0
 (মূল লেখক- তারেক-অনু)

৮০০ বছর আগের এক ঝড়ের রাতে প্রবল প্রতাপশালী অ্যাজটেক সম্রাট দৈববাণীর মত স্বপ্ন দেখলেন- বিশাল এক ক্যাকটাসের মাথায় বসে একটি বিষধর সাপকে চঞ্চু আর নখর দিয়ে ফালি ফালি করে ছিড়ে খাচ্ছে পাখির রাজা ঈগল। ভেবেই নিলেন, যেমন স্বপ্নে ঐশী বাণী পাওয়া মানুষেরা ভেবে নেয়, এটি নিশ্চয়ই কোন শুভ লক্ষণ। এমন স্থান খুঁজে বাহির করে সেখানেই গড়তে হবে অ্যাজটেকদের নতুন নগরী। যুদ্ধংদেহী রণোম্মাদ অ্যাজটেক যোদ্ধাদের রাজার হুকুম মানেই ঈশ্বরের অমোঘ বাণী, আর সেই সাথে ধর্মের ধ্বজাধারী ভণ্ড পুরোহিত মোল্লারাতো ছিলই ইন্ধন জোগাতে। দিকে দিকে যেতে লাগল যোদ্ধারা, সেই শুভ লক্ষণের খোঁজে।
এর মধ্যে এক গোত্রপতি উপত্যকা ঘেরা এক সবুজ জলাভূমিতে বিশ্রামের জন্য আস্তানা গাড়ার পরিকল্পনা করছিলেন, খানিকতে দোনমনায় ভুগছিলেন বটে, কিন্তু সেই সময়ই মাথার উপর দিয়ে আলসে ভঙ্গীতে চলে গেল বিশাল এক ছায়া, রোদ ঠেকানোর জন্য চোখের সামনে হাত তুলতেই দেখা মিলল এক ঈগলের রাজকীয় উড়াল, আকাশ জোড়া ডানা মেলে গোটা দুই চক্কর দিয়ে জলার সামনের এক ক্যাকটাসে বসল বিশ্রামের জন্য। আরে, অবাক কাণ্ড, এর পরপরই যে ক্ষুরধার বাঁকানো চঞ্চু দিয়ে পায়ে থেকে কি যেন খুবলে খুবলে খেতে থাকল মজাসে!
রক্তে অ্যাড্রিনালিনের স্রোত বয়ে গেল সর্দারের, এই কি সেই পুণ্যভূমি যার খোঁজে যারা আদিগন্ত চষে চলেছে এতগুলো ঘর্মাক্ত দিন? খুব সাবধানে নিজেকে পারলে মাটির সাথে মিশিয়ে সামনে এগোলেন তিনি, চোখ পড়ল ঈগলের খাদ্যবস্তুটির দিকে, আর কোন সন্দেহ হয়, চিৎকার করে মহান দেবতা কেটজালকোয়াটলকে ধন্যবাদ দিলেন, মনের গভীরে একটা আশাও ঝিলিক দিয়ে গেল- হয়ত কেটজালকোয়াটলই স্বয়ং এসেছেন পাখিটির রূপ ধরে, দেবদর্শনের সাথে সাথে মিলে গেল তার ভবিষ্যৎ অ্যাজটেক সাম্রাজ্যের রাজধানীর অবস্থান!
দিন গড়িয়ে বছর হল, সেই জলাভূমিতেই গড়ে উঠল জলের মাঝে আজব শহর, মানুষগুলো ভাসমান মাচায় সবজি উৎপন্ন করে, নৌকা করে ঘুরে বেড়ায়, আবার পুজোর জন্য যায় ৩০ কিমি দূরের তিওতিহুয়াকান শহরে, দিন দিন বাড়তে থাকল নগরীর জনসংখ্যা। একসময় পৃথিবীর প্রথম মেট্রোপলিটান সিটি হয় এই অদ্ভুত শহরটি, অর্থাৎ এইখানেই প্রথম জনসংখ্যা এক মিলিয়ন ছাড়িয়ে যায় ( এক পর্যায়ে অবশ্য বিশ্বের সবচেয়ে বড় শহরের পরিণত হয় সে, কিন্ত তখন তার নাম হয়ে গিয়েছে মেক্সিকো সিটি! ) , যখন একই গ্রহের আরেক মহাদেশে নোংরা দৈনন্দিন জীবন যাপনের কারণে গোসলের অভাবে প্লেগের বিস্তার ঘটে বিস্তর মানুষ মারা যাচ্ছে ইউরোপে তখন সেই অ্যাজটেক শহরের বাসিন্দারা প্রত্যহ দুইবার গোসল করত!
তাই যখন সাগর পাড়ি দেওয়া লুটেরা স্প্যানিয়ার্ডের দল যখন এই মর্ত্যের অমরাবতী দেখে তারা বিস্ময়ে পুলকিত হয়ে সেই সৌন্দর্য উপভোগের সাথে সাথে প্রাচীন সভ্যতার সমস্ত নিদর্শন এবং ইতিহাস গুঁড়িয়ে দিয়ে ১৫২১ সালে টলেডো ইস্পাতের আঁচড়ে নতুন যুগের সূচনা করে। কিন্তু দেশটির পতাকায় থেকে যায় অ্যাজটেক সম্রাটের দেখা স্বপ্ন- ক্যাকটাস, ঈগল ও শিকার পরিণত হওয়া সাপ !
এর ৪৯০ বছর পরে ২০১১ সালের ৩০ ডিসেম্বর তারেক অণু নামের এক বঙ্গসন্তান একই শহরে পদার্পণ করে হাওয়াই জাহাজে চেপে, এটা তারই গল্প, সেই হারিয়ে যাওয়া সভ্যতার কাহিনী, অপরূপ দেশ আর দেশবাসীর আলেখ্য-
মেক্সিকো সিটিতে নতুন বছরের প্রাক্কালে আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে বুকে টেনে নিল দুইজন, একজন আমার মেক্সিকান ভাই ইসাইয়াস সেরণা, যার সাথে দুই বছর আগে শেষ দেখা হয়েছিল এথেন্সের রাস্তায় এবং অপর জন্য অ্যাজটেক বৃষ্টি দেবতা টিলালক, মনের সুখে গোটা শহরকে ভিজিয়ে চলেছে তো চলেছেই, সেই সাথে বিটিভির সংবাদের মত আছে বজ্রসহ ঝড়! শুনলাম গত দুই সপ্তাহে এমন রুদ্র নাচ আর নাচেনি টিলালক, কিন্তু আজ মনের সুখ মিটিয়ে তাথৈ তাথৈ করেই যাচ্ছে। কালবৈশাখীর দেশের মানুষ, এমন ঝড়কে থোড়াই কেয়ার করি! আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টিকে সাথী করেই খুঁজে বের করলাম বিশ্বের সবচেয়ে বড় শহরটির ( ইদানীং অবশ্য বলা হচ্ছে টোকিও সবচেয়ে বড়) এক প্রান্তে অবস্থিত আমাদের হোটেল।
এখানে আসাটা অবশ্য হঠাৎ করেই যেমন ঘটে নি তেমনি খুব সহজও হয় নি, গত দুই বছর ধরেই ইয়াইয়াসের সাথে নিরবিচ্ছিন পত্র চালাচালি চলছিল ল্যাতিন আমেরিকার ভ্রমণের সব খুঁটিনাটি নিয়ে, সেই সাথে মূল সমস্যা তৈরি করেছিল মেক্সিকান অ্যাম্বাসী- তারা জানাল ভিসা দিতে তাদের বিশেষ সমস্যা আছে যেহেতু আমার পাসপোর্টটা খুব সন্দেহজনক ধরনের সবুজ! সেই সাথে জানিয়ে কৃতার্থ করল যে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা থাকলে মেক্সিকোর ভিসা লাগে না ! কি আজব, আমেরিকা যাচ্ছি না তো, তাহলে তো তাদের অ্যাম্বাসিতেই যেতাম, যেতে চাইছি আমেরিকার চেয়ে অনেক অনেক গুণে বৈচিত্রময় দেশ মেক্সিকোতে।
আবার ফ্যাঁকড়া, প্রায় পনের ধরনের কাগজ চাইল, তার মধ্যে নিজের নাম যে পুলিশের কালো রেকর্ডে নথিবদ্ধ নেই তার প্রমাণ পর্যন্ত ছিল, এতেও শেষ নয়, নিজে উপস্থিত থেকে নাকি ভিসার জন্য নিয়মরক্ষার ইন্টারভিউও দিতে হবে, তাদের মহা ব্যস্ততার মাঝে অনেক ঝামেলা করে ২৮ ডিসেম্বর দুপুর এগারটায় ২০ মিনিটের সময় দিয়ে ধন্য করল। অথচ তার পরের দিনই যাত্রা শুরু, প্লেনের টিকেট কাটা আছে চর মাস আগে থাকে, কি মুশকিল! গেলাম সেখানে ব্যাকপ্যাক ভর্তি নিজের মেক্সিকোতে পালিয়ে না যাবার পক্ষের প্রমাণ নিয়ে ( মেক্সিকোর উত্তর সীমান্তকে ব্যবহার করে কোটি কোটি মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অনুপ্রবেশ করে, যে কারণে এত কড়াকড়ি) , সব দেখে দুই আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে রেটিনা স্ক্যান করানোর পর জানানো হল তারা আমাকে ভিসা দিতে অপারগ!
অধিক শোকে মানুষ পাথর হয়, আমি বরফের নিচে জমাট বাঁধা শোকের হিমালয় হয়ে গেলাম, অনেক কষ্টে কোঁকাতে কোঁকাতে কারণ জিজ্ঞাসা করতেই জানাল যেহেতু আমার বিমান টিকিটে লেখা আছে যাবার গন্তব্য মেক্সিকো সিটি কিন্তু ইউরোপে ফিরে আসব ব্রাজিলের রিও থেকে, মানে অন্য দেশ থেকে, তাই তারা ভিসা ইস্যু করতে পারবে না! শেষমেশ অনেক নাটকের পরে ভিসা অফিসার মহিলা কৃতার্থ করে জানাল, তাদের পক্ষে ৯০ দিনের জন্য ট্রানজিট ভিসা দেওয়া সম্ভব!

তখন আর কোন রকম তর্কের সময় নেই, পরের দিন ফ্লাইট! তাই সই, কিন্তু মুশকিল হয়ে গেল গাড়ীতে মেক্সিকো ভ্রমণের মাঝে আমাদের গুয়াতেমালা আর বেলিজ যাবার কথা পাকাপাকি হয়ে আছে, এখন ট্রানজিট ভিসা নিলে মেক্সিকো থেকে একবার বেরোলেই আবার প্রবেশের জন্য নতুন ভিসা নিতে হবে, আবার একই ফ্যাঁকড়া! আচ্ছা, পরেরটা পরে দেখা যাবে, এখনের নগদটা নিয়ে নিই, এইভাবেই শেষ হল সেই মহাভিসারণ! ( অন্য দেশের গুলোর কথা যথাসময়ে আসবে)
পরদিন সকালেই সেই হোটেলের মালিক আমাদের জন্য গরম গরম নাস্তা ও কফি পরিবেশনের সাথে সাথে ধীরগতির ইংরেজিতে অনেক অনেক দশক আগে তার ইউরোপ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বয়ান করলেন, সেই সাথে বিলুপ্ত কিছু দেশের নাম বললেন যেগুলো তার যাওয়া হয়েছিল- যুগোস্লাভিয়া, চেকস্লোভাকিয়া!

অমায়িক ভদ্রলোক পই পই করে বলে দিলেন সাবধানে চোখ-কান খোলা রেখে ঘুরতে! বিশ্বের সবচেয়ে অপরাধপ্রবণ শহরগুলোর মধ্যে এটি একটি। বিশেষ করে সাথে ক্যামেরা নিয়ে ঘোরা মহা ঝুঁকিপূর্ণ।
ট্যাক্সিতে ওঠার পরপরই চোখে পড়ল জানালায় সাঁটা ড্রাইভারের পরিচয়, ঠিকানা, লাইসেন্স নং সহ বিশাল ছবি সহ এক পোস্টার আকৃতির কাগজ! ইয়াইয়াস মহা ঘোড়েল ছোকরা, সে বলল এমন পরিচয়পত্র না থাকলে সে এই ট্যাক্সিতে উঠত না, কারণ মেক্সিকো সিটির সিংহভাগ অপহরণই হয় ভুয়া ট্যাক্সির সাহায্যে! কি গেরো রে বাবা! কিন্তু আমাদের অপহরণ করবে কেন? কারণ পর্যটক দেখলেই তারা বুঝতে পারে যে অন্তত এদের কাছে রাহা খরচ হিসেবে কিছু মালকড়ি পাওয়া যাবে!
কিছু বিশেষ বিশেষ স্থান দেখার মানসে বেরিয়েছিলাম সাহস করে এই মহানগরীতে, কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয় এখানে সবকিছুই গভীর মনোযোগে অবলোকনের মত, বিশেষ করে পাতাল রেলে উঠে সেই ধারনাটা আরও অনেক দৃঢ় হল। পাতাল রেল চলা শুরু করার সাথে সাথেই শুরু হল বিচিত্র বাদ্যযন্ত্র হাতে এক গায়ক-বাদকের আগমন, মিনিটখানেক সেই করতালের মতো জিনিসটি বাজিয়ে গান গেয়ে পরে সন্মানী চাইতে আসল, তারপর আসল এক চিরুনি বিক্রেতা, তার পণ্যের গুনাগুণ বর্ণনা করতে করতে কেবল মুখে ফেনা তুলতে বাকী রাখল, কথার ফুলঝুরি যে সে ভালই ফোঁটাতে পারে তার প্রমাণ পাওয়া গেল গোটাকতক চিরুনি বিক্রি হওয়ায়।
এর মধ্যে পরের ষ্টেশন চলে এসেছে, এতক্ষণ যাত্রীদের কাতারে বসে থাকা দুইটি ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে দাড়িয়ে সবার কাছে কাছে একটা চিরকুট রেখে যেতে গেল, তাতে দেখি লেখা আছে তারা আর্থিক সমস্যার কারণে বাড়ী ভাড়া দিতে পারছে না, সাহায্যের আকুল আবেদন জানিয়ে লেখা খানকতক শব্দে মন ভীষণ আদ্র হয়ে উঠল ঠিকই, কিন্তু সাথে সাথে মেজাজ চটে উঠল সেই বাবা-মার ওপর যারা এমন দেবশিশুদের অন্যের অনুগ্রহ ভিক্ষার জন্য এই জনসমুদ্রে ছেড়ে দিয়েছে।
ততক্ষণে চলে এসেছেন দুই সিডিওয়ালা, নিঃসন্দেহে পাইরেটেড সিডি! বেশ শৃঙ্খলার সাথে প্রথমজন আগে তার সিডি বাজালেন কয়েক মুহূর্ত, ঝাকানাকা রক টাইপের গান, সেই সিডি বিক্রি শুরু করতেই অন্যজন তার পুরনো দিনের ক্ল্যাসিকাল গানের সিডি বাজানো শুরু করল, হুলিও ইগলেসিয়াসের গমগমে কণ্ঠে সারা মহাবিশ্ব আচ্ছন্ন হয়ে উঠল খানিকক্ষণের জন্য ( তিনি গায়ক কাম অভিনেতা এনরিক ইগলেসিয়াসের বাবা, ল্যাতিনের কিংবদন্তী ), সিডি বিক্রি থেমে যেতেই পরের ষ্টেশনে উঠে এল মলমওয়ালা!
ঠিক যেন বাংলাদেশের কোন মুড়ির টিন সার্ভিস, একের পর এক ক্যানভাসাররা হেঁকে যাচ্ছে পণ্যের দ্রব্যগুণ, ঘর্মাক্ত কলরবে মুখর চারিপাশ, কিন্তু মোটামুটি শৃঙ্খলা বজায় আছে সবখানেই।
IMG_0212
মনে হল জীবন মেলার মাঝখানে এসে পড়েছি, চারিদিকে কত ক্ষুদে ক্ষুদে ঘটনা ঘটে চলেছে অবিরাম- অভিমানী প্রেমিকার মান ভাঙ্গাতে ব্যস্ত অসহায় প্রেমিক, গাঢ় ঘুম ভেঙ্গে অফিস যাবার পথে হাই তুলতে তুলতে বিরক্তি প্রকাশ করছে কোন পৌঢ়, কিশোরের দলের তুমুল তর্ক চলছে নিজের পছন্দের গায়িকা নিয়ে, চোখের কোণে আশাভঙ্গের ছাপ নিয়ে বসে আছেন রেড ইন্ডিয়ান বৃদ্ধা, কত আবেগের বহিঃপ্রকাশ, ঘটনার ঘনঘটা, একজন লেখক মনে হয় একবেলা মেক্সিকো সিটির পাতাল রেলে চাপলেই যত লেখার খোরাক পাবেন তা কাগজে এঁকে দিব্যি কয়েক সপ্তাহ চলতে পারবেন। আচ্ছা, এই জন্যই কি বিশ্বের জীবিত শ্রেষ্ঠ লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ অন্য মহাদেশে জন্ম নিয়ে, প্রায় সারা পৃথিবী ঘুরে এসে এখানেই স্থায়ী আস্তানা গেড়েছেন? যাতে অফুরন্ত গল্পের ধারণার কোন অভাব না হয় কোনদিনই!
মার্কেজ নিশ্চয়ই এখন আর পাতাল রেলে ভ্রমণের বিলাসিতা করার সুযোগ পান না খ্যাতির ভিড়ে আর সময়ের অভাবে, তারপর তার তারুণ্যের উম্মাতাল দিনগুলোর কিছু সময় তো এই শহরেই কেটেছে, হয়ত কিছু অমর গল্পের ধারণা তার এসে ছিল এইখান থেকেই।
আমাদের হাতে সময় বরাবরের মতই অপ্রতুল, বিশেষ করে নববর্ষ উদযাপনের জন্য যেতে হবে দূরের ভেরাক্রুজ রাজ্যে, সেই তালেই চরকির মত কিছু স্থান ঘুরে সব জাদুঘর দর্শন এযাত্রা মুলতুবি রেখে যাওয়া হল অ্যাজটেকদের প্রাচীন শহর তেওতিহুয়াকান দর্শনে।
ফেরার পথে ঘটল এক আজব ঘটনা, মিলিটারির এক বিশেষ দল খামোখা বাস এক পাশে দাড় করিয়ে সবাইকে নেমে রাস্তায় দাড়াতে বলল কাঠফাটা রোদের মাঝে! একি মগের মুল্লুক নাকি! আরামের বাস থেকে নেমে রোদের মাঝখানে? হাতে অস্ত্র থাকলেই যে মানুষের বুদ্ধি লোপ পায় তাতো আর নতুন কিছু না! শাপ-শাপান্ত করতে করতে বাস থেকে নেমে অন্যদের সাথে লাইনে দাড়িয়ে থাকতে থাকতে এমন অনুসন্ধানের কারণ শুনলাম- মাদক! সারা ল্যাতিন আমেরিকা থেকে আসা টন টন মাদক মেক্সিকো হয়েই যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করে, তাই উত্তর সীমান্তে যেমন কড়াকড়ি তেমন দেশের মাঝেও থেকে থেকেই তল্লাশি চালানো হয় সব ধরনের যানবাহনে!
IMG_0210
বিশাল এই শহর, পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে নানা উপত্যকার মাঝে ঘটেছে নানা দিকে বিস্তার, মেক্সিকো সিটির কুখ্যাত দূষিত বাতাসের এটিও একটি কারণ, চারিদিক পাহাড় ঘেরা হওয়ায় বাতাস সহজে সঞ্চালিত হয়ে স্থান পরিবর্তন করতে পারে না, আর উপত্যকার গভীরে থেকে বাহির হওয়া মেঘের পক্ষেই মুশকিল, বাতাস তো কোন ছার! ( তবে যন্ত্র দিয়ে মেপে দেখা গেছে ঢাকার বাতাসের তুলনায় মেক্সিকো সিটির বাতাস প্রায় দূষণহীন!)
IMG_0207
একটা জিনিস খুব বেশী মাত্রায় অবাক করেছে মেক্সিকোতে তার হল ওয়্যারলেস ইন্টারনেটের প্রাচুর্য, যে কোন জায়গায়- একটু ভাল রেস্তোরাঁয়, ক্যাফেতে, সব হোটেল- হোস্টেলে এমনকি দুরপাল্লার বাসগুলোতেও! যখন গোধূলিলগ্নে চলুলা শহরের বাসে চেপে শহর ছাড়িয়ে যেতে যেতে আকাশ দখল করে রাখা বরফ ঢাকা জীবন্ত আগ্নেয়গিরি পোপোকাতেপেটেলের জ্বালামুখ দিয়ে বেরুনো ধুয়োর অবশ করা সৌন্দর্য দেখছি, পাশের আসনে ইসাইয়াস ইতিমধ্যে ইন্টারনেটের সন্ধান পেয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে!
আরও কয়েক মিনিট সূর্যবিদায়ের আগ পর্যন্ত মোহময়ী আগ্নেয়গিরিকে আগুনরঙা বরফাচ্ছাদিত অবস্থায় দেখে হাতে মিনি ল্যাপটপে মনোযোগ দিলাম। সব জায়গায় ওয়্যারলেস ইন্টারনেটের এই ব্যবহার খুবই প্রশংসনীয় এবং অবাক করা, কারণ ইউরোপে এখনো এর এতটা চল ঘটে নি, গেল বছরই জার্মানির প্রায় সব হোস্টেলেই নগদ নারায়ন বিসর্জন দিয়েই তবে নেটের ব্যবহার করা গেছে।
কয়েক ঘণ্টা পরে চলুলা শহরে প্রবেশের প্রাক্কালে ইয়াইয়াস জিজ্ঞেস করল, জানালার বাহির কি দেখতে পারছ? তাকিয়ে দেখি অনেক উঁচুতে বেশ নান্দনিক এক সফেদ ক্যাথেড্রাল কৃত্রিম আলোয় ঝকঝক করছে, মনে হচ্ছে নিজের আপন আলোয় উদ্ভাসিত। বললাম, পাহাড়ের মাথায় এক বিশাল গির্জা। সেও বলল, ঠিক আছে, কাছে গেলেই বুঝবে সেইটা আসলে কি।
এই প্রসঙ্গে আমার ফিরে যেতে হবে কয়েকশ বছর আগে যখন সাগর পাড়ি দিয়ে স্প্যানিশ লুটেরার দল হানা দিয়েছে অ্যাজটেকদের ভূমিতে, যাদের আকাশ ছোঁয়া লোভ নিয়ে কবি পাবলো নেরুদা লিখে গিয়েছেন-
এ দেশটাকে যারা হামলা চালিয়ে দখল করেছে — দানবের মত উঁচু কর্দিলেরা পাহাড় ডিঙিয়ে, আমেরিকার রুখো কর্কশ মাটির উপর ঘোড়া চালিয়ে, ওরা খুঁজেছে, শিকার করেছে। আলু, শিম, কালো তামাক, সসেজ, গম, ডিম- যা পেয়েছে হাঙরের মত ভয়ানক খিদের আক্রোশে সমস্ত সাবাড় করে ফেলেছে- এমন মারাত্নক খিদের নজির পৃথিবীতে আর নেই- ওদের ক্ষুধার্ত মুখ দিয়ে চিবিয়ে খেয়েছে সব ধরনের ধর্ম, সব ধরনের জাত, গিলে খেয়েছে পিরামিড, শেষ করে দিয়েছে প্রাচীন দেবদেবতার মূর্তি।—- ওদের সঙ্গে আনার বস্তার মধ্যে ওদের তৈরি এরকম মূর্তিই কিছু ছিল। ওরা কোথাও কিছু রাখেনি— জমি জিরেত চেঁছে ছুলে সাফ করে দিয়েছে—–।
সেই মূর্খ সাম্রাজ্যবাদীদের লোভী ধর্মান্ধ নেতা হারনান কর্টেয অ্যাজটেকদের পিরামিড এবং দেবদেবীর মূর্তি দেখে ক্ষোভে, উপহাসে, বিরক্তিতে ফেটে পড়ে, যদিও সে ভুলে গেছিল তাদের প্রতিটি উপাসনালয়ে এমন কিছু মূর্তিরই ভজন করা হয় সবসময় ( অবশ্য তখন বলা হয়েছিল কর্টেয মূলত নরবলি ঠেকানোর জন্য এমনটি করেছে)।
এই অসভ্যদের দ্বীনের পথে আনার জন্য ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের ধ্বজাধারী কর্টেয প্রথমেই ছলে বলে কূট কৌশলে সমস্ত বাধাপ্রদানকারীদের কচুকাটা করে ঘোষণা দিল এইখানে তারা ৩৬৫টি গির্জা স্থাপন করবে, বছরের প্রতিটি দিনের জন্য একটি! আর চলুলা শহরে স্থাপিত সমগ্র আমেরিকার সর্ববৃহৎ পিরামিডটির চূড়ার ধ্বংস করে সেখানেই বানাল এক কদর্য ক্যাথেড্রাল! সেই পিরামিডটি ছিল মিশরের খুফুর পিরামিডের পরে মানুষের তৈরি ২য় বৃহত্তম পিরামিড।
ভাবতেই ঘৃণায় সারা শরীর রি রি করে উঠল, কতখানি উম্মাদ, বিবেকহীন, নির্বোধ হলে মানুষ এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে? আসলে ইয়াইয়াস বাসের জানালা দিয়ে পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত যে ক্যাথেড্রালটি আমাকে দেখিয়েছিল সেটিই সেই অ্যাজটেক পিরামিডের মাথায় অবস্থিত কুৎসিত ইতিহাসের সাক্ষী স্থাপত্য। ( ছবিটি বাধ্য হয়েই নেট থেকে নিতে হল, সেই পিরামিডের বিশালত্ব অনুভব করার জন্য)
Mexico.Pue.Cholula.Pyramid.03
পিরামিডটি এতই বিশাল ছিল যে প্রথম দর্শনে সবাই মনে করে ক্যাথেড্রালটি আসলে পাহাড়ের মাথাতেই অবস্থিত। আর এই অঞ্চলে কর্টেযের স্বপ্ন অনুযায়ী ঠিক ৩৬৫টি গির্জা না হলেও ২০০টি গির্জা স্থাপন করা হয় যদিও এই দুইশ গির্জাতে প্রতিনিধিত্বকারী সন্ত বা অ্যাঞ্জেলের সংখ্যা ছিল ৩৫৬টি! প্রতিদিনের জন্য একটি!
আঁধার ঘনিয়ে আসায় সেই বিশাল পিরামিডটির ছবি আর তোলা হল না, তার বদলে গাড়ী নেবার জন্য যাওয়া হয় ইয়াইয়াসের চাচার বাড়ীতে।
অল্প সময়ে বিশাল দেশটির অনেকগুলো রাজ্য দেখা হয়েছিল আমাদের, সেই দেশটি নিয়ে সেখানে অবস্থানরত অবস্থায়ই খেমোখাতায় লিখেছিলাম The Best thing about Mexico is the Mexicans! কি যে উষ্ণ হৃদয়ের আর রঙিন চরিত্রের অধিকারী এখানকার প্রতিটি মানুষ। সর্বদা প্রাণপ্রাচুর্যে মুখর, কর্মব্যস্ত আর কিছু না হলে মুখের কথার ফুলঝুরি তো আছেই! মেতে আছে সংগ্রামময় জীবনের আগামীর ফুল ফোটাবার সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। আর আপনি কোন বাড়ীতে যাওয়া মানে গরম খাবার প্রস্তত সবসময়ই! রিপিট- সবসময়ই!
401666_10151180382000497_608590496_22829366_1490815157_n
এমন ভাবেই আমাদের ঘিরে ধরল ইয়াইয়াসের চাচা-ফুফুসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা, টেবিল ভর্তি ছিল নতুন বছরকে বরণ করার উৎসবের জন্য নানা মুখরোচক খাবারে, সেই সাথে ঈষদুষ্ণ পানীয়। নানা গালগল্প জুড়ে দিলেন তারা বাড়ীর ছেলেদের কাছে পেয়ে, হ্যাঁ, সেই কয়েক মুহূর্তের মাঝেই আমিও তাদের পরিবারের একজন হয়ে গেছি।
385802_10151126280720497_608590496_22610176_1378982525_n
তাদের মাঝে দুইজনতো পারলে তখনই হাঁড়িকুঁড়ি,ব্যাগ,বস্তা গুছিয়ে আমাদের সাথে ল্যাতিন আমেরিকা ভ্রমণে বাহির হন, দেশের বাইরে যাওয়া হয় নি তাদের, বিশেষ করে আমরা পেরু যাব শুনে হৈ হৈ করে উঠে বললেন আমাদের সমস্ত রান্না, পরিষ্কার, বাজারের দায়িত্ব তাদের! সদাহাস্যরতা এই অ্যাডভেঞ্চার মনস্কদের একজনের বয়স ৭০ ছুই ছুই, কিন্তু তাকেই দেখলাম রান্নাঘরে সবচেয়ে বেশী ব্যস্ত।
যদিও হাতে সময় খুব কম, সেই রাতেই গাড়ী নিয়ে রওনা দিতে হবে ভেরাক্রুজ রাজ্যে পুয়েবলা শহরে, তবুও ভিনদেশের অচিন আকাশের নিচে সেই পারিবারিক আড্ডা উপভোগ করে চললাম পুরো মাত্রায়—

YOUR NAMEAbout Me
আসসালামু আলাইকুম। নবীন বাংলা ব্লগ সাইটে ভিজিট করার জন্য আপনাকে স্বাগতম। আসলে এই ব্লগ সাইটটি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। এবং আমি এই সাইটের এডমিন, মূলত ব্লগিং প্রাকটিস এবং মুক্ত জ্ঞাণ চর্চার জন্যই এই সাইটটি ওপেন করেছি। আমার সাইটের পোস্টগুলো অন্যান্য সুনাম খ্যাত ব্লগ সাইটে সমূহে পাবলিশ করে থাকি তথারুপ টেকটিউন্স, টিউনারপেইজ। ইনশাআল্লাহ যতদিন বেঁচে থাকব নবীন বাংলা ব্লগে লেখালেখি করার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। এখানে অন্যান্য লেখকদের বাছাই করা পোস্টগুলো পাবলিশ করা হয়। এবং ইচ্ছা করলে আপনিও এই ব্লগের অতিথি লেখক হিসাবে শুরু করতে পারেন।পরিশেষে আমার সাইট কিংবা প্রকাশিত লেখা সম্পর্কে কোন আপনাদের অভিযোগ, মতামত, পরামর্শ থাকলে তা সাদরে গ্রহন করা হবে। আবারো ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা সবাইকে!!
Follow : | | Facebook | Twitter

Post a Comment

 
Top