0
(মূল লেখক: তারেক-অনু, সচালয়তন ব্লগ)

অনেক অনেক দিন ধরেই ইতিহাবিদ এবং নৃতত্ত্ববিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল দশ থেকে পনের হাজার বছর আগে বর্তমান তুরস্ক থেকে ইরাক পর্যন্ত বিস্তৃত নদীবিধৌত উর্বর উপত্যকায় মানুষ প্রথম কৃষিকাজ শুরু করে। যাযাবর শিকারির জীবন ত্যাগ করে ডেরা বাধায় মন দেয়, অনেক সাধনা করে বুনো উদ্ভিদ এবং পশুকে পোষ মানিয়ে নিজের প্রয়োজন মেটাবার তাগিদে পুনঃপ্রজননে সক্ষম হয়। এই ছোট ছোট মানবগোত্র থেকেই একসময় পত্তন ঘটে নগর সভ্যতার, আসে রাষ্ট্র, আসে ধর্ম, আসে অন্ধ বিশ্বাস, আসে লিখন পদ্ধতি, চিত্রকলা।



যদিও আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে আসা যাযাবর গোষ্ঠীরও হয়ত নিজস্ব বিশ্বাস ছিল, তারা প্রকৃতির নানা দৃশ্য-অদৃশ্য বস্তু, শক্তি ইত্যাদিকে দেবতা হিসেবে আরাধনা করত, কিন্তু মানুষের বিশ্বাস যে আদি সমাজ গঠনে সহায়ক ছিল এমন ধারণা ছিল প্রশ্নেরও অতীত। কিন্তু প্রচলিত সব ধারণাকে গুঁড়িয়ে সত্যের আলোকে উদ্ভাসিত করেছে গোবিকলে টেপি।
গোবিকলে টেপি কি?
এটি নিওলিথিক যুগের মানুষদের তৈরি এক বিশাল স্থাপনা, আসলে এটি মানুষের বসবাসের জন্য নির্মিত কুঁড়েঘরের বাহিরে তৈরি প্রথম স্থাপত্যকলার নিদর্শন। নির্মিত হয় ১২,০০০ বছর আগে! এর অবস্থান বর্তমান দক্ষিণ তুরস্কে।
Smithsonian_map_göbekli_tepe
gc3b6bekli-tepe-2
কেন নির্মাণ করা হয়ে ছিল গোবিকলে টেপি ?
আমাদের প্রাপ্ত প্রমাণ সাপেক্ষে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন উপাসনালয়। নিওলিথিক যুগের স্তব্ধতায় মুখর শিকারি, পশুপালক এবং নব্য কৃষকেরা এখানে আসতেন তাদের মনে গজিয়ে ওঠা ঈশ্বরদের নৈবদ্য দিয়ে পরের বছরের সুখাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে। একটা ধারণা হচ্ছে, দেবতাদের সাথে সাথে মৃতদের কল্পিত আবাস হিসেবেও হয়ত এটি ব্যবহৃত হত। বৃটেনের স্টোন হেঞ্জের চেয়ে এটি দ্বিগুণ পুরনো।
gobekli-family-path_35420_600x450
এখন পর্যন্ত বিশাল মন্দিরটির মাত্র ১০ ভাগ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে, এবং বোঝা যাচ্ছে এখানে হয়ত স্থায়ী ভাবে মানুষ বসবাস করত না কখনোই, কেবল মাত্র বছরের নির্দিষ্ট সময়ে বিভিন্ন গোত্রের মানুষ আলাদা আলাদা ভাবে এসে একসাথে অর্পণ করত তাদের উপহার। সেই হিসেবে বিশ্বের প্রথম উপাসনালয়ের সাথে সাথে প্রথম তীর্থও গোবিকলে টেপিই। এইখানেই জন্ম নিয়েছিল আদি ধর্মের, যা পরবর্তীতে মানব বসতি বিস্তারের সাথে সাথে নানা রূপে নানা গল্পে ছড়িয়ে গেছে সারা গ্রহে এবং এখনো ছড়াচ্ছে।
5217670540_c512f367be
কেমন ধরনের স্থাপনা গোবিকলে টেপি?
অবিশ্বাস্য ধরনের জটিল এবং বিস্তৃত। মনে রাখতে হবে ১২,০০০ বছর আগে আমাদের চাকা ছিল না, পরিবহনের কাজে গবাদি পশুর ব্যবহার তখনও উদ্ভব হয় নি, কোন রকম ধাতু ব্যবহার জানা ছিল না, লিখন পদ্ধতি, কুমোরের কাজ ছিল অজানা। অথচ তারাই ১৬ টন ওজনের একেকটি প্রস্তরস্তম্ভকে পালিশ করে, তাতে নিজস্ব দেবতা বা টোটেম খোদাই করে সেটি আবার জায়গামত স্থাপন করে ছিল, সে এক সত্যিকারের বিস্ময়। তবে এই কাজে প্রয়োজন হয়েছিল ব্যপক জনবলের, কাজেই অনেক গোত্র যে একসাথে এই ব্যাপারে কাজ করেছিল তা নিঃসন্দেহে ধরে নেওয়া যায়।
gobekli-stone-working_35429_600x450
gobekli-building-the-wall_35418_600x450
সেখানে স্থাপিত অনেক স্তম্ভের মধ্যে উচ্চতমটি ১৮ ফিট উঁচু, ওজন ১৬ টন! ২২ একর জমিতে ২০টি উপাসনালয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে, একটি মন্দির নির্দিষ্ট সময়ের পরে পুরনো হয়ে গেলে নতুন একটি নির্মাণ করা হয়েছে , মুল স্তম্ভ T বর্ণের আকৃতির হবার কারণ হিসেবে বলা যায়, তারা সম্ভবত মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছে, আর সেইগুলোর গোঁড়ার দিকে খোদাই করা প্রাণীগুলো তাদের কাছে পুতপবিত্র, হয়ত তারা মনে করত এই প্রাণী গুলোই তাদের দেখ ভাল করে, সেখানে আছে বৃশ্চিক, বন্য বরাহ,সর্প, সারস, শেয়াল, শকুন ইত্যাদি।
gobekli-offerings_35426_600x450
এগুলো ছিল আত্মার প্রতীক, অন্য কোন রহস্যময় জগতের প্রতীক, যা নিয়ে তাদের চিন্তা ভাবনা শুরু হয়েছিল গভীর ভাবে
gobekli-animals_35430_600x450
gobekli-full_35417_600x450
যদিও বোঝা যাচ্ছে, সেই যাযাবর মানুষেরা নির্মাণ কাজের পরিকল্পনায় খুব একটা দক্ষ ছিলেন না , প্রায়শই মুল স্তম্ভ গুলো স্থাপন করা হয়েছে ভুল জায়গায়। রহস্যময় কারণে প্রতি কয়েক দশক পরপরই নির্মিত উপাসনালয়ের কার্যকারিতা শেষ হয়ে যেত, তখন তারা আবার নতুন করে মন্দির গড়া শুরু করত। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে যাবার সময়ে অজানা কারণে তাদের নির্মাণ দক্ষতা ক্রমাগত কমতে থাকে, স্তম্ভগুলো ছোট হতে থাকে, তাতে যত্নের অভাব বোঝা যায়, কেমন যেন দায়সারা ভাবে হতে থাকে সব কাজ, অবশেষে ১০,২০০ বছর আগে গোবিকলে টেপির পতন ঘটে, কোনদিনই এই সত্যিকারের জাদুঘেরা জায়গাটি আর আগের স্বর্ণযুগে ফিরে যায় নি।
gobekli-pushing_35428_600x450
কয়েক দশক আগেও গোবিকলে টেপি নিয়ে বিজ্ঞানীদের কোন বিশেষ চিন্তা ছিল না, কারণ তারা ভেবে ছিল এটি বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের সময়কার কোন নিদর্শন, পরবর্তীতে জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদরা এই খানে বিশদ গবেষনা চালাতে যেয়ে নিজেদের সাথে সাথে সারা বিশ্বকে হতভম্ব করে দেন। বছর বিশেক আগেও নিওলিথিক যুগের মানুষদের নিয়ে আমাদের ধারণা ছিল, ক্ষুদে ক্ষুদে গোত্র পশুশিকারে ব্যস্ত, মাঝে মাঝে পর্যবেক্ষণ করে দেখছে বুনো পশু এবং উদ্ভিদ পোষ মানানো যায় কিনা।
gobeklitepe_nov08_2
তাদের পরস্পরের সাথে যোগাযোগ হত খুব কম, অর্থাৎ এদের বিশাল কোন স্থাপনা গড়বার মত জনবল এবং যোগাযোগ ক্ষমতা থাকবার করা নয়, সেই সাথে নির্মাণকাজের সময় রসদের জোগাড় দেওয়াও অসম্ভব বলা চলে, প্রত্যেক গোত্রের ছিল আলাদা আলাদ উপাস্য, ভিন্ন ভিন্ন পুরোহিত, তারা নিশ্চয়ই এক সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কোন উপাসনালয় গড়বেন না। এরপর মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেল গোবিকলে টেপি!
Gopekli_Tepe_BdW_2003-05_700px
বিজ্ঞানীরা বললেন বারো হাজার বছর আগের যাযাবরদের তৈরি এই সুমহান স্থাপনা তাদের ততটাই অবাক করে দিয়েছে, যেন কোন মানুষ একটা তার বাড়ীর বেসমেন্টে বসে একটি ভোঁতা ছুরির মাধ্যমে বোয়িং ৭৪৭ বিমান করলে হবে।
gobekli-pillar-details_35427_600x450
আগুনের ব্যবহারের পরে বলা হত নিওলিথিক যুগের মানুষদের চাষাবাদের সূত্রপাতই মানব সভ্যতার মোড় ঘুরিয়ে দেয়, নির্দিষ্ট জমিতে কিছু বুনো ফসল ( গম, বার্লি) বাড়তে দেখতে হলে তাদের দেখ ভালের জন্য মানুষকে যাযাবরবৃত্তি ত্যাগ করে ডেরা বাঁধতে হল, জন্ম ছিল পৃথিবীর প্রথম গ্রামগুলো, বাড়তে থাকল তা কলেবরে। অতি উর্বর সেই ত্রিভুজাকৃতি ভূখণ্ডেই ঘটে সভ্যতার এক উম্মেষ, বর্তমানে দক্ষিণ তুরস্ক- সিরিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে শুরু হয়ে যার বিস্তার ছিল মেসোপটমিয়ার টাইগ্রিস-ইউফ্রেতিস বিধৌত অঞ্চল পর্যন্ত।
কিন্তু গোবিকলে টেপির আবিস্কারের ফলে বোঝা যায় কৃষিকাজের প্রারম্ভেই সভ্যতার অন্যান্য মাপকাঠির বিস্তারের আগেই হয়ত ধর্ম মানুষের সমাজ গঠনে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছে, হয়ত মানুষ যখন শিকারির পেশা ছেড়ে প্রকৃতির উপর প্রভুত্বের মিশন হাতে নিয়েছে ( ক্রস ব্রিডিং- এর মাধ্যমে নব জাতের পশু উৎপাদন, নব জাতের ফসল উৎপাদন ) তখন থেকেই অজানা বিস্ময়গুলো তাদের কাছে অন্য রূপে ধরা দিয়েছে, সেই অন্য কল্পিত ভুবনে পৌঁছানোর জন্যই তারা প্রাণীদের মূর্তি খোদাই করে শুরু করেছিল পূজা অর্চনা, ধারণা করেছিল- এই প্রাণীগুলোই হবে সেই অজানা জগতের দূত। এভাবেই শুরু হয় ধর্মের, যার ভিত মানব মনের এবং ইতিহাসে অনেক অনেক গভীরে।
Gobekli
375px-GobeklitepeHeykel
গোবিকলে টেপির মুল গবেষক ডঃ স্মিড ( Klaus Schmidt) এই কারণেই মনে করেন- কুড়ি বছর আগেও আমরা মনে করতাম মানব সভ্যতা গড়ে ওঠার পিছনে মুল কারণ আমরা মনে করতাম জলবায়ুর পরিবর্তন, কিন্তু আজ আমরা কেবলমাত্র বুঝতে আরম্ভ করেছি মানব সভ্যতা গড়ে উঠেছে মানবমনের কিছু ধ্যান ধারণার জন্যই।
তথ্য সূত্র—ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকা, জুন, ২০১১
Inside the Neolithic Mind– David Lewis-Williams, David Pearce
NGM_2011_06_CVR

YOUR NAMEAbout Me
আসসালামু আলাইকুম। নবীন বাংলা ব্লগ সাইটে ভিজিট করার জন্য আপনাকে স্বাগতম। আসলে এই ব্লগ সাইটটি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। এবং আমি এই সাইটের এডমিন, মূলত ব্লগিং প্রাকটিস এবং মুক্ত জ্ঞাণ চর্চার জন্যই এই সাইটটি ওপেন করেছি। আমার সাইটের পোস্টগুলো অন্যান্য সুনাম খ্যাত ব্লগ সাইটে সমূহে পাবলিশ করে থাকি তথারুপ টেকটিউন্স, টিউনারপেইজ। ইনশাআল্লাহ যতদিন বেঁচে থাকব নবীন বাংলা ব্লগে লেখালেখি করার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। এখানে অন্যান্য লেখকদের বাছাই করা পোস্টগুলো পাবলিশ করা হয়। এবং ইচ্ছা করলে আপনিও এই ব্লগের অতিথি লেখক হিসাবে শুরু করতে পারেন।পরিশেষে আমার সাইট কিংবা প্রকাশিত লেখা সম্পর্কে কোন আপনাদের অভিযোগ, মতামত, পরামর্শ থাকলে তা সাদরে গ্রহন করা হবে। আবারো ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা সবাইকে!!
Follow : | | Facebook | Twitter

Post a Comment

 
Top