(মূল লেখক: তারেক-অনু, সচালায়তন)
শিকলের ঝনঝন, ধাতব বর্মের সাথে সুতীক্ষ তলোয়ারের আলতো স্পর্শে উৎসরিত ধ্বনি , ঘোড়ার হ্রেষা- সব অলীক শব্দ একই সাথে প্রবেশ করল কর্ণকুহরে, সেই সাথে চোখ জুড়াল চকচকে শিরস্ত্রাণে প্রতিফলিত রোদ্দুর, কামারের আগুন, সারি সারি তাবু, আর এক আজব তীরন্দাজকে দেখে। সবুজ পোশাকের লোকটা ভাবে রবিন হুড হলেও তীর ছোড়াতে এখনো যোজন যোজন পেছনে আছে, তবুও তাকে ঘিরে উৎসাহী জনতার ভিড়, আর পাশেই একগাছে লটকানো দাগী আসামীর ছবি।


ঘোড়ার পিঠে চাপানো জমকালো জিনে সওয়ার হয়ে এলেন চার অশ্বারোহী, চার জন চার আলাদা আলাদা জাতির প্রতিনিধিত্ব করছেন ক্রুসেডের সময়কার, পোশাকও পড়েছেন সেই হিসেবেই, – আরব মুসলিম, ব্রিটিশ নাইট, ক্যাথলিক স্প্যানিশ, আর এক ব্যাটা নাম না জানা ভবঘুরে, যুদ্ধে যাচ্ছে খাওয়া পরার নিশ্চয়তায়, পবিত্র ভূমি উদ্ধারের টানে নয়। লেগে গেল যুদ্ধ, ঘোড়ার খুরের আঘাতে প্রকম্পিত বালুময় যুদ্ধক্ষেত্র, তলোয়ারে তলোয়ারে ঠোকাঠুকি লেগে ছুটল আগুনে ফুলঝুরি, দেখা যাক কে জিতে এবারের ক্রুসেডে!


সবটাই সাজানো খেলা যদিও, এসেছি ফিনল্যান্ডের হামেনলিন্না শহরে, সেখানে অতল নীল হ্রদের পাড়ে প্রতি গ্রীষ্মে কয়েক দিনের জন্য বসে এই মধ্যযুগীয় মেলা, সারা ইউরোপ থেকে আসে যোগদানকারীরা- কেউ কামার, কেউ কুমোর, কেউ যোদ্ধা, কেউ মদের যোগানদার! নিজেদের মাঝে প্রতিযোগিতাও চলে তাদের বছরের সেরা অভিনেতা হিসেবে! বিশাল এলাকা ঘেরা হয়েছে বেড়া দিয়ে, টিকেট কেটে প্রবেশ করলেই আপনি চলে যাবেন হাজার বছর আগের এক মেলাতে, তেমনই কাপড়চোপড় গায়ে, বাতাসে আলখেল্লা ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আবালবৃদ্ধবণিতা।




আর আছে বেশুমার খাবারের দোকান, সেই সময়ের ঘোড়ার স্ট্যু থেকে শুরু করে উৎকৃষ্ট সসেজ, গরুর ভাজা মাংস, চিনি লাগানো আপেল কি নেই! এখানেই দেখা মিলল ফ্রায়ার টাকের সাথে!

মনে আছে তো রবিন হুডের সেই যুদ্ধবাজ মহৎপ্রাণ সন্ন্যাসী ফাদার টাকের কথা- যার বাইবেলের জ্ঞান, তলোয়ারের দক্ষতা, খাবার নেশা পরিণত হয়েছিল তার জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তীতে। সেই ব্যাটা দেখি চামড়ার পোশাকে ঘেমে নেয়ে উঠেছে আস্ত একটা শুয়োর অল্প আঁচে গ্রিল করতে করতে।

তার পাশেই গরমে তিতিবিরক্ত হয়ে হ্রদের ধারে কফি পান করছেন কোন ভাইকিং দেবতা, পায়ের কাছে একান্ত অনুগতর মত ঘুরঘুর করছে নেকড়েসদৃশ এক ভীম হাস্কি।

(যদিও ভাইকিংরা কখনোই এই শিংওয়ালা হেলমেট ব্যবহার করত বলে প্রমাণ মিলে নাই, মানুষ কল্পনা থেকে ধার নিয়েছে এই সুদৃশ্য শিরস্ত্রাণের ধারণা), হাতে কফির কাপটা না থাকলে, আর এক চোখে পট্টি থাকলে পুরাই অডিন লাগত ভাইকিং চাচ্চুকে, কিন্তু কে বলবে তাকে সেই কথা! কার ঘাড়ে কটা মাথা!

কামারের দোকানগুলো আলাদা ভাবে নজর কাড়ল, বিশাল এক ধাতব প্যাঁচা ঘোষণা করছে তাদের অস্তিত্ব।

প্যাঁচাটির দাম জিজ্ঞাসা করে ভেবড়ে যেয়ে স্রেফ উপভোগ করার সিদ্ধান্তই যুক্তিযুক্ত মনে হল। কী করে নানা ধরনের ছুরি, বল্লমের ফলা, বর্ম, মুখোশ, ঢাল সেই আমলে তৈরি করা হত তা দেখানো হচ্ছে হাতে কলমে, দারুণ এক হাতের বর্ম দেখে মনে হল লর্ড অফ দ্য রিংসের সেই ডার্ক লর্ডের কাটা পড়া হাত!





মেলা দেখতে আগত শিশুদের দেখে সবচেয়ে ভালো লাগল, দু চোখ ভর্তি নিখাদ বিস্ময় নিয়ে গিলছে তারা মধ্যযুগীয় বিশ্ব। নাইটের ঘোড়া, কুমারের চাকা, তীরন্দাজের মাথার পালক সবকিছুতেই সমান আগ্রহ শিশুমনের। তাদের অনেকেই আবার প্রাচীন বেশভূষা জড়িয়ে হয়ে গেছে মেলারই অংশ।





দুই নাইটের সাথে কথা হল, একজন এসেছে বেলজিয়াম থেকে, অন্যজন ফরাসী। বললাম, ইতিহাসরা বলে নাইটরা ছিল স্রেফ ভাড়াটে সৈন্য, তাদের কোন ন্যায়-অন্যায় বোধ বা নীতি ছিল না। যে পয়সা দিত তার পক্ষেই যুদ্ধ করত, কিন্তু সাহিত্য আর চলচ্চিত্রে তারা হয়ে গেছে দুষ্টের দমনকারী, নারীনির্যাতন বিরোধী, সমাজের ফুলের মত চরিত্রের প্রতিভূ, এই ব্যাপারটা তোমরা কী ভাবে দেখ? ঘাড় নেড়ে স্রেফ শ্রাগ করে বলল- জানি না, এইটাই আমার জীবিকা, এই করেই তো চলছে, আমি তো অন্যায় করে কারো মাথায় বাড়ি দিয়ে টাকা কামাচ্ছি না!

আকাশে কালো মেঘের দঙ্গল ভিড় করে এসেছে পড়ন্ত বিকেলে, বৃষ্টিদেবতা একবার তার আশ্রয়ে এই জবরজং পোশাকধারীদের নিলে কী যে অকথ্য দুরবস্থা হবে সেই ভাবতে ভাবতেই সবাই চললাম নিরাপদ আশ্রয়ে।

অনেক অনেক দিন মনে রবে মধ্যযুগের মেলাটির কথা, শৈশবে রবিনহুড, আইভানহো, কালো তীর ইত্যাদি প্রিয় বই পড়ার সময় যে পরিবেশে হারিয়ে যেতে মন চাইত, তেমন কিছুতেই আবিষ্ট ছিলাম কয়েক মুহূর্তের জন্য হলেও, এক ঝলমলে স্বপ্নালোকে, আমারই মনের গহনে যার বসবাস।


শিকলের ঝনঝন, ধাতব বর্মের সাথে সুতীক্ষ তলোয়ারের আলতো স্পর্শে উৎসরিত ধ্বনি , ঘোড়ার হ্রেষা- সব অলীক শব্দ একই সাথে প্রবেশ করল কর্ণকুহরে, সেই সাথে চোখ জুড়াল চকচকে শিরস্ত্রাণে প্রতিফলিত রোদ্দুর, কামারের আগুন, সারি সারি তাবু, আর এক আজব তীরন্দাজকে দেখে। সবুজ পোশাকের লোকটা ভাবে রবিন হুড হলেও তীর ছোড়াতে এখনো যোজন যোজন পেছনে আছে, তবুও তাকে ঘিরে উৎসাহী জনতার ভিড়, আর পাশেই একগাছে লটকানো দাগী আসামীর ছবি।


ঘোড়ার পিঠে চাপানো জমকালো জিনে সওয়ার হয়ে এলেন চার অশ্বারোহী, চার জন চার আলাদা আলাদা জাতির প্রতিনিধিত্ব করছেন ক্রুসেডের সময়কার, পোশাকও পড়েছেন সেই হিসেবেই, – আরব মুসলিম, ব্রিটিশ নাইট, ক্যাথলিক স্প্যানিশ, আর এক ব্যাটা নাম না জানা ভবঘুরে, যুদ্ধে যাচ্ছে খাওয়া পরার নিশ্চয়তায়, পবিত্র ভূমি উদ্ধারের টানে নয়। লেগে গেল যুদ্ধ, ঘোড়ার খুরের আঘাতে প্রকম্পিত বালুময় যুদ্ধক্ষেত্র, তলোয়ারে তলোয়ারে ঠোকাঠুকি লেগে ছুটল আগুনে ফুলঝুরি, দেখা যাক কে জিতে এবারের ক্রুসেডে!


সবটাই সাজানো খেলা যদিও, এসেছি ফিনল্যান্ডের হামেনলিন্না শহরে, সেখানে অতল নীল হ্রদের পাড়ে প্রতি গ্রীষ্মে কয়েক দিনের জন্য বসে এই মধ্যযুগীয় মেলা, সারা ইউরোপ থেকে আসে যোগদানকারীরা- কেউ কামার, কেউ কুমোর, কেউ যোদ্ধা, কেউ মদের যোগানদার! নিজেদের মাঝে প্রতিযোগিতাও চলে তাদের বছরের সেরা অভিনেতা হিসেবে! বিশাল এলাকা ঘেরা হয়েছে বেড়া দিয়ে, টিকেট কেটে প্রবেশ করলেই আপনি চলে যাবেন হাজার বছর আগের এক মেলাতে, তেমনই কাপড়চোপড় গায়ে, বাতাসে আলখেল্লা ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আবালবৃদ্ধবণিতা।




আর আছে বেশুমার খাবারের দোকান, সেই সময়ের ঘোড়ার স্ট্যু থেকে শুরু করে উৎকৃষ্ট সসেজ, গরুর ভাজা মাংস, চিনি লাগানো আপেল কি নেই! এখানেই দেখা মিলল ফ্রায়ার টাকের সাথে!

মনে আছে তো রবিন হুডের সেই যুদ্ধবাজ মহৎপ্রাণ সন্ন্যাসী ফাদার টাকের কথা- যার বাইবেলের জ্ঞান, তলোয়ারের দক্ষতা, খাবার নেশা পরিণত হয়েছিল তার জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তীতে। সেই ব্যাটা দেখি চামড়ার পোশাকে ঘেমে নেয়ে উঠেছে আস্ত একটা শুয়োর অল্প আঁচে গ্রিল করতে করতে।

তার পাশেই গরমে তিতিবিরক্ত হয়ে হ্রদের ধারে কফি পান করছেন কোন ভাইকিং দেবতা, পায়ের কাছে একান্ত অনুগতর মত ঘুরঘুর করছে নেকড়েসদৃশ এক ভীম হাস্কি।

(যদিও ভাইকিংরা কখনোই এই শিংওয়ালা হেলমেট ব্যবহার করত বলে প্রমাণ মিলে নাই, মানুষ কল্পনা থেকে ধার নিয়েছে এই সুদৃশ্য শিরস্ত্রাণের ধারণা), হাতে কফির কাপটা না থাকলে, আর এক চোখে পট্টি থাকলে পুরাই অডিন লাগত ভাইকিং চাচ্চুকে, কিন্তু কে বলবে তাকে সেই কথা! কার ঘাড়ে কটা মাথা!

কামারের দোকানগুলো আলাদা ভাবে নজর কাড়ল, বিশাল এক ধাতব প্যাঁচা ঘোষণা করছে তাদের অস্তিত্ব।

প্যাঁচাটির দাম জিজ্ঞাসা করে ভেবড়ে যেয়ে স্রেফ উপভোগ করার সিদ্ধান্তই যুক্তিযুক্ত মনে হল। কী করে নানা ধরনের ছুরি, বল্লমের ফলা, বর্ম, মুখোশ, ঢাল সেই আমলে তৈরি করা হত তা দেখানো হচ্ছে হাতে কলমে, দারুণ এক হাতের বর্ম দেখে মনে হল লর্ড অফ দ্য রিংসের সেই ডার্ক লর্ডের কাটা পড়া হাত!





মেলা দেখতে আগত শিশুদের দেখে সবচেয়ে ভালো লাগল, দু চোখ ভর্তি নিখাদ বিস্ময় নিয়ে গিলছে তারা মধ্যযুগীয় বিশ্ব। নাইটের ঘোড়া, কুমারের চাকা, তীরন্দাজের মাথার পালক সবকিছুতেই সমান আগ্রহ শিশুমনের। তাদের অনেকেই আবার প্রাচীন বেশভূষা জড়িয়ে হয়ে গেছে মেলারই অংশ।





দুই নাইটের সাথে কথা হল, একজন এসেছে বেলজিয়াম থেকে, অন্যজন ফরাসী। বললাম, ইতিহাসরা বলে নাইটরা ছিল স্রেফ ভাড়াটে সৈন্য, তাদের কোন ন্যায়-অন্যায় বোধ বা নীতি ছিল না। যে পয়সা দিত তার পক্ষেই যুদ্ধ করত, কিন্তু সাহিত্য আর চলচ্চিত্রে তারা হয়ে গেছে দুষ্টের দমনকারী, নারীনির্যাতন বিরোধী, সমাজের ফুলের মত চরিত্রের প্রতিভূ, এই ব্যাপারটা তোমরা কী ভাবে দেখ? ঘাড় নেড়ে স্রেফ শ্রাগ করে বলল- জানি না, এইটাই আমার জীবিকা, এই করেই তো চলছে, আমি তো অন্যায় করে কারো মাথায় বাড়ি দিয়ে টাকা কামাচ্ছি না!

আকাশে কালো মেঘের দঙ্গল ভিড় করে এসেছে পড়ন্ত বিকেলে, বৃষ্টিদেবতা একবার তার আশ্রয়ে এই জবরজং পোশাকধারীদের নিলে কী যে অকথ্য দুরবস্থা হবে সেই ভাবতে ভাবতেই সবাই চললাম নিরাপদ আশ্রয়ে।

অনেক অনেক দিন মনে রবে মধ্যযুগের মেলাটির কথা, শৈশবে রবিনহুড, আইভানহো, কালো তীর ইত্যাদি প্রিয় বই পড়ার সময় যে পরিবেশে হারিয়ে যেতে মন চাইত, তেমন কিছুতেই আবিষ্ট ছিলাম কয়েক মুহূর্তের জন্য হলেও, এক ঝলমলে স্বপ্নালোকে, আমারই মনের গহনে যার বসবাস।


Post a Comment