0
 (মূল লেখক: তারকে-অনু, সচালায়তন)
সমতলের পদ্মাপারের মানুষ, কষ্ট করে ঘাম ঝরাতে এসেছি পর্বতে চড়তে, ফ্রান্সের আল্পসে। চড়াই-উৎরাই ডিঙ্গানোতে সেবারের মতো ইতি টেনে অতি ক্লান্ত পেশীগুলোকে বিশ্রাম দিতে আস্তানা গেড়েছি আল্পসের কোলে প্রকৃতির মাঝে এক পাহাড়ী শহর শবেরিতে, পুরনো অভিযাত্রার সঙ্গিনী হেলেনের বাড়ীতে।


ভেবেছিলাম কদিন শুধু ধুমসে গড়াগড়ি করে শরীরের বিশ্রামকে পুরোমাত্রায় পুষিয়ে নেব কিন্তু হেলেনের পাল্লায় পড়ে তা আর হচ্ছে কোথায়! একেক দিন একেক দর্শনীয় জায়গায় যেতে হচ্ছে পা টেনে টেনে, কখনো পাহাড় ডিঙ্গিয়ে সাইকেলে।
207106_10150548374970497_608590496_18298356_2074132_n
বিচিত্র সব কল্পকথার বই-এর পাতা থেকে তুলে আনা চোখ জুড়ানো বাড়ী-ঘর, ফ্রান্সের অন্যান্য অন্চলের সাথে পাহাড়ী এই অংশের অনেক তফাঁৎ, ভূ-তাত্ত্বিক ভাবে, প্রাকৃতিক ভাবে আবার বসবাসকারীদের মননেও, এখানে বলছি কেবল স্যাভয় অন্চলের কথা। ঘোরা হল একে একে সেন্ট জেভিয়ার্স, আনসে ইত্যাদি পার্বত্য জনপদগুলো।
319_87873440496_608590496_4157742_6600_n
কয়েকবারই যেতে হল ফরাসী সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ চিজের দোকানে, এই যে ছোট্ট একখানা শহর তারও যে কোন চিজের দোকানে অন্তত ষাট-সত্তর ধরনের চিজ পাওয়া যায় অনায়াসে, স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় সে কথা বলাই বাহুল্য।
এর মাঝে নতুন জোটা বন্ধু সিলভা বুঝিয়ে দিতে থাকে কোন চীজ কোন ধরনের গরু থেকে আগত। যেমন কোনটা এসেছে সেই ধরনের গরু থেকে যারা সারা বছর কেবল মাত্র ঘাস খায়, আরেক দল খায় খড়। কেউ বা সারাটা শীতকাল থাকে গোয়ালঘরে, কেউ বা বাহিরে, এমন নানা ধরনের খাদ্যাভাস আর বাসস্থানের কারণেই দুধে আসে নানা বিভিন্নতা আর সেই কারণেই নানা স্বাদের চীজ। সেই যে আধুনিক ফ্রান্সের রূপকার চালর্স দ্য গল বলেছিলেন ১৩০ ধরনের চীজ খায় যে জাতি, তাকে ঐক্যবদ্ধ করে শাসন করা সোজা কথা নয়।
319_87873430496_608590496_4157741_6228_n
এর পরপরই আসে রুটির কথা, বিখ্যাত ফরাসী রুটি হাতখানেক লম্বা ব্যাগোত্তিতো আছেই, আছে নানা অন্তত তিরিশ ধরনের ভিন্ন স্বাদের অমৃতসম রুটি,একেকটি বেকারীর ইতিহাস আর রুটির ঐতিহ্য নিয়েই মহাকাব্য লেখার যোগাড়, আর প্রতিটি বেকারীতে আসা প্রতিটি রুটিই সেদিনের, তাজা।
এখানে সবার মিলিত হবার জায়গা -শবেরীর সবচেয়ে বিখ্যাত স্থাপত্য ১৮৩৮ সালে তৈরী হাতির ঝরণা !
319_87873450496_608590496_4157744_7338_n
হাঁ, তৎকালীন এক ডিউকের ভারতবর্ষে অবস্থালীন সময়ের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে চার চারটি প্রমাণ আকারে হাতির দাত-শুড়ের সমন্বয়ে এই স্তম্ভ ও ঝরণাটি তৈরী করা হয়।
319_87873460496_608590496_4157746_8091_n
এখানে প্রত্যহ মোলাকাত ঘটে সকলের।
319_87873465496_608590496_4157747_8457_n
সেখান থেকে একদিন দেখতে গেলাম এর প্রাচীন দূর্গ, সেখানকার সৈন্যদের থাকবার টাওয়ার আর স্থানীয় ইতিহাসের জাদুঘরগুলো দেখতে। জাদুঘরেই পন্ডিচেরী থেকে আগত এক বর্ষীয়ান উপমহাদেশের কিউরেটরের সাথে পরিচয় হল, স্মিত হাস্যে জানালানে, উনার আদি বাসস্থান পন্ডিচেরীতে, অনেক অনেক বছর ফরাসীদের কলোনি থাকার সুবাদে তাদের অনেকেই ফ্রান্সে বসবাসের অনুমতি পেয়েছে।
এর মাঝে এক বিকেলে হেলেন তাড়া দিল এই অন্চলের অবশ্যদ্রষ্টব্য লা শারম্যেত দেখার জন্য, সেখানে বাস করতেন বিশ্বখ্যাত ফরাসী লেখক-দার্শনিক ঘ ঘ্যাক ঘুসো !
নতুন জায়গা দেখতে আমার মত বাউন্ডুলের কস্মিন কালেও আপত্তি ছিলনা, আর তাতে কোন ইতিহাসে ছোয়া বা লেখকের স্মৃতি জড়িয়ে থাকলেতো সোনায় সোহাগা, কিন্তু ঘ ঘ্যাক ঘুসো! ফরাসী সাহিত্য নিয়ে অতি অল্প হলেও খানিকটাতো নাড়াচাড়া করেছি, স্কুল জীবনে আলেকজান্দার দ্যুমা, ভিক্তর হুগো থেকে পরবর্তীতে শার্ল ব্যোদলেয়ার,অ্যালবেয়ার কামু পর্যন্ত, কিন্তু এমন সৃষ্টি ছাড়া নামতো কখনো শুনি নি!
যা হোক কুল-কপালে, রওনা দিলাম এক পাহাড়ী বিকেলে সেই লা শারম্যেতের উদ্দেশে, শহরের বেশ খানিকটা বাহিরে সবুজে ঘেরা এক শতাব্দী প্রাচীন প্রাচীর ঘেরা ভিলার সামনে, যার সামনে সাইন বোর্ডে সেই দার্শনিকের আকা ছবি, আর নাম ফরাসীতে লেখা, সে নাম দেখে হাসব, না কাদব বুঝতে পারি না, বড় বড় অক্ষরে স্পষ্ট লেখা আছে Jean Jacques Rousseau, জ্যঁ জ্যাঁক রুশো !
319_87873480496_608590496_4157750_9552_n
কে না জানে এই প্রাতস্মরনীয় দার্শনিক, লেখকের কথা। বলা হয় আধুনিক ফরাসী সাহিত্যের হাতেখড়িই হয় রুশো ও সমসাময়িক ভোলতেয়ারের লেখনীর মাধ্যামে, আর তাকে বলাই হয় ফরাসী দর্শনের জনক।
আসলে ফরাসীদের উচ্চরণে যেহেতু র,হ,জ একেবারে তালগোল পাকিয়ে যায়,তাই আমারই বুঝতে সমস্যা হয়েছে ফরাসিনীর কন্ঠে এই নাম। এমনকি রুশোর সমাধিতেও বছরকয়েক আগে যাবার সৌভাগ্য হয়েছিল, প্যারিসের প্যানতেওনে, কিন্তু এই প্রথম রুশোর স্মৃতি বিজড়িত বাড়ীতে আসা।
319_87873485496_608590496_4157751_9923_n
রুশো তার তরুণকালের প্রেমিকা ও প্রেরণাদাত্রী ম্যাদাম ভার্ণের সাথে এখানে জীবনের অতি তাৎপর্যপূর্ণ সময় কাটিয়েছেন, তার চেয়ে ১৩ বছরের বড় ম্যাদামের সাথে সত্যিকার অর্থে কি সম্পর্ক ছিল তা এখনো খানিকটা রহস্যে ঘেরা, তবে এটুকু জানা যায় রুশো তাকে কোনদিনই ভুলতে পারেন নি।
319_87873490496_608590496_4157752_288_n
গোটা বাড়ীটি আজ জাদুঘরে রূপান্তরিত, কিন্তু তারচেয়েও বেশী আকর্ষনীয় মনে হল সাথে লাগোয়া বিশাল বাগানটা।
319_87873495496_608590496_4157753_693_n
অতিবিখ্যাত কনফেশন বইখানা লিখে আধুনিক আত্নজীবনী রচনার দিগন্ত উম্মোচন করেন যে দার্শনিক তিনি যে উদ্ভিদবিদ্যা নিয়েও অতি উৎসাহী ছিলেন তা এখানে না এলে জানতে পারতাম না। রুশোর সংগ্রহ করা নানা লতা-গুল্মের সংগ্রহ এখনো জিইয়ে রাখা হয়েছে অতি যত্নের সাথে বংশ পরম্পরায়, গাছগুলোর নাম ফরাসী ও ল্যাটিনে লেখা, একটি বিরল গাছের সাথে এর আবিষ্কার কাহিনীর উল্লেখ্য আছে যা রুশো স্বয়ং পার্বত্য অন্চল থেকে সংগ্রহ করেছিলেন।
319_87873500496_608590496_4157754_1044_n
এর মাঝে বেশকিছু গাছের নাম দেখলাম লাল সাইনবোর্ডে লেখা, সাথের সঙ্গীরা বুঝিয়ে দিল এগুলো বিষাক্ত গাছ! যার জন্য দর্শনার্থীর সতর্ক করা হয়েছে এই উপায়ে।পাথূরে দেয়ালের অন্য পাশে ঝোপ জাতীয় গাছ, বোঝা যায় নানা জাতীয় গাছ-গাছড়া বিশেষ করে বিষাক্ত প্রজাতি গুলোর উপর অপরিসীম আগ্রহ ছিল তার।
ভাবতেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠে, এই বাগানেই দিনের পর দিন পায়চারী করতেন জ্যঁ জ্যাঁক রুশো,মনের গহনে বুনতেন একের পর এক নব নব চিন্তাধারা, জন্ম নিত আলোকিত সব ভাবনার, অমর সব সাহিত্যের। হয়ত এখানেই দাড়িয়ে এমনভাবে নিচের উপত্যকায় শহরপানে তাকাতেন তিনি।
319_87873505496_608590496_4157755_1421_n
দূরের সুউচ্চ আলপ্সের নাম না জানা বরফচূড়ো তখন সূর্যাস্তের কমলা আভায় রাঙ্গানো, আঁধার ঘনায়ছে ধীরে উপত্যকার বুকে, সুন্দর একটি সন্ধ্যা আর মহান দার্শনিক রুশোর স্মৃতির কাছে বিদায় নিয়ে আমরা তখন উৎরাই পেরোতে ব্যস্ত।
( ২০০৮-এর গ্রীষ্মের স্মৃতিচারণ করলাম একটু, আবার যেতে হবে এই জায়গায় নিমন্ত্রণ এসেছে প্যারাগ্লাইডিং-এর, পুরনো বাঁকাচোরা ছবিগুলো দেখতে দেখতে মনে পড়ল সেই সময়ের কথা, লেখায় উল্লেখিত ফরাসী নামগুলোর উচ্চারণে ভুল হয়ে থাকতেই পারে, বিশেষ করা চন্দ্রবিন্দু কোন অজানা কারণে ব্যবহার করতে পারছি না ! )
319_87873455496_608590496_4157745_7714_n

YOUR NAMEAbout Me
আসসালামু আলাইকুম। নবীন বাংলা ব্লগ সাইটে ভিজিট করার জন্য আপনাকে স্বাগতম। আসলে এই ব্লগ সাইটটি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। এবং আমি এই সাইটের এডমিন, মূলত ব্লগিং প্রাকটিস এবং মুক্ত জ্ঞাণ চর্চার জন্যই এই সাইটটি ওপেন করেছি। আমার সাইটের পোস্টগুলো অন্যান্য সুনাম খ্যাত ব্লগ সাইটে সমূহে পাবলিশ করে থাকি তথারুপ টেকটিউন্স, টিউনারপেইজ। ইনশাআল্লাহ যতদিন বেঁচে থাকব নবীন বাংলা ব্লগে লেখালেখি করার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। এখানে অন্যান্য লেখকদের বাছাই করা পোস্টগুলো পাবলিশ করা হয়। এবং ইচ্ছা করলে আপনিও এই ব্লগের অতিথি লেখক হিসাবে শুরু করতে পারেন।পরিশেষে আমার সাইট কিংবা প্রকাশিত লেখা সম্পর্কে কোন আপনাদের অভিযোগ, মতামত, পরামর্শ থাকলে তা সাদরে গ্রহন করা হবে। আবারো ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা সবাইকে!!
Follow : | | Facebook | Twitter

Post a Comment

 
Top