মিউনিখ গিয়ে আমার প্রধান আগ্রহ ছিল ডাখাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পটা দেখা। জানি আমার বন্ধুরা বরাবরের মত নাক কুঁচকে বলবে বর নিয়ে বেড়াতে বের হয়ে কোথায় রোমান্টিক সব যায়গায় ঘুরবে তা না, শেষ পর্যন্ত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প? কিন্তু আমি এত কাছে এসে এটা না দেখে যাওয়ার মত উদাসীন হতে পারিনি । আমি দেখতে চাই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প নামক জিনিসগুলি আসলেই সত্যি। কারণ আমার কখনও বিশ্বাস হতে চায় না , যে মানুষেরা নিজেদেরকে পৃথিবীর সবচাইতে সভ্য, বুদ্ধিমান প্রাণী বলে দাবি করে, তাদের ভিতর এত ভয়াবহ অসভ্যতা লুকিয়ে থাকে, সময় সুযোগ পেলেই ডানা ঝাপটে বের হয়ে আসে, ধ্বংসের আনন্দে মেতে নিশ্চিহ্ন করে দেয় হাজার মানুষের শ্রমে গড়ে উঠা এক একটা সভ্যতা, আর পৃথিবীর সব কিছুর চাইতে বেশী মূল্যবান এক একটা মানুষের তরতাজা প্রাণ ।
ডাখাউ ক্যাম্পের লোহার গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলেই বিশাল খোলা জায়গা যেখানে তখন কয়েদিদের রোল-কল করা হত। চারপাশে ইলেক্ট্রিফাইড কাঁটাতারের বেড়া আর পরিখা দিয়ে ঘেরা ছিল তখন , আর ছিল ওয়াচ টাওয়ার। ক্যাম্পটি ক্যাম্প এলাকা এবং দাহন স্থান এই দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। ক্যাম্প এলাকায় ৬৯ টি ব্যারাক ছিল যারমধ্যে একটা ধর্মীয় কয়েদিদের জন্য আর একটা মেডিকেল এক্সপেরিমেন্টের জন্য নির্দিষ্ট করা ছিল।

ওয়াচ টাওয়ার

ব্যারাক
দাহন যন্ত্র
আর ছিল ক্যাম্প প্রিজন বা বাঙ্কার, ছোট ২.৮ মিটার চেম্বার,যেখানে দাঁড়ালে কয়েদিদের হাঁটু সামনের দেয়ালে,পিঠ পিছনের দেয়ালে লেগে থাকত প্রায় , যেখানে দাড়িয়ে থাকা ছাড়া আর নড়াচড়া করার মত তেমন কোন জায়গা ছিল না । এই অন্ধকার বাঙ্কারের ভিতর এক একজন কয়েদিকে দিনের পর দিন আটকে রাখা হত, খাবারও দেয়া হত ৪/৫ দিন পর পর। এ সমস্ত কয়েদীদের মধ্যে অধিকাংশই শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করত অথবা পাগল হয়ে যেত।

বাঙ্কার বা ক্যাম্প প্রিজন
ডাখাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প প্রথম অফিশিয়ালি যাত্রা শুরু করে ১৯৩৩ সালের ২২ মার্চ, মিউনিখ পুলিশপ্রধান হাইনরিখ হিমলারের একটা প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে। যদিও এটা জার্মানির প্রথম কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প না, কিন্তু এটাই একমাত্র ক্যাম্প যা ১২ বছরের নাজী শাসনের পুরোটা সময় ধরে আতংক ছড়িয়ে গেছে পুরো পৃথিবী জুড়ে। অন্য ক্যাম্প গুলোর স্বতঃস্ফূর্ত আতংকের তুলনায় ডাখাউ ক্যাম্পে আতংক ছড়ানোর কাজটা করা হত অনেক নিয়মতান্ত্রিক , উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং সংঘবদ্ধভাবে । একদম শুরুর দিকে এটা বাভারিয়ান পুলিশ বাহিনীর অধীনে থাকলেও ১৯৩৩ সালের এপ্রিলের ১০ তারিখে এসএস বাহিনী( হিটলারের প্রধান আধাসামরিক বাহিনী) ক্যাম্পের দায়িত্ব নিয়ে নেয় এবং সাথে সাথেই ক্যাম্পে অত্যাচারের মাত্রা বহুগুণ বেড়ে যায়। ১৯৩৩ এর এপ্রিলের ১২ তারিখেই এসএস ৪ জন ইহুদি কয়েদিকে পালিয়ে যাওয়ার মিথ্যে অজুহাতে গুলি করে মারে ।
ক্যাম্পে আসার সাথে সাথেই কয়েদিদের ব্যক্তিত্ব, সাহস, আশা গুড়িয়ে দেয়ার জন্য তাদের সাথে ভয়াবহ অসদাচরণ শুরু করা হত। ইহুদি, জনপ্রিয় ব্যক্তিদের আবার কখনও কখনও সকল নতুন কয়েদিদেরকেই ২৫ অথবা আরও বেশী চাবুক মেরে স্বাগতম জানান হত । এপ্রিল হতে মে মাসের শেষে ডাকাও তে মোট ১৩ জন কয়েদি খুন হয়।
১৯৩৩ সালের ক্যাম্প আইনে ( স্পেশাল রেগুলেশন) ডাখাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পকে জরুরী অবস্থা জারী করে সার্বভৌম ক্ষমতা দেয়ার চেষ্টা করা হয়, যেটা চলবে নিজের তৈরি আইনে, নিজের লোকদ্বারা এবং নিজস্ব বিচারব্যবস্থায়। বাভারিয়ান বিচারবর্গের হস্তক্ষেপে সেটার বাস্তবায়ন শেষ পর্যন্ত হয় না, হিমলারকে বাধ্য করা হয় ওয়াকলে কে ক্যাম্প কমান্ডেন্ট থেকে বরখাস্ত করতে( যে ক্যাম্প কমান্ডেন্ট সবসময় ক্যাম্পে আসত হাতে চাবুক আর পাশে একটা জার্মান শেফার্ড নিয়ে) । নতুন ক্যাম্প কমান্ডেন্ট থিওদর এইকে “ডিসিপ্লিনারি এন্ড পানিশমেন্ট রেগুলেশন” নামে নতুন ধরনের এক আইন তৈরি করে, যেটা ১৯৩৩ সালের ১লা অক্টোবর থেকে কার্যকর করা হয়,এবং যার মাধ্যমে যে কোন কয়েদিকে বিপ্লবী আখ্যা দিয়ে ফাঁসি অথবা গুলি করে মারা আইনসিদ্ধ হয়।
১৯৩৩ সালের শুরুর দিকে জার্মান কম্যুনিস্ট এবং ডেমোক্রেটদের ধরে ধরে ক্যাম্পগুলোতে আনা হত যাদের অনেকেই তাদের বিপ্লবের জন্য কারাভোগ শেষ করেছেন । আস্তে আস্তে ইহুদি, প্রফেশনাল অপরাধী, দেশান্তরী, সমকামী, ভিক্ষুক, মাতাল, জিপসিদের ধরা হয় এবং তারও পরে শুরু হয় বিদেশীদের ধরে আনা যাদের মধ্যে প্রথম ছিল অস্ট্রিয়ানরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আরও দলে দলে নতুন কয়েদিরা আসতে থাকে। মাঝে ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে ক্যাম্পটাকে কিছুদিনের জন্য খালি করা হয় এসএস ডেথ ডিভিশন এর তথাকথিত ট্রেনিং এর উদ্দেশে। কয়েদিরা আবার ফেরত আসে ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ১৯৪০ সালের মধ্যেই ১৩৩৭৫ পোলিশ নাগরিককে ডাখাউ ক্যাম্পে ধরে আনা হয়। ১৯৪১ সালে বলকানদের আর ১৯৪২ থেকে রাশিয়ানদের ডাকাও তে আনা শুরু হয়। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সবচেয়ে বেশী ছিল (বেশী থেকে কমের দিকে) পোলিশ, রাশিয়ান, ফ্রেঞ্চ, যুগোস্লাভিয়া এবং চেকরা । ৩০০০ ক্যাথলিক প্রিস্ট, বিশপ ছিল ডাখাউ ক্যাম্পে। ১৯৪৪ সালে ডাখাউ এর ভিতরে মহিলাদের জন্যও ক্যাম্প খোলা হয়।
এভাবে কয়েদির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে মৃত্যুহারও ভয়ানক ভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৯৪০ সালে ১৫২১, এবং ১৯৪১ সালে ২৫৭৬ জন কয়েদী প্রাণ হারায়। কয়েদিদের যে কাজ করান হত তার অনেক গুলোতেই জীবননাশের হুমকি ছিল, কাজের মধ্যেই চলত অকথ্য অত্যাচার, কখনও কখনও দিনের পর দিন কোন বিশ্রাম না দিয়েই টানা পরিশ্রম করান হত । কাজ শেষে ক্যাম্পে ফেরার পর ভয়ানকভাবে ক্লান্ত এইসব কয়েদিদের বাধ্য করা হত রোলকল এলাকাতে কয়েক ঘণ্টা দাড়িয়ে থাকতে। এরপর বাঙ্কারে ফিরার পর তাদের বিছানা ঠিক করা, লকার গোছানো, মেঝে পরিষ্কার করা সহ আরও অনেক কিছু করতে হত যার প্রতিটা কাজের সাথেই ছিল শাস্তির ব্যবস্থা, পান থেকে চুন খসলেই খেতে হত চাবুকের বাড়ি। যেহেতু পর্যাপ্ত খাবার দেয়া হত না তাই অধিকাংশ কয়েদি দুর্বল, অসুস্থ হয়ে পড়ত স্বাভাবিকভাবেই। ডিসেম্বর ১৯৪০ থেকে মে ১৯৪১, শুধু এই ৬ মাসেই এক চতুর্থাংশ কয়েদি ( ২৩.৫%) মারা যায়।

কয়েদিদের ডরমিটরি

লকার রুম
মধ্যযুগীয় যত শাস্তি তাদের দেয়া হত তার মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ ছিল “পোল হ্যাঙ্গিং” নামে এক শাস্তি যেখানে কয়েদীদের হাত পিছনে নিয়ে শিকল দিয়ে বেধে এরপর কোন উঁচু স্থান হতে তাদের ঝুলিয়ে রাখা হত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বিছানা ঠিকমতো গোছানো হয়নি, মেঝে যথেষ্ট পরিমাণ ঝকমক করছে না , টুপি দেখে কোন এসএস কর্মীকে না চিনতে পারার মত অপরাধ গুলোতেই এই শাস্তি দেয়া হত। দেখে শুনে আমার মনে হয়েছে তাদের শাস্তি দেয়ার জন্য আসলে কোন কারণ লাগত না, শাস্তি দিতে হবে এটাই সবচেয়ে বড় কারণ ছিল। আর তাদের সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল বোধহয় মানুষ হয়ে জন্মানো।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে কয়েদিদেরকে( রুম এল্ডার , ক্যাপো ইত্যাদি নির্বাচন করে) কাজে লাগান হত ক্যাম্পের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা চালিয়ে নেয়ার জন্য। এদের মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন ভাবে অন্যান্য কয়েদিকে অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা করত । কিন্তু এর উল্টোটাও ছিল, কিছু কয়েদি এই সুবিধা কাজে লাগিয়ে অন্য কয়েদিদের উপর অত্যাচারও করত, যদিও এদের সংখ্যা ছিল কম। হাজার প্রতিকূলতার মধ্যেও এরা এক দল আরেকদলকে সাহায্য করেছে, মানসিক সাহস যুগিয়েছে, প্রাণ বাঁচিয়েছে, হয়ত এটা প্রমাণের জন্যই যে তারা সৃষ্টির সেরা জীব।
ডাখাউ ক্যাম্প তৈরি করার পর থেকেই হিটলার বাহিনী দেশী বিদেশী বিভিন্ন জনপ্রতিনিধিদের ক্যাম্প পরিদর্শনে নিয়ে আসত। তাদেরকে দেখানর জন্য একটা আদর্শ ক্যাম্প বানানো ছিল যেটা দেখে মনে হবে ক্যাম্পে কয়েদিরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। আবার সাথে সাথে তাদেরকে এটা বুঝানোর চেষ্টাও করা হত যে এসব কীটপতঙ্গেরা যাদের জার্মান রক্ত নেই,অথবা যারা বেঈমান এদের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই।
ডাখাউ তে তথাকথিত হাসপাতালটা ছিল সবচেয়ে আতংকের যায়গা , যা চলত এসএস ডাক্তারদের দ্বারা , যারা এস এস মেডিকেল একাডেমী থেকে বের হওয়া এবং যাদের প্রায় সবাই সার্জারি শিখেছে ক্যাম্পে সুস্থ কয়েদিদের উপর অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার করে। অসুখের ভান করছে এই অপবাদ দিয়ে অনেক অসুস্থ মানুষকে অত্যাচার করে মেরে ফেলা হয়েছে। খুব বেশী অসুস্থ যারা , সেবা দেয়ার ঝামেলায় না গিয়ে সোজাসুজি মেরে ফেলাই ছিল এস এস ডাক্তারদের কাছে সবচেয়ে স্বাভাবিক। যদিও জার্মানিতে ইউথ্যানাসিয়া নিষিদ্ধ , কিন্তু অসুস্থ, কাজ করতে অক্ষম কিংবা মানসিক ভারসাম্যহীনদেরকে গ্যাস চেম্বারে বা বিষ দিয়ে মারা হত প্রতিদিন। তারপর পুড়িয়ে ফেলা হত দাহন যন্ত্রে। রোগীদের মারার আর একটা পন্থা ছিল , খুব বেশী অসুস্থ রোগীদের ওয়াশরুমে রেখে সারারাত তাদের গায়ে ঠাণ্ডা পানি ছেড়ে রাখত। যদি কোন বোকা , দুর্ভাগা এরপরও বেচে যেত তখন তার পিছনে কিছুটা বিষ খরচ করত এসএস ।
কয়েদীদের উপর বিভিন্ন অমানুষিক পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছে নাৎজীরা। বৃহৎ উচ্চতায় বিমানচালকদের সক্ষমতা এবং সীমাবদ্ধতা পরীক্ষার জন্য কয়েদিদের উপরে নৃশংস পরীক্ষা চালানো হয়েছে , এতে ৭০ জনের অধিক কয়েদী প্রাণ হারায় । বরফপানিতে কয়েদীদের চুবিয়ে রেখে অথবা দিনের পর দিন সমুদ্রের লবণাক্ত পানি খাইয়ে দেখা হত ঠিক কতদিন পর তারা মারা যায়। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত ১১০০ কয়েদীকে ম্যালেরিয়া জীবাণুতে আক্রান্ত করা হয় গবেষণার অজুহাতে।

বৃহৎ উচ্চতা পরীক্ষা
যুদ্ধের পরে প্রাপ্ত তথ্যমতে ডাখাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে মোট ৪১৫৬৬ জন কয়েদি মারা গেছেন যাদের মধ্যে ৪০০০ সোভিয়েত কয়েদিকে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মারা হয়েছে, ৪৮৫১ জন মারা হয় কাজে সক্ষম ছিল না বলে গ্যাস চেম্বারে । প্রধান ক্যাম্প থেকে বিভিন্ন সাবক্যাম্পে যাওয়া আসার পথে গাড়িতে না খেয়ে মারা যায় অসংখ্য কয়েদি, যাদের কথা কোথাও লিপিবদ্ধ নেই। আরও একদলের কথা লিপিবদ্ধ নেই , এরা মূলত ছিলেন হিটলারের কর্মকাণ্ডের বিরোধী, যাদের কে গেস্তাপোরা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ধরে নিয়ে আসত মেরে ফেলার উদ্দেশ্যেই।
১৯৪১ এর ডিসেম্বরে অ্যামেরিকা বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়ার সাথে সাথেই যুদ্ধ পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করে, অস্ত্রের চাহিদাও বহুগুণ বাড়ে। হিটলার এবং তার দোসররা কয়েদিদের যুদ্ধোপকরণ তৈরির কারখানায় কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এতে একদিকে যারা কাজে সক্ষম তাদের জন্য শাস্তি কমান হয় , খাবার সরবরাহ বাড়ানো হয় সক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য আর একদিকে কাজে অক্ষম কয়েদিদের মেরে ফেলার প্রবণতাও বেড়ে যায় কয়েক গুন। এরপরও যখন অস্ত্র কারখানাগুলো তাদের চাহিদা পরিমাণ কয়েদি পাচ্ছিল না, তখন হিমলারের হুকুমে কাজে সক্ষম যে কোন ব্যক্তিকেই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ধরে আনা শুরু হয় । যেখানে ১৯৪২ সালের ডিসেম্বরে ৮৮০০০ কয়েদী ছিল, সেখানে অগাস্ট ১৯৪৩ সালেই সেটা বেড়ে দাড়ায় ২২৪,০০০ জনে, এবং পরবর্তীতে বাড়তেই থাকে, ১৯৪৫ সালের জানুয়ারিতে সেটা গিয়ে দাড়ায় ৭৫০,০০০জনে।
যুদ্ধের একেবারে শেষের দিকে এসে , যখন পরাজয় কড়া নাড়ছে দরজায়, হিটলার বাহিনী সিদ্ধান্ত নেয় কোন কয়েদীকে শত্রুর হাতে পড়তে দেয়া যাবে না। শেষ মুহূর্তের বিশৃঙ্খলাতে পুরোপুরি সেটার বাস্তবায়ন না ঘটলেও, হাজার হাজার কয়েদীকে গ্যাস চেম্বারে মারা হয়েছে, সহস্র মারা পড়েছে স্থানান্তরিতের সময়, টাইফাস এপিডেমিক এলাকাতে পাঠানো হয়েছে কয়েক হাজার কয়েদিকে যারা অধিকাংশই বেঁচে নেই। এপ্রিলের ১৮ তারিখ হিমলার সিদ্ধান্ত নেয় উত্তর দিকের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলো থেকে কয়েদিদের সমুদ্রপথে সরিয়ে আনার, এরকম কয়েদি-পরিপূর্ণ দুটি জাহাজ ব্রিটিশ বাহিনী ভুল করে তখন ডুবিয়ে দেয়। আর দক্ষিণ দিকের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প গুলো থেকে কয়েদিদের আল্পসের দিকে নিয়ে যাওয়া হয় পায়ে হাঁটিয়ে । পথিমধ্যে মারা পরে আরও অনেক কয়েদি ।
ডাখাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত কয়েদি , খাবার সরবরাহে কমতি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে পরিস্থিতি শেষের দিকে ভয়াবহ রূপ নেয় । ১৯৪৪ সালে এখানে টাইফাস এপিডেমিক শুরু হয় , এবং খুব দ্রুত ছড়িয়ে পরে। ১৯৪৪ এর নভেম্বরে ৯৯৭ জন , ডিসেম্বরে ১৯১৫ জন এবং ১৯৪৫ সালের প্রথম তিন মাসে ১০,৪২৭ জন টাইফাস আক্রান্ত কয়েদী মারা যায়। দাহন যন্ত্রের ধারণক্ষমতার চেয়ে মৃতের সংখ্যা বেশী হয়ে যায় , এর মধ্যে কয়লার সরবরাহ কমতে কমতে ফেব্রুয়ারিতে বন্ধই হয়ে যায় , তাই শেষের দিকে কয়েদীদের গণকবর দেয়া হয়েছে পাশের এলাকাতে। অবশিষ্ট বেঁচে থাকা কয়েদিদেরকে প্রথমে বোমা মেরে বা খাবারে বিষ দিয়ে মারার প্লান করা হয়, কিন্তু তাড়াহুড়োর কারণে সেটার বাস্তবায়ন করতে না পেরে, ২৬ এপ্রিলে ১০,০০০ টাইফাস আক্রান্ত কয়েদিকে আল্পসের দিকে পদব্রজে পাঠানো হয় আসে পাশের এলাকার মানুষের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাকে গুরুত্ব না দিয়েই ।
এপ্রিলের ২৮ তারিখ পালিয়ে যাওয়া কয়েদিদের একাংশ মিলে ডাখাউ শহরে একটা সশস্ত্র বিক্ষোভ ঘটায়, কিন্তু এসএস বাহিনীর হাতে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ধরাশায়ী হয় । এর পরের দিনই অর্থাৎ ২৯ই এপ্রিল ডাখাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প স্বাধীন হয় ইউএস আর্মির হাতে । ইউএস আর্মির কিছু সৈনিক ক্যাম্পের অবস্থা দেখে আতংকিত হয়ে এসএস সদস্যদের খুন করা শুরু করে যেটাকে ডাখাউ ম্যাসাকার বলা হয়। তাদের কমান্ডারের হস্তক্ষেপে প্রায় সাথে সাথেই সেটা থেমে যায় ।

যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর ডাখাউ ক্যাম্প প্রথমে ইউএস আর্মির অধীনে ছিল, এরপর ১৯৪৮ সাল থেকে এটাকে রিফিউজি ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করা হয় । বেঁচে যাওয়া কয়েদীদের প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত ১৯৬৫ সালে এটা ডাখাউ মেমোরিয়াল সাইট হিসেবে পৃথিবীবাসীর জন্য উন্মুক্ত হয়।

প্রতিবছর পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে কয়েক মিলিয়ন মানুষ এখানে আসে তাদের পূর্বপুরুষদের দুর্ভাগ্য, নৃশংসতা ,অমানবিকতা , সেই সাথে প্রতি মুহূর্তের বেঁচে থাকার লড়াইয়ে জিতে যাওয়ার অসম্ভব প্রচেষ্টার রূপটা দেখতে। যাওয়ার সময় প্রত্যেকেই তাদের মাথার মধ্যে করে নিয়ে যায় এক টুকরো ডাখাউ , আর অন্তত একবারের জন্য হলেও তারা মনে মনে শপথ নেয় , আমরা আর কোথাও কোন ডাখাউ তৈরি হতে দিবো না।
(যদিও এই জার্মান জাতীরই এক ভয়ংকর সন্তান পুরো পৃথিবীটাকে জ্বালিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিল, তবুও ডাখাউ দেখে আমার তাদের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়েছে, নিজেদের লজ্জার ইতিহাসটাকেও তারা পৃথিবীর সামনে তুলে ধরছে কত অবলীলায় । আর কি অদ্ভুত জাতি আমরা, নিজেদের গর্বের ইতিহাস গুলোকেও প্রতিনিয়ত বিকৃত করছি নিজেরাই। আমাদের চাইতে দুর্ভাগা কোন জাতি কি পৃথিবীতে আছে ? মাঝে মাঝে সত্যিই খুব সন্দেহ হয় )
ফুট নোট- এই লেখার সকল তথ্য “ক্যাটালগ ফর দা এক্সিবিশন অফ দা ডাখাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প ১৯৩৩ টু ১৯৪৫” থেকে নেয়া। ছবি আমার তোলা, ক্যামেরা সাধারণ ডিজিটাল, তাই ছবির নিম্ন মানের জন্য খুবই দুঃখিত।
ডাখাউ ক্যাম্পের লোহার গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলেই বিশাল খোলা জায়গা যেখানে তখন কয়েদিদের রোল-কল করা হত। চারপাশে ইলেক্ট্রিফাইড কাঁটাতারের বেড়া আর পরিখা দিয়ে ঘেরা ছিল তখন , আর ছিল ওয়াচ টাওয়ার। ক্যাম্পটি ক্যাম্প এলাকা এবং দাহন স্থান এই দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। ক্যাম্প এলাকায় ৬৯ টি ব্যারাক ছিল যারমধ্যে একটা ধর্মীয় কয়েদিদের জন্য আর একটা মেডিকেল এক্সপেরিমেন্টের জন্য নির্দিষ্ট করা ছিল।
ওয়াচ টাওয়ার
ব্যারাক
আর ছিল ক্যাম্প প্রিজন বা বাঙ্কার, ছোট ২.৮ মিটার চেম্বার,যেখানে দাঁড়ালে কয়েদিদের হাঁটু সামনের দেয়ালে,পিঠ পিছনের দেয়ালে লেগে থাকত প্রায় , যেখানে দাড়িয়ে থাকা ছাড়া আর নড়াচড়া করার মত তেমন কোন জায়গা ছিল না । এই অন্ধকার বাঙ্কারের ভিতর এক একজন কয়েদিকে দিনের পর দিন আটকে রাখা হত, খাবারও দেয়া হত ৪/৫ দিন পর পর। এ সমস্ত কয়েদীদের মধ্যে অধিকাংশই শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করত অথবা পাগল হয়ে যেত।
বাঙ্কার বা ক্যাম্প প্রিজন
ডাখাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প প্রথম অফিশিয়ালি যাত্রা শুরু করে ১৯৩৩ সালের ২২ মার্চ, মিউনিখ পুলিশপ্রধান হাইনরিখ হিমলারের একটা প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে। যদিও এটা জার্মানির প্রথম কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প না, কিন্তু এটাই একমাত্র ক্যাম্প যা ১২ বছরের নাজী শাসনের পুরোটা সময় ধরে আতংক ছড়িয়ে গেছে পুরো পৃথিবী জুড়ে। অন্য ক্যাম্প গুলোর স্বতঃস্ফূর্ত আতংকের তুলনায় ডাখাউ ক্যাম্পে আতংক ছড়ানোর কাজটা করা হত অনেক নিয়মতান্ত্রিক , উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং সংঘবদ্ধভাবে । একদম শুরুর দিকে এটা বাভারিয়ান পুলিশ বাহিনীর অধীনে থাকলেও ১৯৩৩ সালের এপ্রিলের ১০ তারিখে এসএস বাহিনী( হিটলারের প্রধান আধাসামরিক বাহিনী) ক্যাম্পের দায়িত্ব নিয়ে নেয় এবং সাথে সাথেই ক্যাম্পে অত্যাচারের মাত্রা বহুগুণ বেড়ে যায়। ১৯৩৩ এর এপ্রিলের ১২ তারিখেই এসএস ৪ জন ইহুদি কয়েদিকে পালিয়ে যাওয়ার মিথ্যে অজুহাতে গুলি করে মারে ।
ক্যাম্পে আসার সাথে সাথেই কয়েদিদের ব্যক্তিত্ব, সাহস, আশা গুড়িয়ে দেয়ার জন্য তাদের সাথে ভয়াবহ অসদাচরণ শুরু করা হত। ইহুদি, জনপ্রিয় ব্যক্তিদের আবার কখনও কখনও সকল নতুন কয়েদিদেরকেই ২৫ অথবা আরও বেশী চাবুক মেরে স্বাগতম জানান হত । এপ্রিল হতে মে মাসের শেষে ডাকাও তে মোট ১৩ জন কয়েদি খুন হয়।
১৯৩৩ সালের ক্যাম্প আইনে ( স্পেশাল রেগুলেশন) ডাখাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পকে জরুরী অবস্থা জারী করে সার্বভৌম ক্ষমতা দেয়ার চেষ্টা করা হয়, যেটা চলবে নিজের তৈরি আইনে, নিজের লোকদ্বারা এবং নিজস্ব বিচারব্যবস্থায়। বাভারিয়ান বিচারবর্গের হস্তক্ষেপে সেটার বাস্তবায়ন শেষ পর্যন্ত হয় না, হিমলারকে বাধ্য করা হয় ওয়াকলে কে ক্যাম্প কমান্ডেন্ট থেকে বরখাস্ত করতে( যে ক্যাম্প কমান্ডেন্ট সবসময় ক্যাম্পে আসত হাতে চাবুক আর পাশে একটা জার্মান শেফার্ড নিয়ে) । নতুন ক্যাম্প কমান্ডেন্ট থিওদর এইকে “ডিসিপ্লিনারি এন্ড পানিশমেন্ট রেগুলেশন” নামে নতুন ধরনের এক আইন তৈরি করে, যেটা ১৯৩৩ সালের ১লা অক্টোবর থেকে কার্যকর করা হয়,এবং যার মাধ্যমে যে কোন কয়েদিকে বিপ্লবী আখ্যা দিয়ে ফাঁসি অথবা গুলি করে মারা আইনসিদ্ধ হয়।
১৯৩৩ সালের শুরুর দিকে জার্মান কম্যুনিস্ট এবং ডেমোক্রেটদের ধরে ধরে ক্যাম্পগুলোতে আনা হত যাদের অনেকেই তাদের বিপ্লবের জন্য কারাভোগ শেষ করেছেন । আস্তে আস্তে ইহুদি, প্রফেশনাল অপরাধী, দেশান্তরী, সমকামী, ভিক্ষুক, মাতাল, জিপসিদের ধরা হয় এবং তারও পরে শুরু হয় বিদেশীদের ধরে আনা যাদের মধ্যে প্রথম ছিল অস্ট্রিয়ানরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আরও দলে দলে নতুন কয়েদিরা আসতে থাকে। মাঝে ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরে ক্যাম্পটাকে কিছুদিনের জন্য খালি করা হয় এসএস ডেথ ডিভিশন এর তথাকথিত ট্রেনিং এর উদ্দেশে। কয়েদিরা আবার ফেরত আসে ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ১৯৪০ সালের মধ্যেই ১৩৩৭৫ পোলিশ নাগরিককে ডাখাউ ক্যাম্পে ধরে আনা হয়। ১৯৪১ সালে বলকানদের আর ১৯৪২ থেকে রাশিয়ানদের ডাকাও তে আনা শুরু হয়। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সবচেয়ে বেশী ছিল (বেশী থেকে কমের দিকে) পোলিশ, রাশিয়ান, ফ্রেঞ্চ, যুগোস্লাভিয়া এবং চেকরা । ৩০০০ ক্যাথলিক প্রিস্ট, বিশপ ছিল ডাখাউ ক্যাম্পে। ১৯৪৪ সালে ডাখাউ এর ভিতরে মহিলাদের জন্যও ক্যাম্প খোলা হয়।
এভাবে কয়েদির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে মৃত্যুহারও ভয়ানক ভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৯৪০ সালে ১৫২১, এবং ১৯৪১ সালে ২৫৭৬ জন কয়েদী প্রাণ হারায়। কয়েদিদের যে কাজ করান হত তার অনেক গুলোতেই জীবননাশের হুমকি ছিল, কাজের মধ্যেই চলত অকথ্য অত্যাচার, কখনও কখনও দিনের পর দিন কোন বিশ্রাম না দিয়েই টানা পরিশ্রম করান হত । কাজ শেষে ক্যাম্পে ফেরার পর ভয়ানকভাবে ক্লান্ত এইসব কয়েদিদের বাধ্য করা হত রোলকল এলাকাতে কয়েক ঘণ্টা দাড়িয়ে থাকতে। এরপর বাঙ্কারে ফিরার পর তাদের বিছানা ঠিক করা, লকার গোছানো, মেঝে পরিষ্কার করা সহ আরও অনেক কিছু করতে হত যার প্রতিটা কাজের সাথেই ছিল শাস্তির ব্যবস্থা, পান থেকে চুন খসলেই খেতে হত চাবুকের বাড়ি। যেহেতু পর্যাপ্ত খাবার দেয়া হত না তাই অধিকাংশ কয়েদি দুর্বল, অসুস্থ হয়ে পড়ত স্বাভাবিকভাবেই। ডিসেম্বর ১৯৪০ থেকে মে ১৯৪১, শুধু এই ৬ মাসেই এক চতুর্থাংশ কয়েদি ( ২৩.৫%) মারা যায়।
কয়েদিদের ডরমিটরি
লকার রুম
মধ্যযুগীয় যত শাস্তি তাদের দেয়া হত তার মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ ছিল “পোল হ্যাঙ্গিং” নামে এক শাস্তি যেখানে কয়েদীদের হাত পিছনে নিয়ে শিকল দিয়ে বেধে এরপর কোন উঁচু স্থান হতে তাদের ঝুলিয়ে রাখা হত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বিছানা ঠিকমতো গোছানো হয়নি, মেঝে যথেষ্ট পরিমাণ ঝকমক করছে না , টুপি দেখে কোন এসএস কর্মীকে না চিনতে পারার মত অপরাধ গুলোতেই এই শাস্তি দেয়া হত। দেখে শুনে আমার মনে হয়েছে তাদের শাস্তি দেয়ার জন্য আসলে কোন কারণ লাগত না, শাস্তি দিতে হবে এটাই সবচেয়ে বড় কারণ ছিল। আর তাদের সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল বোধহয় মানুষ হয়ে জন্মানো।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে কয়েদিদেরকে( রুম এল্ডার , ক্যাপো ইত্যাদি নির্বাচন করে) কাজে লাগান হত ক্যাম্পের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা চালিয়ে নেয়ার জন্য। এদের মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন ভাবে অন্যান্য কয়েদিকে অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা করত । কিন্তু এর উল্টোটাও ছিল, কিছু কয়েদি এই সুবিধা কাজে লাগিয়ে অন্য কয়েদিদের উপর অত্যাচারও করত, যদিও এদের সংখ্যা ছিল কম। হাজার প্রতিকূলতার মধ্যেও এরা এক দল আরেকদলকে সাহায্য করেছে, মানসিক সাহস যুগিয়েছে, প্রাণ বাঁচিয়েছে, হয়ত এটা প্রমাণের জন্যই যে তারা সৃষ্টির সেরা জীব।
ডাখাউ ক্যাম্প তৈরি করার পর থেকেই হিটলার বাহিনী দেশী বিদেশী বিভিন্ন জনপ্রতিনিধিদের ক্যাম্প পরিদর্শনে নিয়ে আসত। তাদেরকে দেখানর জন্য একটা আদর্শ ক্যাম্প বানানো ছিল যেটা দেখে মনে হবে ক্যাম্পে কয়েদিরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। আবার সাথে সাথে তাদেরকে এটা বুঝানোর চেষ্টাও করা হত যে এসব কীটপতঙ্গেরা যাদের জার্মান রক্ত নেই,অথবা যারা বেঈমান এদের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই।
ডাখাউ তে তথাকথিত হাসপাতালটা ছিল সবচেয়ে আতংকের যায়গা , যা চলত এসএস ডাক্তারদের দ্বারা , যারা এস এস মেডিকেল একাডেমী থেকে বের হওয়া এবং যাদের প্রায় সবাই সার্জারি শিখেছে ক্যাম্পে সুস্থ কয়েদিদের উপর অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার করে। অসুখের ভান করছে এই অপবাদ দিয়ে অনেক অসুস্থ মানুষকে অত্যাচার করে মেরে ফেলা হয়েছে। খুব বেশী অসুস্থ যারা , সেবা দেয়ার ঝামেলায় না গিয়ে সোজাসুজি মেরে ফেলাই ছিল এস এস ডাক্তারদের কাছে সবচেয়ে স্বাভাবিক। যদিও জার্মানিতে ইউথ্যানাসিয়া নিষিদ্ধ , কিন্তু অসুস্থ, কাজ করতে অক্ষম কিংবা মানসিক ভারসাম্যহীনদেরকে গ্যাস চেম্বারে বা বিষ দিয়ে মারা হত প্রতিদিন। তারপর পুড়িয়ে ফেলা হত দাহন যন্ত্রে। রোগীদের মারার আর একটা পন্থা ছিল , খুব বেশী অসুস্থ রোগীদের ওয়াশরুমে রেখে সারারাত তাদের গায়ে ঠাণ্ডা পানি ছেড়ে রাখত। যদি কোন বোকা , দুর্ভাগা এরপরও বেচে যেত তখন তার পিছনে কিছুটা বিষ খরচ করত এসএস ।
কয়েদীদের উপর বিভিন্ন অমানুষিক পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছে নাৎজীরা। বৃহৎ উচ্চতায় বিমানচালকদের সক্ষমতা এবং সীমাবদ্ধতা পরীক্ষার জন্য কয়েদিদের উপরে নৃশংস পরীক্ষা চালানো হয়েছে , এতে ৭০ জনের অধিক কয়েদী প্রাণ হারায় । বরফপানিতে কয়েদীদের চুবিয়ে রেখে অথবা দিনের পর দিন সমুদ্রের লবণাক্ত পানি খাইয়ে দেখা হত ঠিক কতদিন পর তারা মারা যায়। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত ১১০০ কয়েদীকে ম্যালেরিয়া জীবাণুতে আক্রান্ত করা হয় গবেষণার অজুহাতে।
বৃহৎ উচ্চতা পরীক্ষা
যুদ্ধের পরে প্রাপ্ত তথ্যমতে ডাখাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে মোট ৪১৫৬৬ জন কয়েদি মারা গেছেন যাদের মধ্যে ৪০০০ সোভিয়েত কয়েদিকে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মারা হয়েছে, ৪৮৫১ জন মারা হয় কাজে সক্ষম ছিল না বলে গ্যাস চেম্বারে । প্রধান ক্যাম্প থেকে বিভিন্ন সাবক্যাম্পে যাওয়া আসার পথে গাড়িতে না খেয়ে মারা যায় অসংখ্য কয়েদি, যাদের কথা কোথাও লিপিবদ্ধ নেই। আরও একদলের কথা লিপিবদ্ধ নেই , এরা মূলত ছিলেন হিটলারের কর্মকাণ্ডের বিরোধী, যাদের কে গেস্তাপোরা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ধরে নিয়ে আসত মেরে ফেলার উদ্দেশ্যেই।
১৯৪১ এর ডিসেম্বরে অ্যামেরিকা বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়ার সাথে সাথেই যুদ্ধ পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করে, অস্ত্রের চাহিদাও বহুগুণ বাড়ে। হিটলার এবং তার দোসররা কয়েদিদের যুদ্ধোপকরণ তৈরির কারখানায় কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এতে একদিকে যারা কাজে সক্ষম তাদের জন্য শাস্তি কমান হয় , খাবার সরবরাহ বাড়ানো হয় সক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য আর একদিকে কাজে অক্ষম কয়েদিদের মেরে ফেলার প্রবণতাও বেড়ে যায় কয়েক গুন। এরপরও যখন অস্ত্র কারখানাগুলো তাদের চাহিদা পরিমাণ কয়েদি পাচ্ছিল না, তখন হিমলারের হুকুমে কাজে সক্ষম যে কোন ব্যক্তিকেই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ধরে আনা শুরু হয় । যেখানে ১৯৪২ সালের ডিসেম্বরে ৮৮০০০ কয়েদী ছিল, সেখানে অগাস্ট ১৯৪৩ সালেই সেটা বেড়ে দাড়ায় ২২৪,০০০ জনে, এবং পরবর্তীতে বাড়তেই থাকে, ১৯৪৫ সালের জানুয়ারিতে সেটা গিয়ে দাড়ায় ৭৫০,০০০জনে।
যুদ্ধের একেবারে শেষের দিকে এসে , যখন পরাজয় কড়া নাড়ছে দরজায়, হিটলার বাহিনী সিদ্ধান্ত নেয় কোন কয়েদীকে শত্রুর হাতে পড়তে দেয়া যাবে না। শেষ মুহূর্তের বিশৃঙ্খলাতে পুরোপুরি সেটার বাস্তবায়ন না ঘটলেও, হাজার হাজার কয়েদীকে গ্যাস চেম্বারে মারা হয়েছে, সহস্র মারা পড়েছে স্থানান্তরিতের সময়, টাইফাস এপিডেমিক এলাকাতে পাঠানো হয়েছে কয়েক হাজার কয়েদিকে যারা অধিকাংশই বেঁচে নেই। এপ্রিলের ১৮ তারিখ হিমলার সিদ্ধান্ত নেয় উত্তর দিকের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলো থেকে কয়েদিদের সমুদ্রপথে সরিয়ে আনার, এরকম কয়েদি-পরিপূর্ণ দুটি জাহাজ ব্রিটিশ বাহিনী ভুল করে তখন ডুবিয়ে দেয়। আর দক্ষিণ দিকের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প গুলো থেকে কয়েদিদের আল্পসের দিকে নিয়ে যাওয়া হয় পায়ে হাঁটিয়ে । পথিমধ্যে মারা পরে আরও অনেক কয়েদি ।
ডাখাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত কয়েদি , খাবার সরবরাহে কমতি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে পরিস্থিতি শেষের দিকে ভয়াবহ রূপ নেয় । ১৯৪৪ সালে এখানে টাইফাস এপিডেমিক শুরু হয় , এবং খুব দ্রুত ছড়িয়ে পরে। ১৯৪৪ এর নভেম্বরে ৯৯৭ জন , ডিসেম্বরে ১৯১৫ জন এবং ১৯৪৫ সালের প্রথম তিন মাসে ১০,৪২৭ জন টাইফাস আক্রান্ত কয়েদী মারা যায়। দাহন যন্ত্রের ধারণক্ষমতার চেয়ে মৃতের সংখ্যা বেশী হয়ে যায় , এর মধ্যে কয়লার সরবরাহ কমতে কমতে ফেব্রুয়ারিতে বন্ধই হয়ে যায় , তাই শেষের দিকে কয়েদীদের গণকবর দেয়া হয়েছে পাশের এলাকাতে। অবশিষ্ট বেঁচে থাকা কয়েদিদেরকে প্রথমে বোমা মেরে বা খাবারে বিষ দিয়ে মারার প্লান করা হয়, কিন্তু তাড়াহুড়োর কারণে সেটার বাস্তবায়ন করতে না পেরে, ২৬ এপ্রিলে ১০,০০০ টাইফাস আক্রান্ত কয়েদিকে আল্পসের দিকে পদব্রজে পাঠানো হয় আসে পাশের এলাকার মানুষের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাকে গুরুত্ব না দিয়েই ।
এপ্রিলের ২৮ তারিখ পালিয়ে যাওয়া কয়েদিদের একাংশ মিলে ডাখাউ শহরে একটা সশস্ত্র বিক্ষোভ ঘটায়, কিন্তু এসএস বাহিনীর হাতে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ধরাশায়ী হয় । এর পরের দিনই অর্থাৎ ২৯ই এপ্রিল ডাখাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প স্বাধীন হয় ইউএস আর্মির হাতে । ইউএস আর্মির কিছু সৈনিক ক্যাম্পের অবস্থা দেখে আতংকিত হয়ে এসএস সদস্যদের খুন করা শুরু করে যেটাকে ডাখাউ ম্যাসাকার বলা হয়। তাদের কমান্ডারের হস্তক্ষেপে প্রায় সাথে সাথেই সেটা থেমে যায় ।
যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর ডাখাউ ক্যাম্প প্রথমে ইউএস আর্মির অধীনে ছিল, এরপর ১৯৪৮ সাল থেকে এটাকে রিফিউজি ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করা হয় । বেঁচে যাওয়া কয়েদীদের প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত ১৯৬৫ সালে এটা ডাখাউ মেমোরিয়াল সাইট হিসেবে পৃথিবীবাসীর জন্য উন্মুক্ত হয়।
প্রতিবছর পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে কয়েক মিলিয়ন মানুষ এখানে আসে তাদের পূর্বপুরুষদের দুর্ভাগ্য, নৃশংসতা ,অমানবিকতা , সেই সাথে প্রতি মুহূর্তের বেঁচে থাকার লড়াইয়ে জিতে যাওয়ার অসম্ভব প্রচেষ্টার রূপটা দেখতে। যাওয়ার সময় প্রত্যেকেই তাদের মাথার মধ্যে করে নিয়ে যায় এক টুকরো ডাখাউ , আর অন্তত একবারের জন্য হলেও তারা মনে মনে শপথ নেয় , আমরা আর কোথাও কোন ডাখাউ তৈরি হতে দিবো না।
(যদিও এই জার্মান জাতীরই এক ভয়ংকর সন্তান পুরো পৃথিবীটাকে জ্বালিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিল, তবুও ডাখাউ দেখে আমার তাদের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়েছে, নিজেদের লজ্জার ইতিহাসটাকেও তারা পৃথিবীর সামনে তুলে ধরছে কত অবলীলায় । আর কি অদ্ভুত জাতি আমরা, নিজেদের গর্বের ইতিহাস গুলোকেও প্রতিনিয়ত বিকৃত করছি নিজেরাই। আমাদের চাইতে দুর্ভাগা কোন জাতি কি পৃথিবীতে আছে ? মাঝে মাঝে সত্যিই খুব সন্দেহ হয় )
ফুট নোট- এই লেখার সকল তথ্য “ক্যাটালগ ফর দা এক্সিবিশন অফ দা ডাখাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প ১৯৩৩ টু ১৯৪৫” থেকে নেয়া। ছবি আমার তোলা, ক্যামেরা সাধারণ ডিজিটাল, তাই ছবির নিম্ন মানের জন্য খুবই দুঃখিত।

Post a Comment