0
সামান্য কিছু যন্ত্রপাতি এবং সাধারণ কয়েকজন অভিনেতা-অভিনেত্রী নিয়ে পরিচালক শুরু করলেন মুভিটির শ্যুটিং। কিছু কাজ করার পর শেষ হয়ে গেলো সব অর্থ। বাধ্য হয়ে স্ত্রীর গহণা বন্ধক দিয়ে এবং নিজের দামী বইপত্র বিক্রি করে পুনরায় শুরু করলেন শ্যুটিং। কিন্তু তাতেও শেষ হলো না কাজ। নতুন পরিচালকের পেছনে অর্থলগ্নি করতে রাজি নন কেউ। যাই হোক, অনেক কষ্টে পুনরায় অর্থ যোগাড় করে মুভিটি শেষমেষ সম্পন্ন করা গেলো।
হ্যাঁ, আজ পর্যন্ত সর্বজনস্বীকৃত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা মুভিটির তৈরীর পেছনের গল্পটি ঠিক এমনই। প্রথম পর্যায়ে একেবারেই নতুন পরিচালকের এই মুভিটি ভালোভাবে গ্রহণ করেনি কলকাতার দর্শকরা। কিন্তু ধীরে ধরে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সম্পূর্ণ নতুন ধরণের নির্মাণশৈলী এবং পন্ডিত রবিশংকরের অসাধারণ সংগীতের সমন্বয়ে তৈরী এই মুভির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে শুরু করে ভারতবর্ষ তথা সমগ্র বিশ্ব। ১৯৫৬ সালের কান ফিল্ম ফেস্টিভালে সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার জিতে নেয় এই মুভিটি। আর এভাবেই বিশ্বচলচ্চিত্রের বিশাল জগৎে দাপুটে আবির্ভাব ঘটে এক কিংবদন্তী চলচ্চিত্রকারের। এতোক্ষণ যে মুভিটি নিয়ে কথা হচ্ছিলো তার নাম ‘পথের পাঁচালী’ এবং সেই পরিচালকের নাম ‘সত্যজিৎ রায়’।
সত্যজিৎ রায়ের জন্ম ১৯২১ সালে বিখ্যাত রায়চৌধুরী বংশে। তৎকালীন বাংলায় মেধা-মননে কেবল জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের সাথেই তুলনা চলে এই রায়চৌধুরী পরিবারের। পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী, পিতা সুকুমার রায়, পিসী লীলা মজুমদার- প্রত্যেকেই ছিলেন স্বনামধন্য সাহিত্যিক।
১৯৪৮ সালে কয়েকমাসের জন্য ইংল্যান্ডে যান সত্যজিৎ রায়, তখন তার বয়স মাত্র ২৭। সেই সময়েই তিনি তৎকালীন ইউরোপ-আমেরিকার বিখ্যাত চলচ্চিত্রকারদের অসংখ্য মুভি দেখেন একের পর এক এবং মনে মনে এঁকে ফেলেন বড়মাপের চলচ্চিত্রকার হওয়ার স্বপ্ন। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৫৫ সালে মুক্তি পায় বিভূতিভূষণের কালজয়ী উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’ অবলম্বনে তৈরী বাজিমাত করা মুভিটি। মূল উপন্যাসের সুর এতো নিখুঁতভাবে অনুসরণ করে যে এতো উঁচু মাপের মুভি তৈরী করা সম্ভব, তা বেশ ভালোভাবেই দেখিয়ে দিলেন সত্যজিৎ রায়। এই ছবিটির সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি একে পরিণত করেন অপু ট্রিলজিতে, যার সর্বশেষ দুই সংযোজন ‘অপরাজিত’ এবং ‘অপুর সংসার’।
এরপর কেবল একের পর এক দিগ্বিজয়ের ইতিহাস। সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণে জুড়ি ছিলো না সত্যজিৎ রায়ের। একের পর এক তিনি চলচ্চিত্রে রূপদান করেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘দেবী’, রাজশেখর বসুর ‘পরশপাথর’, তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের ‘জলসাঘর’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঘরে বাইরে’ এবং ‘নষ্টনীড়’ (চারুলতা), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ এবং ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, হেনরিক ইবসেনের ‘গণশত্রু’ (এন এনিমি অব দ্যা পিপল), শংকরের ‘জন-অরণ্য’, শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের ‘চিড়িয়াখানা’।
দুটি অমর সৃষ্টির কথা বাদ রয়ে গেছে। একটি হচ্ছে পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর অমর সৃষ্টি গুপি গাইন-বাঘা বাইন অবলম্বনে তৈরী তৎকালীন বাংলা চলচ্চিত্রে সম্পূর্ণ ভিন্নধারার ছবি ‘গুপী-বাঘা ট্রিলজি’ (গুপী গাইন বাঘা বাইন, হীরক রাজার দেশে, গুপী বাঘা ফিরে এলো)। এর মধ্যে প্রথম দুটি মুভি পরিণত হয়েছিলো রীতিমতো ব্লকবাস্টারে। আরেকটি অমর সৃষ্টি হচ্ছে তার নিজের তৈরী কালজয়ী চরিত্র ‘ফেলুদা’ কে চলচ্চিত্রে রূপদান (সোনার কেল্লা এবং জয় বাবা ফেলুনাথ)।
পন্ডিত রবিশংকরের সংগীত সত্যজিৎের প্রথম দিককার মুভিকে দিয়েছিলো অনন্য এক মাত্রা। পরবর্তীতে সত্যজিৎ দেখান তার নিজের সংগীতজ্ঞানের অনন্য প্রতিভা। নিজের মুভিগুলোর সংগীত আয়োজনের ভারটা নিজের কাঁধেই তুলে নেন তিনি এবং সেখানেও যথারীতি ঈর্ষণীয় সাফল্য! সংগীতে তিনি রীতিমতো এক নতুন ধারার সুর নিয়ে আসেন যা শোনামাত্রই ধরে ফেলা যায় যে এটা সত্যজিৎের সুর। এবং এক্ষেত্রে সম্ভবত তিনি তার শ্রেষ্ঠ কাজ দেখান গুপী-বাঘা ট্রিলজিতে।
সত্যজিৎ রায় পরিচালিত একমাত্র হিন্দী মুভি মুন্সী প্রেমচাঁদের কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ তে ন্যারেটর হিসেবে কন্ঠদান করেন অমিতাভ বচ্চন, যা নিয়ে স্বয়ং অমিতাভ পরবর্তীতে কয়েকবার নিজের গর্ব প্রকাশ করেছেন। ‘অশনী সংকেত’ মুভিতে সত্যজিৎ নিয়ে আসেন বাংলাদেশের অন্যতম নায়িকা ববিতা-কে, যার জন্য ববিতা নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করেন। সত্যজিৎের ‘নায়ক’ এবং ‘চিড়িয়াখানা’ মুভি দুটি আলাদাভঅবে বিশেষ গুরুত্ব পায় কারণ এই দুটি মুভিতে প্রধান চরিত্র রূপায়ন করেন মহানায়ক উত্তম কুমার। ‘নায়ক’ মুভিটি নিঃসন্দেহে বাংলা চলচ্চিত্রের জগৎে এক অনন্য সংযোজন যা ছিলো অবধারিতভাবে সত্যজিৎ-উত্তম রসায়নের ফল। আরো দুই গুণী অভিনেতা-অভিনেত্রী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং শর্মিলা ঠাকুরের প্রতিভার বিকাশ এই মহান পরিচালকের হাত ধরেই।
সত্যজিৎের চলচ্চিত্র এবং সংগীত নিয়ে বিস্তর কথা হলো বটে, কিন্তু একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না- সত্যজিৎ রায় যদি চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে আবির্ভূত না-ও হতেন, তবুও কেবল সাহিত্যিক হিসেবে তিনি হয়তো অমরত্ব লাভ করতেন। বিশেষত ভৌতিক ধাঁচের গল্প সৃষ্টিতে তার অসামান্য গুণ ছিলো। বাংলা সাহিত্যের অমর এবং অনেকের মতে শ্রেষ্ঠতম গোয়েন্দা চরিত্র ‘ফেলুদা’ (প্রদোষ মিত্র) এই অনন্য প্রতিভাধরেরই সৃষ্টি। ৩৫ টি (যতটুকু মনে পড়ে) ভিন্ন ভিন্ন কাহিনী বর্ণনা করা ফেলুদা এবং তার দুাই সঙ্গী তোপসে এবং জটায়ুর রোমহর্ষক রহস্য কাহিনীগুলো রীতিমতো কালজয়ী সাহিত্যকর্মের সম্মান পেয়েছে। একটি মজার তথ্য শেয়ার না করে পারছি না- ফেলুদা নিজে কিন্তু স্যার আর্থার কোনান ডোয়েলের অমর সৃষ্ট চরিত্র বিশ্বখ্যাত ডিটেকটিভ শার্লক হোমসকে গুরু বলে মানতেন! ‘লন্ডনে ফেলুদা’ শীর্ষক কাহিনীতে ফেলুদা শার্লক হোমসের ২২১/বি, বেকার স্ট্রিটের বাড়ির সামনে গিয়ে স্যালুট করেছিলেন তার গুরুর উদ্দেশ্যে! সত্যজিৎ রায়ের আরেক অসাধারণ সৃষ্টি ‘প্রফেসর শঙ্কু’। অদ্ভূত যতো বিজ্ঞানভিত্তিক কল্পকাহিনীনির্ভর ‘প্রফেসর শঙ্কু’ সিরিজের জনপ্রিয়তা আজও কমে নি এতটুকুও।
১৯৯২ সালে মৃত্যুর মাত্র ২৩ দিন আগে সত্যজিৎ লাভ করেন তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম পুরষ্কার- সম্মানজনক অস্কার। তার আগে বিশ্বে মাত্র ৫ জন চলচ্চিত্র পরিচালক এই সম্মান পেয়েছিলেন- গ্রেটা গার্বো, ক্যারি গ্রান্ট, চার্লি চ্যাপলিন, জেমস স্টুয়ার্ট এবং আকিরা কুরোসাওয়া।
শেষ করার আগে বিশ্ববরেণ্য জাপানী চলচ্চিত্রকার ‘রশোমন’-খ্যাত আকিরা কুরোসাওয়ার সেই বিখ্যাত উদ্ধৃতিটি উদ্ধৃত করতেই হয়:
-‘এই পৃথিবীতে বাস করে সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র না দেখা চন্দ্র-সূর্য না দেখার মতোই অদ্ভূত ঘটনা।’
স্যালুট জানাই, সত্যজিৎ রায়!
(অনীক দেবনাথ)
[তথ্যসূত্র: দি হানড্রেড – মাইকেল এইচ. হার্ট/ যখন ছোট ছিলাম – সত্যজিৎ রায়]

YOUR NAMEAbout Me
আসসালামু আলাইকুম। নবীন বাংলা ব্লগ সাইটে ভিজিট করার জন্য আপনাকে স্বাগতম। আসলে এই ব্লগ সাইটটি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। এবং আমি এই সাইটের এডমিন, মূলত ব্লগিং প্রাকটিস এবং মুক্ত জ্ঞাণ চর্চার জন্যই এই সাইটটি ওপেন করেছি। আমার সাইটের পোস্টগুলো অন্যান্য সুনাম খ্যাত ব্লগ সাইটে সমূহে পাবলিশ করে থাকি তথারুপ টেকটিউন্স, টিউনারপেইজ। ইনশাআল্লাহ যতদিন বেঁচে থাকব নবীন বাংলা ব্লগে লেখালেখি করার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। এখানে অন্যান্য লেখকদের বাছাই করা পোস্টগুলো পাবলিশ করা হয়। এবং ইচ্ছা করলে আপনিও এই ব্লগের অতিথি লেখক হিসাবে শুরু করতে পারেন।পরিশেষে আমার সাইট কিংবা প্রকাশিত লেখা সম্পর্কে কোন আপনাদের অভিযোগ, মতামত, পরামর্শ থাকলে তা সাদরে গ্রহন করা হবে। আবারো ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা সবাইকে!!
Follow : | | Facebook | Twitter

Post a Comment

 
Top