0

পুঠিয়া।
বাংলাদেশ একটি একক এলাকায় অবস্থিত সবচাইতে অধিক সংখ্যক মন্দিরের স্থাপনা কোথায়?এর উত্তর আপনি পাবেন পুঠিয়ায়।রাজশাহী জেলার অন্যতম বৃহৎ উপজেলা পুঠিয়া এক অনবদ্য ও অনন্য জায়গা।গোটা বাংলাদেশে এত মনোরম প্রাচীন শহর পানাম ছাড়া আর কোথাও চোখে পড়েনা।পানাম নগরী তাও ক্লান্ত;অবসন্ন,সময়ের দাগ তার সারা শরীরজুড়ে।পানাম অত্যাধিক বসতির চাপে ক্লিষ্ট,বাণিজ্যের হাতে পড়ে তাঁর অস্তিত্বই আজ বিপন্ন।পুঠিয়া ছিমছাম,শান্তশিষ্ট,সুন্দর।বাণিজ্য গ্রাস করতে পারেনি এখনও পুঠিয়াকে।পুঠিয়া যেন নাটোরের বনলতা সেন,সময় থমকে গেছে তাঁর ঘন কালো চুলের আড়ালে।
পুঠিয়ার জমিদারগণ ব্রিটিশ ভারতের সবচাইতে ধনী বংশের একটি,বৃহত্তর রাজশাহী এলাকায় তাঁদের অর্থ সম্পদ ও জমিজমার পরিমান ছিল অগুনতি।প্রশাসক হিসেবে তাঁদের অনেক সুনাম ছিল।এই জমিদাররা কিন্তু শুধু প্রজাশাসন করে উদ্বৃত্ত আয় দিয়ে বিলাস ব্যাসনে মত্ত ছিলেননা বরং রাজশাহী নগরে তাঁরা ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ করেছিলেন।স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল নির্মাণ থেকে শুরু করে রাজশাহী শহরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ পর্যন্ত সবখানে তাদের আর্থিক অবদান রয়েছে।এই জমিদার বংশের গোড়াপত্তন হয় মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে এবং ১৯৫১সালে পাকিস্তান শাসনামলে জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হবার মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে এর বংশপুরাণ।পুঠিয়ার মহারানী শরত সুন্দরী দেবী এবং মহারানী হেমন্ত কুমারী দেবী অত্র এলাকার জীবন্ত কিংবদন্তী হিসেবে খ্যাত।শিক্ষা দিক্ষার প্রসারে, চিকিৎসা সেবার বিস্তারে তাঁদের সক্রিয় অংশগ্রহন এবং অর্থ প্রদান মানুষের মাঝে তাঁদের সম্পর্কে বিপুল কৌতূহল এবং শ্রদ্ধা জাগিয়ে রেখেছে অদ্যাবধি।
এহেন বংশ তাঁদের নিজ ঘরবাড়ি যেনতেন করে গড়ে তুলবেন,তাই কি হয়?তাঁরা তাঁদের বাসস্থানের আশেপাশে এত মনোরম একটি প্রাকৃতিক পরিবেশ তৈরি করেছেন যা রীতিমতো বিস্ময়কর।বাংলাদেশের দৃষ্টিনন্দিত সেরা কয়েকটি মন্দির এখানে রয়েছে।শিব মন্দির;দোলমঞ্চ;আহ্নিক মন্দির;জগন্নাথ মন্দির;গোবিন্দ মন্দির এবং দুটি রাজবাড়ি যেন আলো হয়ে ফুটে রয়েছে পুঠিয়ায়।হঠাৎ করে পুঠিয়ায় প্রবেশ করলে মনে হয় এ বুঝি অন্য কোন জায়গা,বাংলাদেশের ভেতরেই শান্ত;ধীরস্থির ভিন্ন কোন রাজ্য।এক গোবিন্দ মন্দিরের সৌন্দর্য দেখেই তো মাথা খারাপ হবার যোগাড় হয়।এ মন্দিরের পুরোটা জুড়ে টেরাকোটার অনুপম কাজ।এমন নান্দনিক কর্ম শুধুমাত্র কান্তজীর মন্দিরের সাথে সমতুল্য।এ তো গেলো একটি মাত্র মন্দির যা রাজবাড়ীর ভেতরের আঙ্গিনায় উজ্বল হয়ে রয়েছে।রাজবাড়ীর সম্মুখপানেই ধবধবে সাদা রোমাঞ্চকর দোল মঞ্চ।পাশে পঞ্চরত্ন শিবমন্দির এবং এটি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শিবমন্দির,এর গায়ে ছেলেবেলায় আমি মূর্তি খোদাই দেখেছি।পরে শুনেছি দুষ্কৃতিকারীরা তা ভেঙ্গে দিয়েছে।পুরো মন্দিরটি অপূর্ব সুন্দর।মন্দিরের একমাত্র ঘরে উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ শিবলিঙ্গটি যত্ন সহকারে রক্ষিত আছে।রাজবাড়ীর চারপাশে দীর্ঘ এক দিঘী একে ঘিরে রেখেছে,লোকমুখে শুনেছি,এই দীঘির নীচে নাকি সুড়ঙ্গ রয়েছে,সত্য মিথ্যে জানা নেই।দীঘির পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে আর একটি ভগ্ন রাজবাড়ী এবং একাধিক অসাধারণ মন্দিরের সন্ধান মেলে।বড়ো আহ্নিক মন্দির,ছোট গোবিন্দ মন্দির ইত্যাদি।মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনীর লুটতরাজের শিকার হয়েছিল এ রাজবাড়ী ও তৎসংলগ্ন এলাকা।তাঁদের মৌলবাদী কর্মকাণ্ড থেকে রেহাই মেলেনি এই দুটি মন্দিরের।অনেক টেরাকোটা মুর্তির চোখ কাটা,নাক কাটা- ক্ষত সবখানে।
রাজশাহী থেকে মাত্র ৩১ কিমি পূর্বে অবস্থিত পুঠিয়ার যোগাযোগ বাবস্থা খুবই ভালো ও সাশ্রয়ী।আবার পুঠিয়া থেকে রাজশাহীর অন্যান্য দর্শনীয় এলাকা যেমন তাহেরপুর জমিদারবাড়ী, দূর্গাপুরের কিসমত মারিয়া মসজিদ,বাঘায় অবস্থিত বাঘা মসজিদও খুবই কাছে।আমরা যাঁরা রাজশাহীতে জন্মেছি,আমাদের যাঁদের শৈশব;কৈশোর;যৌবন কেটেছে পদ্মা পাড়ে,পুঠিয়া আমাদের কাছে এক পরম বিস্ময় হয়ে রইলেও বাস্তবতা হল যে,কোন একটি অজ্ঞাত কারণে পুঠিয়াকে আমরা আমাদের মনের মণিকোঠায় স্থাপন করতে পারিনি,আমরা দাবি করতে পারিনি যে পুঠিয়াকে ভিত্তি করে রাজশাহীর পর্যটন কেন্দ্র বিকশিত করা হোক।এত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যএবং ঐতিহাসিক স্থাপনা সমৃদ্ধ একটি এলাকার যোগ্য মর্যাদা আমরা পুঠিয়াকে দিতে পারিনি,পুঠিয়া যুগের পর যুগ অবহেলিতই থেকে গেছে।
পুঠিয়া আমার ফুপুর বাড়ী।প্রত্যেক বছর পুঠিয়া যাওয়াটা আমার একটা নিয়মিত কাজ বলা যায়।তবে শুধু ফুপুর বাড়ী বলে নয়,যতবার রাজশাহী যাই,পুঠিয়া আমার সর্বস্ব ধরে হ্যাঁচকা টান দেয়।পুঠিয়ায় গেলে আমি যেন এক মায়াবী ও রহস্যময় অতীতের মাঝে হারিয়ে যাই। ওখানে আমি ঘন্টার পর ঘন্টা কোনও কাজ না করেও দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারি,একা একা।জানিনা কেন!ফুপুর বাড়ি এড়িয়ে গিয়ে আমি একাকী হেঁটে চলি পুঠিয়ার রাস্তায়,দেখি ভোরের সূর্য উঁকি দেয় আহ্নিক মন্দিরের বারান্দায়,সাঁঝবেলার পড়ন্ত রোদ্দুর হানা দেয় শিব মন্দিরের চুড়ায়।আমি একা একা উপভোগ করি তার সৌন্দর্য সুধা।কানের মাঝে স্তব্ধতার গান শুনতে পাই যেন,সময়ের কোন ভেদাভেদ থাকেনা আর।তবে সবসময় যে একা যাওয়া,তাও নয়।এইবার প্রিয় আলোক ছিল আমার সাথে সঙ্গী হয়ে।পুঠিয়ার এইসব সম্পদকে পরিচিত করবার জন্য এক ভদ্রলোক সদা উপস্থিত থাকেন ওখানে, অনেক দোকানির কাছেই উনার ফোন নাম্বার আছে, ফোন করলেই হাজির হয়ে যান তৎক্ষনাৎ।উনি যেন পুঠিয়ার এক বিশাল ভক্তজন,পুঠিয়ার আস্ত অভিধান,পুঠিয়াপ্রিয়তা দর্শনার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারে তার বিস্ময়কর রকমের আগ্রহ টের পাই।
আর কথা না বাড়িয়ে এবার কিছু ছবি বিনিময় করা যাক।
ক) গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা পঞ্চরত্ন শিবমন্দির।
DSC_0783
খ) বড়ো আহ্নিক মন্দির ও ছোট গোবিন্দ মন্দির।
IMG_0458
গ) পুঠিয়ার পাঁচআনি রাজপ্রাসাদ (১৮৯৫),সাথে অপরূপা পঞ্চরত্ন গোবিন্দ মন্দির।
IMG_0443
ঘ) পঞ্চরত্ন শিবমন্দিরের সম্মুখভাগ।নির্মানকাল ১৮২৩-১৮৩০।
IMG_0473
ঙ) শিবলিঙ্গটি শুনেছি উপমহাদেশের ভেতর সর্ববৃহৎ।
IMG_0480
চ) কাছে থেকে গোবিন্দ মন্দির,এই মন্দিরের পুরোটা টেরাকোটার নানান অপূর্ব শিল্পকর্ম দ্বারা আবৃত।
IMG_0491
ছ) ছোট আহ্নিক মন্দিরে খোদাইকৃত অনুপম টেরাকোটার শিল্পকর্ম।
IMG_0466
জ) গোবিন্দ মন্দিরের পুরোহিত মহাশয়।
DSC_0829
ঝ) পুঠিয়ায় বিদেশিনী।
DSC_0802
ঞ) রোমাঞ্চকর দোলমঞ্চ।নির্মানকাল ১৭৭৮
IMG_0472
ট) শিবমন্দিরের উপরিভাগ।
IMG_0477
ঠ) ভাব নিয়ে তোলা ছোট গোবিন্দ মন্দির।
IMG_0497
ড) জং ধরা রাজবাড়ী নাম্বার টু অথবা চার আনি রাজপ্রাসাদ।
DSC_0819
ঢ) পুঠিয়া-কিশোরীর চোখে দেখেছি ভূবনডাঙার মেঘ!
Pu
ণ) গো টাইগারস গো। ভগ্ন রাজবাড়ীতে সচল উদীয়মান!
Puth
ত) প্রিয় আলোক মজুমদার,ছবি তোলায় সদাব্যাস্ত।
IMG_0502
থ) আরেক প্রস্থ পাঁচ আনি রাজপ্রাসাদ।
IMG_0451
দ) গোবিন্দমন্দিরের পেছনটা।
IMG_0492
ধ) রথের মেলা হত ফিবছর।
IMG_0445
থ) কুলাঙ্গার পাক হানাদার বাহিনীর বাংলার ঐতিহ্য ধর্ষণ। শুধু এই কারণে হলেও তাঁদের ফাঁসিকাষ্ঠে দেখতে চাই।
DSC_0805

YOUR NAMEAbout Me
আসসালামু আলাইকুম। নবীন বাংলা ব্লগ সাইটে ভিজিট করার জন্য আপনাকে স্বাগতম। আসলে এই ব্লগ সাইটটি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। এবং আমি এই সাইটের এডমিন, মূলত ব্লগিং প্রাকটিস এবং মুক্ত জ্ঞাণ চর্চার জন্যই এই সাইটটি ওপেন করেছি। আমার সাইটের পোস্টগুলো অন্যান্য সুনাম খ্যাত ব্লগ সাইটে সমূহে পাবলিশ করে থাকি তথারুপ টেকটিউন্স, টিউনারপেইজ। ইনশাআল্লাহ যতদিন বেঁচে থাকব নবীন বাংলা ব্লগে লেখালেখি করার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। এখানে অন্যান্য লেখকদের বাছাই করা পোস্টগুলো পাবলিশ করা হয়। এবং ইচ্ছা করলে আপনিও এই ব্লগের অতিথি লেখক হিসাবে শুরু করতে পারেন।পরিশেষে আমার সাইট কিংবা প্রকাশিত লেখা সম্পর্কে কোন আপনাদের অভিযোগ, মতামত, পরামর্শ থাকলে তা সাদরে গ্রহন করা হবে। আবারো ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা সবাইকে!!
Follow : | | Facebook | Twitter

Post a Comment

 
Top