0
মূল লেখার লিংক


জন্মের পর প্রথম দশ বছর কেটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ৪-৫ বছরে একটা ছোট্ট সাইকেল চালাতাম (পিছনের ২ চাকা ছাড়া) বাসার ছাদে। এরপরে ভাইয়া আর ভাইয়ার বন্ধুদের সাইকেল চুরি করে আমরা বান্ধবিরা চালিয়ে বেড়াতাম আর নষ্ট হলে চুপচাপ গিয়ে রেখে দিয়ে আসতাম। নিজের প্রথম সাইকেলটি পাই ৭ কি ৮ বছর বয়সে। তারপর আর থামায় কে। ঐ বয়সে আমরা ৩ বান্ধবি ‘ক্রস ক্যাম্পাস’ রাইড দিতাম, পূর্ব পাড়া থেকে পশ্চিম পাড়া :P। ক্যাম্পাসের হেন কোণা নেই যেখানে আমরা যাই নি। ছোটকালের সেই নানা রঙের দিনগুলি ১২ বছর পরে আবার আমার জীবনে ফিরে এলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাইক্লিং ক্লাব খোলামাত্র আমি একটি সাইকেল নিয়ে বাসায় চলে এলাম। ভাব টা এমন যে এটা আমারই সাইকেল। এই হল আমার বড় হবার পরের প্রথম সাইকেল।
প্রথমদিন বংশাল থেকে চালিয়ে উত্তরা চলে এলাম। এক বড় ভাই সাথে ছিলেন, কোন সমস্যা হয় নি, বরং বললেন আমি নাকি ভালো চালাই :P। আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাওয়াতে ঠিক তার পরের শুক্রবার-ই ‘বিডিসাইক্লিসট’ এর সাথে ‘বাইক ফ্রাইডে’ যাব ঠিক করলাম। উত্তেজনায় রাতে ঘুম ছাড়াই ভোরে রওনা দিয়ে দিলাম মানিক মিয়া এভিনিউ এর উদ্দেশ্যে। পথে বমি টমি করে একাকার অবস্থা। সাথে এক ভাই ছিলেন, বললেন প্রথমেই বেশি দূরত্বে না চালিয়ে উত্তরার মধ্যে চালাতে, তারপর অভ্যাস হয়ে গেলে দূরে চালাতে। ‘ঢাকা নর্দার্ন সাইক্লিসট(ডিএনসি)’ এর খোঁজ দিয়ে ভাই চলে গেলেন। আমি ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফেরত এলাম। ঐদিন যেতে পারলে হয়ত ডিএনসি এর সাথে চালান হত না, আর আমার জীবনের এই সুন্দর দিনগুলি আসতো না।
শুরু করলাম আমি আবার। ঐ গোলাপি ট্যাঙ্ক নিয়ে ১২-১৫ নাম্বার সেক্টরে কাদা মাটির মধ্যে চালিয়ে বেড়াতাম। পারতাম না, কিন্তু ডিএনসির কেউ কোনদিন না করে নি চালাতে। আস্তে আস্তে উত্তরার বাইরে যাওয়া শুরু করলাম ডিএনসির সাথে-ক্রিটিকাল ম্যাস, ক্যাফে সাইক্লিসটস, এমনকি ইউনিভার্সিটি তেও। তারপর একদিন রূপগঞ্জ যাওয়ায় একদিনে ৫৬ কিমি চালিয়ে ফেললাম। এরকম পর্যায়ে সবাই বলল আমার এখন একটা নতুন সাইকেল দরকার (মাউন্তেন বাইক)। যেই কথা সেই কাজ। কিনে ফেললাম। ঠিক তার ২ দিন পরে পানাম নগরীতে একটা ১০০ কিমি রাইড হবে। ১০০ কিমি দেয়ার সাহস বা আত্মবিশ্বাস না থাকলেও, যেকোনো জায়গা ঘুরতে যাওয়ার আগ্রহ মনে হয় মায়ের পেট থেকেই লালন করছি। ঠিক করলাম, ওদের সাথে যাব। যদি বেশি কষ্ট হয়, তবে ফেরার পথে ট্রাক/পিকাপ এ সাইকেল তুলে দিয়ে চলে আসব।
২০ জুলাই, ২০১২। সকালে উঠে রওনা দিলাম। আমাকে দেখে অনেকেই অবাক হল, কারণ আমি যে যাব এটা সিওরলি কাউকে জানাই নি। কিন্তু কেউ কিছু বলল না। রূপগঞ্জের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার কথা। রূপগঞ্জের রাস্তা অদ্ভুত সুন্দর। মনেই হয়না যে এটা ঢাকার মধ্যে। সবুজ এর মধ্যে দিয়ে চিকন রাস্তা, মাঝে মাঝে পানি, অল্প কিছু বাড়িঘর। যেতে যেতে যখন মজা পেয়ে গেছি, সামনের ওদের অনুসরণ করছি, এমন সময় ঘটল একটা ঘটনা। ইছাপুর ব্রিজ থেকে নামবার সময় কিছু বুঝে উঠার আগেই উল্টে পড়লাম রাস্তার মাঝখানে। পরে বুঝেছিলাম, পিছনের চাকার ব্রেক লুজ ছিল, নামবার সময় দুটো ব্রেক একসাথে চাপাতে, সামনের টা আগে ধরায় সাইকেল উল্টে গিয়েছে। ঐ মুহূর্তে এতকিছু বুঝার মানসিকতা আমার ছিল না। চিবুকে এতই বেথা পেয়েছিয়ালাম যে মনে হচ্ছিল বোধয় দাঁত ভেঙেছে। কনুই এর একটু ছড়ে গিয়েছিল। এক্সিডেন্ট এর জায়গাতেই একটি নাস্তার দোকান ছিল। সেখানে বসে নাস্তা সারলাম আর হাতে মুখে পানি দিয়ে নিলাম। চিবুক ততক্ষণে গোল আলু হয়ে গিয়েছে। এতকিছুর পরও আমার একটা কথাই মনে হচ্ছিল- “ওরা নিশ্চই এখন আমাকে ফেরত পাঠিয়ে দেবে”। আমাকে অবাক করে দিয়ে একজন বলে উঠলেন, দরকার হলে ১০কিমি/ঘণ্টা গতিতে যাওয়া হবে, তাও সবাই একসাথে যাবে। কিভাবে উনাকে ধন্যবাদ দিব বুঝতে পারছিলাম না। এক্সিডেন্ট করেছি যেখানে সেটা বড়জোর ২০ কিমি হবে বাসা থেকে। মানে আরও ৮০ কিমি বাকি। আমি ততক্ষণে ধরেই নিয়েছি, এই যাত্রায় সেঞ্চুরি হচ্ছে না। প্রথম প্রথম বেশ কষ্ট হচ্ছিল চালাতে। কিছুক্ষনের মধ্যে ভুলে গেলাম। প্রকৃতির তৈরি শরীরের ব্যথা বোধয় প্রকৃতি-ই তার সৌন্দর্য দিয়ে ভুলিয়ে দেয়।
শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেরি পার করার পর সকাল ১০টার মধ্যে পোঁউছালাম মুরাপারা জমিদার বাড়িতে। কিছু ফটোসেশন করে আবার রওনা দিলাম গন্তব্যের দিকে। কিছু পথ ভুল করার পর প্রথমে সোনারগাঁও জাদুঘরে গেলাম। জাদুঘর ঘুরবার পর পানাম নগরী। পানাম নগরী পৌঁছেছি ঠিকই , কিন্তু ততক্ষণে বোধয় আমি আধমরা। ততক্ষনে রোদ ও বেশ ভালমত আমাদের আতিথেয়তা করছিল। আর আমার হাতের ব্যাথাটা তখন মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিল। ২হাত দিয়ে ধরে চালাতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। এবার ফেরত যাব। তখন আর আমার মাথায় ট্রাক/পিকাপের চিন্তা আসে নি। এসেছি যখন পুরোটা শেষ করেই যাব।
ফেরার পথে ঠিক হল কিছুটা পথ মেইন রোড দিয়ে যাওয়া হবে। রওনা দেয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই চোখে পড়ল, বাংলার তাজমহল ২ কিমি। যদিও এই জিনিষটার প্রতি কোন আগ্রহ আমার কখনোই ছিল না, তাও মনে হল, ২ কিমি এর জন্য ফেলে যাব? যারা যেতে চাচ্ছিল না, তাদের কাছে কয়েক মিনিট এর অনুমতি নিয়ে আমরা ৩ জন গেলাম বাংলার তাজমহল দেখতে।দেখা শেষ করে ফিরে আসলাম অন্যরা যেখানে অপেক্ষা করছিল। এবার সবচে কঠিন কাজ। একই পথে ফিরে যাওয়া কিন্তু রোদের মধ্যে। আমাদেরকে শান্ত করার জন্য এক বন্ধু একটা শর্টকাট এর কথা বলল। সেই শর্টকাট ছিল বালির রাস্তা, কোন গাছ ছাড়া, সরাসরি সূর্যের নিচে, প্রায় ১০ কিমির মত। ৯০কিমি চালানর পরে, দুপুর ২টায় সরাসরি সূর্যের নিচে চালাতে যতখানি আনন্দ লাগা সম্ভব, ততখানি-ই লাগছিলো। ৯৫ কিমি চালানর পর বোধয় আমি বলেও ছিলাম যে আমি আর পারছি না। “পারবি পারবি পারবি” শুনতে শুনতে আর ৫কিমি চালিয়েছিলাম।
এটা কোন ত্রায়াথলন না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল, সামনে একটা ফিতা, সেটা পার হবামাত্র যদি মানুষজন ছুটে আসত, মন্দ হত না :P। যখন ১০০ কিমি শেষ করলাম, তখন পিঙ্ক সিটি এর কাছাকাছি। লেকের সামনে বসে আমরা যখন মনে মনে আমাদের এই ক্ষুদ্র বিজয় সেলিব্রেট করছিলাম, তখন আমি ভাবছিলাম, যারা রেগুলার চালায়, আর যারা চালায়ই না, তাদের কাছে এটা কিছুই না। কিন্তু আমার জন্য অনেক বেশি বড় একটা পাওয়া। সকালে একটা এক্সিডেন্ট করার পরও আমি পেরেছি শেষ করতে। এতক্ষন আসলে এক্সিডেন্ট এর কথা মাথায়ই ছিল না, এখন মনে হল ড্রেসিং করা দরকার।
উত্তরা আসবার পর ডিএনসির বাকিরা অভ্যর্থনা জানালো আর আমার অবস্থা দেখে বলল তাড়াতাড়ি বাসায় যাও খাইছে. বাসায় ফিরে দেখলাম, ১১১ কিমি চালিয়েছি ঐ দিনে। এক্সিডেন্ট, সাইকেল, এসব কারণে অনেক বকা খেয়েছি। আবার ১০০ কিমি দেয়ার জন্যে ডিএনসির কাছে মেডেল ও পেয়েছি :P। কিন্তু দিনের শেষে, আসল কথা হল নিজেকে নিজের কাছে প্রতিষ্ঠিত করা। আশপাশের সবার কাছ থেকে অনেক সাহায্য পেয়ে, ঐ যাত্রায় এই কাজ টুকু অন্তত ভালোই করেছিলাম ঃ)

YOUR NAMEAbout Me
আসসালামু আলাইকুম। নবীন বাংলা ব্লগ সাইটে ভিজিট করার জন্য আপনাকে স্বাগতম। আসলে এই ব্লগ সাইটটি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। এবং আমি এই সাইটের এডমিন, মূলত ব্লগিং প্রাকটিস এবং মুক্ত জ্ঞাণ চর্চার জন্যই এই সাইটটি ওপেন করেছি। আমার সাইটের পোস্টগুলো অন্যান্য সুনাম খ্যাত ব্লগ সাইটে সমূহে পাবলিশ করে থাকি তথারুপ টেকটিউন্স, টিউনারপেইজ। ইনশাআল্লাহ যতদিন বেঁচে থাকব নবীন বাংলা ব্লগে লেখালেখি করার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। এখানে অন্যান্য লেখকদের বাছাই করা পোস্টগুলো পাবলিশ করা হয়। এবং ইচ্ছা করলে আপনিও এই ব্লগের অতিথি লেখক হিসাবে শুরু করতে পারেন।পরিশেষে আমার সাইট কিংবা প্রকাশিত লেখা সম্পর্কে কোন আপনাদের অভিযোগ, মতামত, পরামর্শ থাকলে তা সাদরে গ্রহন করা হবে। আবারো ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা সবাইকে!!
Follow : | | Facebook | Twitter

Post a Comment

 
Top