১২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৪। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। জার্মানির দাচাউ বন্দীশিবির। সেদিন তখনও ভোরের আলো ভাল করে ফোটেনি। হত্যা করার জন্য ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে যাওয়া হয়েছে শিকলবন্দী চার নারীকে। ঘাতকের গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল একে একে তিনজন। এবার চতুর্থজনের পালা। একজন ঘাতক প্রথমে বন্দুকের বাঁট দিয়ে আঘাত করল তাঁকে। আহত বন্দিনী মাটিতে লুটিয়ে পড়লে ঘাতক তার শক্ত মিলিটারি বুটের ক্রমাগত লাথি দিয়ে তাঁকে রক্তাক্ত করে ফেলল। তারপর মুমূর্ষ অবস্থায়ই তাঁকে জোর করে হাঁটু গেড়ে বসানো হল। আর কয়েক মুহূর্ত পরেই নিশ্চিত মৃত্যু। তবুও সেই নারী ভেঙ্গে পড়েননি কিংবা মৃত্যুভয়ে কাতর হননি মোটেও। বরং ঘাতক যখন গুলি করার জন্য রাইফেল তাক করেছে তাঁর মাথা বরাবর, ‘স্বাধীনতা’ বলে তিনি জীবনের অন্তিম শব্দটি উচ্চারণ করলেন দ্রোহে, দৃঢ়তায়। এভাবেই মাত্র তিরিশ বছর বয়সে মৃত্যুকে বরণ করে নিলেন সেই অকুতোভয় নারী। তিনি নূর ইনায়েত খান–শান্ত, লাজুক ‘রাজকন্যা’ থেকে দুঃসাহসী গুপ্তচরে পরিণত হওয়া এক অসামান্যা ভারতীয় নারী।
তিনি জন্মেছিলেন মহীশুরের কিংবদন্তীতুল্য শাসক টিপু সুলতানের রাজবংশে। তাই জন্মগতভাবে তিনি ছিলেন একজন ‘প্রিন্সেস’। তাঁর পিতা ছিলেন টিপু সুলতানের প্র-প্রপৌত্র প্রিন্স ইনায়েত খান–একজন সুফিসাধক ও সঙ্গীতজ্ঞ। তাঁর মাতা ছিলেন একজন আমেরিকান, অরা মীনা রে বেকার ওরফে আমিনা বেগম। নূর-উন-নিসা ইনায়েত খানের জন্ম হয় রাশিয়ার মস্কোতে, ১৯১৪ সালের ১ জানুয়ারি তারিখে। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়।
নূরের জন্মের পর পরই তাঁর পরিবার রাশিয়া থেকে ইংল্যান্ডে চলে যায় এবং লন্ডন শহরে বসবাস শুরু করে। এ সময় ছোট্ট নূরকে কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়। কিন্তু স্বদেশের স্বাধীনতাকামী প্রিন্স ইনায়েত খান একজন কট্টর জাতীয়তাবাদী ও মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের একনিষ্ঠ সমর্থক হওয়ার কারণে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে সন্দেহের চোখে দেখত। ফলে বাধ্য হয়ে তিনি তাঁর পরিবার নিয়ে ১৯২০ সালে ফ্রান্সে চলে যান এবং প্যারিসের উপকণ্ঠে ‘ফজল মঞ্জিল’ নামক একটি বাড়িতে ওঠেন।
ইউরোপে জন্ম এবং বসবাস হলেও নূর বেড়ে ওঠেন তাঁর পিতার অহিংস সুফি আদর্শ, ভারতীয় সংস্কৃতি ও রক্ষণশীল পারিবারিক আবহকে ধারণ করে। ছোটবেলা থেকেই তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীতে তালিম নেন। তিনি প্যারিসের একটি কনজার্ভেটরীতে সঙ্গীত এবং সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিশু মনস্তত্ত্বে শিক্ষালাভ করেন। ছোটবেলা থেকেই নূর ছিলেন শান্ত, লাজুক, স্বাপ্নিক ও ভাবুক প্রকৃতির।
১৯২৭ সালে নূরের পিতার আকস্মিক মৃত্যু হলে তাঁর মাতা আমিনা বেগম স্বামীশোকে পুরোপুরি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। ফলে গোটা পরিবারের দায়িত্ব বর্তায় নূরের ওপর। এসময় তিনি প্যারিসে বিভিন্ন শিশু সাময়িকীতে লেখালেখি এবং রেডিওতে শিশুদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন। পরে তাঁর লেখা একটি শিশুতোষ বইও প্রকাশিত হয়।
এরই মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আগ্রাসনকারী জার্মান বাহিনী ফ্রান্স দখল করে নিলে নূরের পরিবার প্যারিসে থাকা আর নিরাপদ মনে করল না। ফ্রান্স থেকে পালিয়ে ১৯৪০ সালের জুন মাসে আবার তারা ইংল্যান্ডে ফিরে আসে। কিন্তু ইংল্যান্ডের আকাশেও তখন যুদ্ধের ঘনঘটা। জার্মান বাহিনীর নির্বিচার আগ্রাসন এবং যুদ্ধের ভয়াবহতা ও নৃশংসতা দেখে নূর ও তারঁ ভাই বিলায়েত খান নিস্পৃহ না থেকে যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন–যদিও তা ছিল তাঁদের প্রয়াত পিতার অহিংস সুফি আদর্শের পরিপন্থী।
১৯৪০ সালের ১৯ নভেম্বর নূর ব্রিটিশ উইমেন্স অক্সিলিয়ারি এয়ার ফোর্স (WAAF)-এ যোগ দেন এবং রেডিও অপারেটর হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে তাঁকে রাজকীয় বিমানবাহিনীর বম্বার ট্রেনিং স্কুলে পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানকার কাজ তাঁর কাছে একঘেয়ে লাগায় তিনি কমিশন্ড পদবির জন্য আবেদন করেন। ফরাসি ভাষার ওপর তাঁর দক্ষতার কারণে পরবর্তীতে তাঁকে চার্চিলের বিশেষ গুপ্তচর সংস্থা, স্পেশাল অপারেশন্স এক্সিকিউটিভ (SOE)-এর এফ (ফ্রান্স) সেকশনে ভর্তি করা হয়।
এরপর গুপ্তচর হওয়ার জন্য নূরকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়। প্রশিক্ষণের সময় তিনি নোরা বেকার নাম নেন। কিন্তু এসব প্রশিক্ষণে তাঁর ফলাফল তেমন সন্তোষজনক ছিল না, বরং গুপ্তচর হিসেবে ঝুঁকিপূর্ণ ফিল্ড এসাইনমেন্টের জন্য তাঁর যোগ্যতা নিয়ে প্রশিক্ষকদের দ্বিধা ছিল। বিশেষ করে তিনি আগ্নেয়াস্ত্র চালাতে ভয় পেতেন। এমনকি, প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে একটি ‘মক ইন্টারোগেশন’ বা সাজানো জেরার সময় তিনি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন এবং কান্নায় ভেংগে পড়েন! তিনি গুপ্তচর প্রশিক্ষণ পুরোপুরি শেষ করতে পারেননি।
তবে ফরাসি ভাষা ভাল জানার কারণে এবং রেডিও অপারেটর হিসেবে দক্ষতার জন্য কর্তৃপক্ষ তাঁকে গুপ্তচর হিসেবে প্যারিসে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। প্যারিসে পাঠানোর আগে কর্তৃপক্ষ নূরকে জানায়, কাজটি অত্যন্ত বিপদজনক এবং শত্রুর হাতে ধরা পড়লে নিশ্চিত মৃত্যু। এসব জেনেও তিনি প্যারিসে গুপ্তচর হিসেবে যেতে রাজি হন। তিনি হলেন শত্রু-অধিকৃত ফ্রান্সে গমনকারী প্রথম ব্রিটিশ নারী গুপ্তচর।
অবশেষে ১৯৪৩ সালের ১৬ জুন তারিখ রাতে নূর তাঁর সাংকেতিক নাম ‘মেডেলিন’, অপারেটর কলসাইন ‘নার্স’ এবং ভুয়া পাসপোর্টে ‘জীন মারি রেগ্নিয়ার’ ছদ্ম পরিচয় নিয়ে ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। নূরের এই গোপন মিশন সম্পর্কে তাঁর পরিবারও জানত না। ব্রিটিশ রাজকীয় বাহিনীর একটি বিমান তাঁকে উত্তর ফ্রান্সের একটি অবতরণ-স্থানে রাতের অন্ধকারে, গোপনে নামিয়ে দেয়।
নূরের অবদানের মরণোত্তর স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে ব্রিটিশ সরকার ব্রিটেনের সর্বোচ্চ বেসামরিক বীরত্বপদক ‘জর্জ ক্রস’ (George Cross) এবং ফরাসি সরকার ‘ক্রস অব ওয়ার’ (Croix de Guerre)-এ ভূষিত করেছিল। আজও প্রতি বছর ১৪ জুলাই ফ্রান্সের বাস্তিল দিবসে ফরাসি সামরিক বাদক দল প্যারিসের ‘ফজল মঞ্জিলের’ সামনে নূরকে সম্মান জানায়।
মহীশুরের বাঘ, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রামে শহীদ, রাজা টিপু সুলতানের বংশধর, ‘প্রিন্সেস’ নূর ইনায়েত খান ব্রিটিশদের পক্ষ হয়ে জার্মান আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল, যুদ্ধশেষে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্বদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। তা আর হয়নি।তথ্যসূত্র:
১। উইকিপিডিয়া নিবন্ধ।
২। বিবিসি–নূর ইনায়েত খান: লাইফ অফ আ স্পাই প্রিন্সেস।
৩। হিস্ট্রি অব ওয়ার নিবন্ধ।
৪। মেমরিজ অব মাই সিস্টার–পীর বিলায়েত ইনায়েত খান।




Post a Comment