(মূল লেখক: তারেক-অনু, সচালায়তন)
ভূমধ্যসাগর তীরের ভোরের কমলা রঙা রোদ লালচে হয়ে উঠে খেলা করছে আমার বিছানায়, মহানন্দে উবু হয়ে শরীর এলিয়ে সেই আমেজ উপভোগ করছি, এই সময় দরজায় দুমদাম আওয়াজ! কে রে ব্যাটা? দেখি হোস্টেলের রিসেপ্সনিস্ট ছোকরা র্যাদডি, প্রায় হাই মাই চিৎকার করে যা বলল গ্রীকে তার সারমর্ম হচ্ছে, তুমি এখানে পুচ্ছদেশ উপুর করে নিদ্রা দিচ্ছ,আর নিচে তোমার জন্য দুই তরুণী অপেক্ষা করছে!
বলে কি! দুই জন একসাথে! এই সময়ে! কি ঘটনা, কারা, কেন! হুড়মুড় করে আরও নানা প্রশ্ন মাথায় ভেসে উঠল, কিন্তু ছোকরা শুধু বলল, সেরেনা নামের মার্কিন মেয়েটি এসেছে, সাথে আরেকজন, যাও, ওরা তো বলল- তোমাদের একসাথে কোথায় যাবার কথা? হা কপাল, তুমি ঘুরতে যাও, আর আমি হোটেল সামলাই! যত্তোসব!
চোখ রগড়াতে রগড়াতে মনে পড়ল, গতরাতের এক আড্ডায় কার কার সাথে যেন কথা হয়েছিল এথেন্স বন্দর থেকে জাহাজ ধরে কাছের কোন দ্বীপে যাবার। উদ্দাম রাতের পর সে কথা দিব্যি ভুলে দ্বিপ্রহর পর্যন্ত পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছি ! কি লজ্জার কথা!
হুড়মুড় করে সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচতলার অতিথি কক্ষে ঢুকতেই সেরেনা আর ডাচ তরুণী লিজবেথের অপেক্ষারত তিতিবিরক্ত মুখের সাথে চোখাচোখি হল ! ঘাট মেনে দেরী করার শাস্তি হিসেবে নাস্তা না করেই এখনই রওনা দেবার কথা বলে এযাত্রা পার পাওয়া গেল বটে, কিন্তু মুশকিল বাঁধল আপাতগন্তব্য নিয়ে।
পিরেইস বন্দর থেকে জাহাজ ছাড়ে গ্রীসের সব দ্বীপের জন্যই, আসলে গ্রীস নামের অনন্য অসাধারণ দেশটি কেবলমাত্র একটি দেশ নয়, একটি পৃথিবী। এখানকার প্রতিটি দ্বীপ, পর্বতময় অঞ্চলের প্রতিটি উপত্যকাই একেকটি আলাদা দেশ বিশেষ। এখানকার অধিবাসীদের চেহারাতেও এই ফারাকটা ধরা পড়ে সহজেই। ক্রিট, সান্তোরিনি, রোডস, করফু অনেক অনেক দূরে হওয়ায় এযাত্রা তাদের প্রলোভন এড়িয়ে কাছের কোন ইতিহাসময় দ্বীপে যাবার ইচ্ছে ছিল বিশেষ করে হাইড্রা, নামটা শুনলেই পুরাণের সেই দানবের কথা মনে পড়ে। কিন্তু এত দেরীতে যাত্রা শুরু কারণে অন্য সব পরিকল্পনা ভূমধ্যসাগরের লোনা জলে হাবুডুবু খেতে লাগল, এবং দিনের গন্তব্য হিসেবে নির্বাচিত হল ৩০ কিলোমিটার দূরের দ্বীপ এজিনা (Aegina), যা ইতিহাসের কোন এক লগ্নে ছিল খোদ এথেন্সের প্রতিদন্ধি।


পিরেইস জাহাজঘাটায় বেজায় হাকডাক, তখন সেখানে গমগমে ভিড় সবসময় লেগে থাকলেও বর্তমানের মত বিক্ষোভ, জ্বালাও-পোড়াও ছিল না। কত ধরনের মানুষের সমাহার- নাবিক, জেলে, খালাসী, ব্যবসায়ী, চোরাচালানী, ভ্রমণার্থী, ভিক্ষুক, পকেটমার ! সবারই সমান অবদানেই বিশ্বের অন্যতম এক রঙ্গময় বন্দরে পরিণত হয়েছে এটি।
বিশাল সব জাহাজ আলতো ভেসে বেড়াচ্ছে, যাদের সবার শরীরেই উজ্জল রঙে লেখা- হেলেনিক! ট্রয়ের হেলেন না হলেও, হেলেন নামের কোন পয়সাওয়ালা কোম্পানির হবে! সেই সাথে হাইড্রোফয়েল জলযানগুলোও সমানে ভিমগতিতে ছুটে যাচ্ছে দূরের গন্তব্যে। এইখানেও অবাক করা ভাবে এথেন্সের বিখ্যাত স্বাস্থ্যবান তেল চকচকে গৃহমৃগদের সংখ্যায় কোন কমতি নেই।

সকল বাঁধা এড়িয়ে আমাদের ছোট ষ্টীমারে উঠে পড়লাম, নোঙর তুলে যাত্রা শুরু হয়ে গেল মূল ভূখন্ড থেকে দূরে যাবার। প্রপেলারের ঘূর্ণনে সবুজ জল উদ্বেল হয়ে উথেল লক্ষ কোটি বুদবুদে। লোনা বাতাস আর মধ্য দিনের আরামপ্রদ উত্তাপ মুখে নিয়ে উত্তাল সাগরের মাঝেই ডেকে দাঁড়ালাম সবাই।

এজিনা খুব একটা দূরে না পিরেইস থেকে, অল্প সময়ের মাঝেই দেখা গেল সেখানের সবচেয়ে বিখ্যাত পুরাকীর্তি সূর্যদেবতা অ্যাপোলোর ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দির। কেমন রহস্যে ঢাকা চারপাশ। হাজার হাজার বছর ধরে একই নক্ষত্রের নিচে অবস্থান করেও নানা জাতির, নানা শাসকের মাধ্যমে রচিত হয়েছে বর্তমান সভ্যতার পীঠস্থান গ্রীসের ইতিহাস।

ছোট বন্দরটি ব্যতিক্রম কিছু নয়, অসংখ্য নৌকা পটে আঁকা ছবির মত নিশ্চল হয়ে বিশ্রামরত, তাদের পাশেই হয়তবা দুপুরের খাবারের সংস্থানের জন্য ক্যানভাসে তুলির রঙবেরঙের পরশ বুলিয়ে চলেছে প্রবীণ চিত্রকর। যেন জাদুর দৃশ্যকে ধারণ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি এই পুরাণকথার দ্বীপে।

কেন আসলাম এই অখ্যাত স্থানে? দেখাবার, জানবার মত জায়গারতো অভাব নেই এথেন্সে, শহরের ভেতরেই হাঁটা দূরত্বে অন্তত ১৫টা স্থাপত্য আছে যাদের প্রত্যেকের বয়স তিন হাজারের উপর! তাহলে, কেন এই সমস্ত জায়গা ফেলে পর্যটকদের রঙিন চোখে, বেশ অনাকর্ষক এই একরত্তি দ্বীপে।

কারণ, হয়ত আলবেয়ার কামু। কিছুদিন আগেই এই অতি প্রিয় লেখকের ভ্রমণ বিষয়ক এক ছোট প্রবন্ধের পুস্তিকা পড়েছিলাম, দ্য সামার। সেখানে কামু আলজেরিয়ার ওরান নামে এক বিরান মফস্বলের বর্ণনা দিয়েছিলেন, ( চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মনে থাকার কথা সর্বকালের সেরা রোমান্টিক সিনেমার উপাধি প্রাপ্ত ক্যাসাব্লাঙ্কাতে ওরানের নামের উল্লেখ ছিল), খাঁটি আবেগ মোড়া সেই বাক্যগুলোতে ছিল এমন লুকিয়ে থাকা, এড়িয়ে যাওয়া এলাকাগুলোর নিজস্ব আকর্ষণের কথা, তাদের আপন অদ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যগুলোর কথা। ফাঁকা রাস্তার পারের মাঠটির নির্জনতার কথা, ঘুমো ঘেয়ো কুকুরের আর্তনাদের সাথে সাথে দয়ালু কারো আগমন, থমকে থাকা বাতাস, ঘটনা, জীবন, আঙ্গিক- এমন টুকরো টুকরো সব ছবি লিখে দারুণ ভাবে দৃঢ় কণ্ঠে জানিয়েছিলেন এমন স্থানগুলোতে আমাদের কেন যাওয়া উচিত।
হয়ত প্রিয় লেখকের প্রতি সন্মান জানাতেই, হয়ত এমন অনাকর্ষক জায়গার আকর্ষণের সন্ধানে, জীবনের নতুন ব্যতিক্রমী উপাত্তের খোঁজেই এখানে আসা।
কিন্তু লাগছে বেশ, শহরকেন্দ্রটা ক্ষুদে, পুরোটা জুড়েই রেস্তেরা, ক্যাফে, মাছের দোকান। চালু রেস্তোরাঁগুলোর সামনে তারে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে অক্টোপাস! কেন কে জানে?

রান্না করা আট শুঁড়ের জীবটি খেতে যতই সুস্বাদু হোক, তা এমনভাবে দোকানের সামনে ঝুলতে দেখলে ক্ষুধাউদ্রেকের পরিবর্তে খাবারের দোকান এড়িয়ে চলতেই উৎসাহ জোগাবে বলে মনে হল।

ঘোড়ার গাড়ী নিয়ে কোচেয়ানেরা বসে আছে কেউ দ্বীপের চারপাশেই ঘুরে আসতে চায় এমন সওয়ারের আশায়।

তাদের কাছেই দিক নির্দেশনা জেনে সৈকত ঘেঁষেই অবস্থিত এক নৌকা তৈরি কারখানা দেখতে যাওয়া হল। কারিগরদের তখন হয়ত মধ্যাহ্নভোজনের পালা, তাই প্রাণহীন জলযানেরই দেখা মিলল কেবল।


সেই সাথে অবিশ্বাস্য ভাবে দেখা মিলল গ্রীক সাগর দেবতা পোসাইডনের সাথে! যদিও অবস্থাদৃষ্টে মনে হল, তার সেই আগের রাজত্ব আর নেই, জমকালো পোশাক, ঐশ্বরিক অস্ত্র সবকিছুই হারিয়ে পোসাইডন ব্যস্ত ছিলেন বেত দিয়ে কিছু একটা নির্মাণে। সাথের সারমেয়কে অবশ্য প্লুটো বলে মনেও হল না।

দেবতার রোষে কুকুরের গ্রাসে পরিণত হতে চায় না বলেই মানে মানে সরে পড়লাম পেটপুজোর জন্য, শেষ খাবার যে কত বছর আগে খেয়েছি পাকস্থলী আর তা মনে করে পারছে না। গ্রীসে পা দেবার আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিল, যতবার সম্ভব, যত রকমের সম্ভব সামুদ্রিক খাবার খেতে হবে। সেই পরিকল্পনার পুনঃবাস্তবায়নের জন্য দারুণ ভাজা মাছের অমৃতসম গন্ধময় এক ছাদখোলা রেস্তোরাঁয় ঢুঁকে পড়লাম সদলবলে এবং অনুরোধ করলাম অক্টপাসের শুঁড় একটু বেশী করে ভেজে দিতে, সেই সাথে পানীয় হিসেবে স্থানীয় সাংরিয়া।
টুংটাং কথার সাথে সাথে খাবার বেশ দ্রুতই উধাও হতে থাকল পাত থেকে, এমন সময় মনে হল টেবিলে নিচে কিছু একটা খুব আস্তে আস্তে মোলায়েম ভাবে পায়ে ঘষা দিচ্ছে! উঁকি দিতেই এক ফুটফুটে বেড়াল ছানার সাথে পরিচয় হল, জানতে পারলাম কেন গ্রীসের বিড়ালদের বিশ্বের সবচেয়ে ট্রেনিংপ্রাপ্ত শার্দূল বলা হয়, তারা এত ভদ্র ভাবে মিহি সুরে মিউ মিউ করে লেজের ডগাটা নাড়াতে থাকবে যে আপনি বাধ্য হবেন তাকে পাতের মাছের এক রসালো টুকরো ভেঙ্গে দিতে। এবং খানিকক্ষণের মধ্যেই নিজেকে আবিস্কার করবেন এমন আদুরে বিড়ালদের মধ্যমণি হিসেবে!

লিজবেথ কথা প্রসঙ্গে বলল ১০ বছর আগে সে থাইল্যান্ডের এক বিশাল ক্যাটামারানে দারুণ এক সমুদ্র বিহার করেছিল, আমরা সে সময় কি করেছি? এক দশক আগে? সেরেনা তখনও স্কুলের গণ্ডি পেরোয় নি, আর আমি নিজেও কলেজে। নানা দেশ দেখা তো দূরে থাক, একটাই শহর চিনি আমার ব্রহ্মাণ্ড হিসেবে- পদ্মাপারের রাজশাহী। অবশ্য তাতে কোন আফসোস ছিল না, তখনই অন্যভুবনে যাত্রা করলেও রাজশাহীতে সারা জীবনের সুখস্মৃতি সঙ্গী করেই সুখী হতাম।
খাবার পর বাজারের কিছু অলিগলি ঘুরে ঘুরে দেখা হল সেখানকার ব্যবসায়ীদের প্রলোভনের সমস্ত পরিকল্পনা নস্যাৎ করে। বেশ পরিশ্রমী এখানকার স্থানীয়রা, তবে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার প্রাচুর্য খুব একটা আছে বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হল না।

নাবিকদের এক পানশালায় কফিপানের জন্য বিরতি নিতেই দেখা হল সেখানে অবস্থানরত গ্রীকের সাথে, যার মুখমণ্ডল অবিকল বাচ্চাবেলায় ভবেশ রায়ের বইতে দেখা মহাকবি হোমারের মত! এমনই কি ছিলেন সেই অন্ধ মহাকবি?

মাধুকরী কবি কি জীবিকার তাগিদে ভিক্ষার মাঝে মাঝে এভাবেই স্থানীয় কোন পানশালায় বসে মনে মনে রচনা করতেন মহাকাব্যের বিস্ময়কর সব শব্দগুচ্ছ, যা অতিক্রম করার সৌভাগ্য আর কোন সাহিত্যিকের হয় নি গত কয়েক হাজার বছরে!
যদিও গ্রীক পুরুষদের মাঝে দাড়ির চেয়ে পুরুষ্টু গোঁফটা অনেক বেশী প্রচলিত বলে মনে হয়েছে। আর এমন গোঁফ দেখলেই আমার টিনটিনের রনসন- জনসনের কথা মনে পড়ে যায় !

কফি বিরতির পর জাহাজঘাটায় অবস্থিত চিনির দলা গির্জা দেখতে গেলাম, আসলেই ইংরেজিতে এর নাম সুগার কিউব চার্চ! হয়ত এর ক্ষুদে আকৃতির কারণেই অথবা ধবধবে সাদা দেয়ালের জন্য এমন নামকরণ।

আমাদের মূল ভূখণ্ডে ফিরবার সময়ও হয়ে এসেছে, যাত্রীদের ভিড় বাড়তেই আছে তখন জলযানের অপেক্ষায়। সেখানে আবার অপেক্ষায় ছিল গ্রীসের বিখ্যাত ( নাকি কুখ্যাত) অর্থোডক্স খ্রিষ্টানদের কিছু পাঁড় মোল্লা।

সেই সময় ভূমধ্যসাগরের আকাশে দিগন্তে ম্রিয়মাণ অ্যাপোলো, আশ্চর্য মেঘ দল আর শান্ত সমুদ্র মনে করিয়ে দিল-
পৃথিবীর এই সব গল্প বেঁচে রবে চিরকাল; -
এশিরিয়া ধুলো আজ – বেবিলন ছাই হয়ে আছে।

( ঝাপসা ছবিগুলোর জন্য দুঃখিত, ক্যামেরা বাবাজী সেই সময়ে বিশ্রাম নিতে চাওয়ায় মিনি পকেট ক্যামেরা দিয়েই কাজ চালাতে বাধ্য হয়েছিলাম)।
ভূমধ্যসাগর তীরের ভোরের কমলা রঙা রোদ লালচে হয়ে উঠে খেলা করছে আমার বিছানায়, মহানন্দে উবু হয়ে শরীর এলিয়ে সেই আমেজ উপভোগ করছি, এই সময় দরজায় দুমদাম আওয়াজ! কে রে ব্যাটা? দেখি হোস্টেলের রিসেপ্সনিস্ট ছোকরা র্যাদডি, প্রায় হাই মাই চিৎকার করে যা বলল গ্রীকে তার সারমর্ম হচ্ছে, তুমি এখানে পুচ্ছদেশ উপুর করে নিদ্রা দিচ্ছ,আর নিচে তোমার জন্য দুই তরুণী অপেক্ষা করছে!
বলে কি! দুই জন একসাথে! এই সময়ে! কি ঘটনা, কারা, কেন! হুড়মুড় করে আরও নানা প্রশ্ন মাথায় ভেসে উঠল, কিন্তু ছোকরা শুধু বলল, সেরেনা নামের মার্কিন মেয়েটি এসেছে, সাথে আরেকজন, যাও, ওরা তো বলল- তোমাদের একসাথে কোথায় যাবার কথা? হা কপাল, তুমি ঘুরতে যাও, আর আমি হোটেল সামলাই! যত্তোসব!
চোখ রগড়াতে রগড়াতে মনে পড়ল, গতরাতের এক আড্ডায় কার কার সাথে যেন কথা হয়েছিল এথেন্স বন্দর থেকে জাহাজ ধরে কাছের কোন দ্বীপে যাবার। উদ্দাম রাতের পর সে কথা দিব্যি ভুলে দ্বিপ্রহর পর্যন্ত পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছি ! কি লজ্জার কথা!
হুড়মুড় করে সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচতলার অতিথি কক্ষে ঢুকতেই সেরেনা আর ডাচ তরুণী লিজবেথের অপেক্ষারত তিতিবিরক্ত মুখের সাথে চোখাচোখি হল ! ঘাট মেনে দেরী করার শাস্তি হিসেবে নাস্তা না করেই এখনই রওনা দেবার কথা বলে এযাত্রা পার পাওয়া গেল বটে, কিন্তু মুশকিল বাঁধল আপাতগন্তব্য নিয়ে।
পিরেইস বন্দর থেকে জাহাজ ছাড়ে গ্রীসের সব দ্বীপের জন্যই, আসলে গ্রীস নামের অনন্য অসাধারণ দেশটি কেবলমাত্র একটি দেশ নয়, একটি পৃথিবী। এখানকার প্রতিটি দ্বীপ, পর্বতময় অঞ্চলের প্রতিটি উপত্যকাই একেকটি আলাদা দেশ বিশেষ। এখানকার অধিবাসীদের চেহারাতেও এই ফারাকটা ধরা পড়ে সহজেই। ক্রিট, সান্তোরিনি, রোডস, করফু অনেক অনেক দূরে হওয়ায় এযাত্রা তাদের প্রলোভন এড়িয়ে কাছের কোন ইতিহাসময় দ্বীপে যাবার ইচ্ছে ছিল বিশেষ করে হাইড্রা, নামটা শুনলেই পুরাণের সেই দানবের কথা মনে পড়ে। কিন্তু এত দেরীতে যাত্রা শুরু কারণে অন্য সব পরিকল্পনা ভূমধ্যসাগরের লোনা জলে হাবুডুবু খেতে লাগল, এবং দিনের গন্তব্য হিসেবে নির্বাচিত হল ৩০ কিলোমিটার দূরের দ্বীপ এজিনা (Aegina), যা ইতিহাসের কোন এক লগ্নে ছিল খোদ এথেন্সের প্রতিদন্ধি।
পিরেইস জাহাজঘাটায় বেজায় হাকডাক, তখন সেখানে গমগমে ভিড় সবসময় লেগে থাকলেও বর্তমানের মত বিক্ষোভ, জ্বালাও-পোড়াও ছিল না। কত ধরনের মানুষের সমাহার- নাবিক, জেলে, খালাসী, ব্যবসায়ী, চোরাচালানী, ভ্রমণার্থী, ভিক্ষুক, পকেটমার ! সবারই সমান অবদানেই বিশ্বের অন্যতম এক রঙ্গময় বন্দরে পরিণত হয়েছে এটি।
বিশাল সব জাহাজ আলতো ভেসে বেড়াচ্ছে, যাদের সবার শরীরেই উজ্জল রঙে লেখা- হেলেনিক! ট্রয়ের হেলেন না হলেও, হেলেন নামের কোন পয়সাওয়ালা কোম্পানির হবে! সেই সাথে হাইড্রোফয়েল জলযানগুলোও সমানে ভিমগতিতে ছুটে যাচ্ছে দূরের গন্তব্যে। এইখানেও অবাক করা ভাবে এথেন্সের বিখ্যাত স্বাস্থ্যবান তেল চকচকে গৃহমৃগদের সংখ্যায় কোন কমতি নেই।
সকল বাঁধা এড়িয়ে আমাদের ছোট ষ্টীমারে উঠে পড়লাম, নোঙর তুলে যাত্রা শুরু হয়ে গেল মূল ভূখন্ড থেকে দূরে যাবার। প্রপেলারের ঘূর্ণনে সবুজ জল উদ্বেল হয়ে উথেল লক্ষ কোটি বুদবুদে। লোনা বাতাস আর মধ্য দিনের আরামপ্রদ উত্তাপ মুখে নিয়ে উত্তাল সাগরের মাঝেই ডেকে দাঁড়ালাম সবাই।
এজিনা খুব একটা দূরে না পিরেইস থেকে, অল্প সময়ের মাঝেই দেখা গেল সেখানের সবচেয়ে বিখ্যাত পুরাকীর্তি সূর্যদেবতা অ্যাপোলোর ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দির। কেমন রহস্যে ঢাকা চারপাশ। হাজার হাজার বছর ধরে একই নক্ষত্রের নিচে অবস্থান করেও নানা জাতির, নানা শাসকের মাধ্যমে রচিত হয়েছে বর্তমান সভ্যতার পীঠস্থান গ্রীসের ইতিহাস।
ছোট বন্দরটি ব্যতিক্রম কিছু নয়, অসংখ্য নৌকা পটে আঁকা ছবির মত নিশ্চল হয়ে বিশ্রামরত, তাদের পাশেই হয়তবা দুপুরের খাবারের সংস্থানের জন্য ক্যানভাসে তুলির রঙবেরঙের পরশ বুলিয়ে চলেছে প্রবীণ চিত্রকর। যেন জাদুর দৃশ্যকে ধারণ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি এই পুরাণকথার দ্বীপে।
কেন আসলাম এই অখ্যাত স্থানে? দেখাবার, জানবার মত জায়গারতো অভাব নেই এথেন্সে, শহরের ভেতরেই হাঁটা দূরত্বে অন্তত ১৫টা স্থাপত্য আছে যাদের প্রত্যেকের বয়স তিন হাজারের উপর! তাহলে, কেন এই সমস্ত জায়গা ফেলে পর্যটকদের রঙিন চোখে, বেশ অনাকর্ষক এই একরত্তি দ্বীপে।
কারণ, হয়ত আলবেয়ার কামু। কিছুদিন আগেই এই অতি প্রিয় লেখকের ভ্রমণ বিষয়ক এক ছোট প্রবন্ধের পুস্তিকা পড়েছিলাম, দ্য সামার। সেখানে কামু আলজেরিয়ার ওরান নামে এক বিরান মফস্বলের বর্ণনা দিয়েছিলেন, ( চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মনে থাকার কথা সর্বকালের সেরা রোমান্টিক সিনেমার উপাধি প্রাপ্ত ক্যাসাব্লাঙ্কাতে ওরানের নামের উল্লেখ ছিল), খাঁটি আবেগ মোড়া সেই বাক্যগুলোতে ছিল এমন লুকিয়ে থাকা, এড়িয়ে যাওয়া এলাকাগুলোর নিজস্ব আকর্ষণের কথা, তাদের আপন অদ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যগুলোর কথা। ফাঁকা রাস্তার পারের মাঠটির নির্জনতার কথা, ঘুমো ঘেয়ো কুকুরের আর্তনাদের সাথে সাথে দয়ালু কারো আগমন, থমকে থাকা বাতাস, ঘটনা, জীবন, আঙ্গিক- এমন টুকরো টুকরো সব ছবি লিখে দারুণ ভাবে দৃঢ় কণ্ঠে জানিয়েছিলেন এমন স্থানগুলোতে আমাদের কেন যাওয়া উচিত।
হয়ত প্রিয় লেখকের প্রতি সন্মান জানাতেই, হয়ত এমন অনাকর্ষক জায়গার আকর্ষণের সন্ধানে, জীবনের নতুন ব্যতিক্রমী উপাত্তের খোঁজেই এখানে আসা।
কিন্তু লাগছে বেশ, শহরকেন্দ্রটা ক্ষুদে, পুরোটা জুড়েই রেস্তেরা, ক্যাফে, মাছের দোকান। চালু রেস্তোরাঁগুলোর সামনে তারে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে অক্টোপাস! কেন কে জানে?
রান্না করা আট শুঁড়ের জীবটি খেতে যতই সুস্বাদু হোক, তা এমনভাবে দোকানের সামনে ঝুলতে দেখলে ক্ষুধাউদ্রেকের পরিবর্তে খাবারের দোকান এড়িয়ে চলতেই উৎসাহ জোগাবে বলে মনে হল।
ঘোড়ার গাড়ী নিয়ে কোচেয়ানেরা বসে আছে কেউ দ্বীপের চারপাশেই ঘুরে আসতে চায় এমন সওয়ারের আশায়।
তাদের কাছেই দিক নির্দেশনা জেনে সৈকত ঘেঁষেই অবস্থিত এক নৌকা তৈরি কারখানা দেখতে যাওয়া হল। কারিগরদের তখন হয়ত মধ্যাহ্নভোজনের পালা, তাই প্রাণহীন জলযানেরই দেখা মিলল কেবল।
সেই সাথে অবিশ্বাস্য ভাবে দেখা মিলল গ্রীক সাগর দেবতা পোসাইডনের সাথে! যদিও অবস্থাদৃষ্টে মনে হল, তার সেই আগের রাজত্ব আর নেই, জমকালো পোশাক, ঐশ্বরিক অস্ত্র সবকিছুই হারিয়ে পোসাইডন ব্যস্ত ছিলেন বেত দিয়ে কিছু একটা নির্মাণে। সাথের সারমেয়কে অবশ্য প্লুটো বলে মনেও হল না।
দেবতার রোষে কুকুরের গ্রাসে পরিণত হতে চায় না বলেই মানে মানে সরে পড়লাম পেটপুজোর জন্য, শেষ খাবার যে কত বছর আগে খেয়েছি পাকস্থলী আর তা মনে করে পারছে না। গ্রীসে পা দেবার আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিল, যতবার সম্ভব, যত রকমের সম্ভব সামুদ্রিক খাবার খেতে হবে। সেই পরিকল্পনার পুনঃবাস্তবায়নের জন্য দারুণ ভাজা মাছের অমৃতসম গন্ধময় এক ছাদখোলা রেস্তোরাঁয় ঢুঁকে পড়লাম সদলবলে এবং অনুরোধ করলাম অক্টপাসের শুঁড় একটু বেশী করে ভেজে দিতে, সেই সাথে পানীয় হিসেবে স্থানীয় সাংরিয়া।
টুংটাং কথার সাথে সাথে খাবার বেশ দ্রুতই উধাও হতে থাকল পাত থেকে, এমন সময় মনে হল টেবিলে নিচে কিছু একটা খুব আস্তে আস্তে মোলায়েম ভাবে পায়ে ঘষা দিচ্ছে! উঁকি দিতেই এক ফুটফুটে বেড়াল ছানার সাথে পরিচয় হল, জানতে পারলাম কেন গ্রীসের বিড়ালদের বিশ্বের সবচেয়ে ট্রেনিংপ্রাপ্ত শার্দূল বলা হয়, তারা এত ভদ্র ভাবে মিহি সুরে মিউ মিউ করে লেজের ডগাটা নাড়াতে থাকবে যে আপনি বাধ্য হবেন তাকে পাতের মাছের এক রসালো টুকরো ভেঙ্গে দিতে। এবং খানিকক্ষণের মধ্যেই নিজেকে আবিস্কার করবেন এমন আদুরে বিড়ালদের মধ্যমণি হিসেবে!
লিজবেথ কথা প্রসঙ্গে বলল ১০ বছর আগে সে থাইল্যান্ডের এক বিশাল ক্যাটামারানে দারুণ এক সমুদ্র বিহার করেছিল, আমরা সে সময় কি করেছি? এক দশক আগে? সেরেনা তখনও স্কুলের গণ্ডি পেরোয় নি, আর আমি নিজেও কলেজে। নানা দেশ দেখা তো দূরে থাক, একটাই শহর চিনি আমার ব্রহ্মাণ্ড হিসেবে- পদ্মাপারের রাজশাহী। অবশ্য তাতে কোন আফসোস ছিল না, তখনই অন্যভুবনে যাত্রা করলেও রাজশাহীতে সারা জীবনের সুখস্মৃতি সঙ্গী করেই সুখী হতাম।
খাবার পর বাজারের কিছু অলিগলি ঘুরে ঘুরে দেখা হল সেখানকার ব্যবসায়ীদের প্রলোভনের সমস্ত পরিকল্পনা নস্যাৎ করে। বেশ পরিশ্রমী এখানকার স্থানীয়রা, তবে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার প্রাচুর্য খুব একটা আছে বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হল না।
নাবিকদের এক পানশালায় কফিপানের জন্য বিরতি নিতেই দেখা হল সেখানে অবস্থানরত গ্রীকের সাথে, যার মুখমণ্ডল অবিকল বাচ্চাবেলায় ভবেশ রায়ের বইতে দেখা মহাকবি হোমারের মত! এমনই কি ছিলেন সেই অন্ধ মহাকবি?
মাধুকরী কবি কি জীবিকার তাগিদে ভিক্ষার মাঝে মাঝে এভাবেই স্থানীয় কোন পানশালায় বসে মনে মনে রচনা করতেন মহাকাব্যের বিস্ময়কর সব শব্দগুচ্ছ, যা অতিক্রম করার সৌভাগ্য আর কোন সাহিত্যিকের হয় নি গত কয়েক হাজার বছরে!
যদিও গ্রীক পুরুষদের মাঝে দাড়ির চেয়ে পুরুষ্টু গোঁফটা অনেক বেশী প্রচলিত বলে মনে হয়েছে। আর এমন গোঁফ দেখলেই আমার টিনটিনের রনসন- জনসনের কথা মনে পড়ে যায় !
কফি বিরতির পর জাহাজঘাটায় অবস্থিত চিনির দলা গির্জা দেখতে গেলাম, আসলেই ইংরেজিতে এর নাম সুগার কিউব চার্চ! হয়ত এর ক্ষুদে আকৃতির কারণেই অথবা ধবধবে সাদা দেয়ালের জন্য এমন নামকরণ।
আমাদের মূল ভূখণ্ডে ফিরবার সময়ও হয়ে এসেছে, যাত্রীদের ভিড় বাড়তেই আছে তখন জলযানের অপেক্ষায়। সেখানে আবার অপেক্ষায় ছিল গ্রীসের বিখ্যাত ( নাকি কুখ্যাত) অর্থোডক্স খ্রিষ্টানদের কিছু পাঁড় মোল্লা।
সেই সময় ভূমধ্যসাগরের আকাশে দিগন্তে ম্রিয়মাণ অ্যাপোলো, আশ্চর্য মেঘ দল আর শান্ত সমুদ্র মনে করিয়ে দিল-
পৃথিবীর এই সব গল্প বেঁচে রবে চিরকাল; -
এশিরিয়া ধুলো আজ – বেবিলন ছাই হয়ে আছে।
( ঝাপসা ছবিগুলোর জন্য দুঃখিত, ক্যামেরা বাবাজী সেই সময়ে বিশ্রাম নিতে চাওয়ায় মিনি পকেট ক্যামেরা দিয়েই কাজ চালাতে বাধ্য হয়েছিলাম)।

Post a Comment