশ্বে একই ভাবে চিন্তা করে! ফেরার পথে কানের পর্দায় সারাক্ষণই বেজে গেলে সেই অপূর্ব সুরলহরী।
( সতর্কীকরণ- কয়েকজন ভ্রমণবিদ বন্ধু জানিয়েছেন, রেড ইন্ডিয়ানরা ইনকাদের কাছ থেকে রক্ষা পাবার জন্য জাহাজ ব্যবহার করত বটে, কিন্তু এই ধরনের দ্বীপের ব্যবহার ছিল কিনা কেউ বলতে পারে না। তারা জানাল, পেরু সরকার পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য স্থানীয়দের দ্বারা এই ব্যবস্থা হাতে নিয়ে ছিল বেশ ক বছর আগে এবং তা প্রচণ্ড ভাবে সফল! যদিও, কাদের দাবী ঠিক তা আমার জানা নেই )
Post a Comment