মায়ের ভাষার অধিকার আদায়ে তপ্ত খুন ঝরানোর নজির বিশ্ব-ইতিহাসে বিরল। মুখের বুলি কেড়ে নিয়ে অনধিকার চর্চার পরিণত যে শুভ হয়না, শোষকের দলকে তার চরম ও পরম শিক্ষা দিয়েছিলো বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা। ভাষা-আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতিবাহী এ শহীদ মিনারকে জানার জন্য আমাদের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।
শুরুর কথা :
২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারির শহীদদের স্মরণে ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ নেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা। শহীদ মিনার নির্মাণ শেষ হয় ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে।
প্রথম নির্মিত শহীদ মিনারের অবস্থান :
বর্তমানে যে জায়গায় শহীদ মিনারটি অবস্থিত তার পূর্ব-দক্ষিণ কোণে প্রথম শহীদ মিনারটি নির্মিত হয়েছিল (মেডিকেল হোস্টেলের ১২ নং শেডের পূর্ব প্রান্তে). হোস্টেলের মধ্যবর্তী রাস্তা ঘেঁষে কোণাকুণিভাবে এটি নির্মিত হয়েছিল। শহীদদের রক্তভেজা স্থানে নির্মিত সাড়ে ১০ ফুট উঁচু ও ৬ ফুট প্রস্থের এ ছোট স্থাপত্যটির নির্মাণকাজ শেষ হলে এর গায়ে ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ নামে একটি ফলক লাগিয়ে দেয়া হয়।
যেভাবে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনার :
ইঞ্জিনিয়ার শরফুদ্দিনের তত্ত্বাবধানে মিনারের ডিজাইন করেছিলেন বদরুল আলম এবং সাঈদ হায়দার। তাঁদের সহযোগিতা করেছিলেন দু’জন রাজমিস্ত্রী; যাঁদের নাম এখনও পাওয়া যায়নি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ সম্প্রসারণের জন্য জমিয়ে রাখা ইট-বালি এবং পুরান ঢাকার পিয়ারু সর্দারের গুদাম থেকে আনা হয় সিমেন্ট। ভোরে এটি কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়।
শহীদ মিনার উদ্বোধন ও বিনাশ :
শহীদ মিনারটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছিলো ২৪ ফেব্রুয়ারি। ঐ দিন সকালে ২২ ফেব্রুয়ারিতে শহীদ শফিউরের পিতা মিনারের প্রথম উদ্বোধন করেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি সকাল আনুমানিক ১০টার দিকে দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন। ঐ দিনই পুলিশ মেডিকেল হোস্টেল ঘিরে ফেলে এবং শহীদ মিনার ভেঙে দেয়।
পরবর্তী প্রেক্ষাপট :
প্রথম নির্মিত শহীদ মিনারটি ভেঙে দেওয়া হলেও জনতার হৃদয় থেকে শহীদদের মুছে দিতে পারেনি শাসকগোষ্ঠী। তাই, ঢাকা মেডিকেলের অনুকরণে দেশের বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও বেশ ক’টি শহীদ মিনার নির্মিত হয়। এরপর ঢাকা কলেজে নির্মিত শহীদ মিনারটিও শোষকদের কালো দৃষ্টি থেকে রক্ষা পায়নি। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে নির্মিত ছোট ছোট শহীদ মিনারও তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি।
১৯৫৩ সাল থেকে ছাত্র-জনতা ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করতে থাকে। ঢাকা মেডিকেলের হোস্টেল প্রাঙ্গনে শহীদ মিনারের শূন্য স্থানটিতে লাল কাগজের অবিকল প্রতিকৃতি স্থাপন করে তা কালো কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হয়। এ শহীদ মিনার থেকেই শুরু হয় প্রথম প্রভাতফেরি।
দ্বিতীয় বার শহীদ মিনার নির্মাণের পরিকল্পনা :
১৯৫৪ সালের ৩ মে যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে। একুশ দফার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ, একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস এবং ঐ দিন সরকারী ছুটির দিন ঘোষণা করলেও ৩০ মে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়ে যায়। ফলে ঐ বছর তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
১৯৫৬ সাল। তখন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন আবুল হোসেন সরকার। তৎকালীন পূর্ত সচিব আব্দুস সালাম খান মেডিকেল হোস্টেল প্রাঙ্গনে শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্য চূড়ান্তভাবে স্থান নির্ধারণ করেন।
শিল্পী হামিদুর রহমানের পরিকল্পনা :
১৯৫৭ সালে শিল্পী হামিদুর রহমান বিশাল জায়গাজুড়ে বৃহদাকার শহীদ মিনার কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য একটি নকশা করেন। সহকর্মী ভাস্কর নভেরা আহমদকে সাথে নিয়ে তিনি হোস্টেল প্রাঙ্গনে নির্মাণ কাজ আরম্ভ করেন। অসম্ভব নির্মাণশৈলী সমৃদ্ধ এ পরিকল্পনায় শহীদ মিনারের পাশে একটি জাদুঘর, পাঠাগার, ঝরণা ও ম্যুরেল নির্মাণেরও কথা ছিলো। অনেক দূর এগিয়েছিলো তাঁর এ পরিকল্পনা। কিন্তু ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর কমপ্লেক্সের নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ১৯৬২ সাল পর্যন্ত জাগ্রত জনতা এ অসম্পূর্ণ ও খন্ডিত শহীদ মিনারেই ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন, শপথ গ্রহণ ও আন্দোলন-সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করে।
শহীদ মিনার নির্মাণের তৃতীয় পদক্ষেপ :
১৯৬২ সাল। পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর আজম খানের নির্দেশে তখনকার ঢাবি ভিসি অধ্যাপক ড. মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির পরামর্শ মতে মূল নকশা বহুলাংশে পরিবর্তন ও সংকুচিত করা হয়। এবং পরিকল্পিত স্থাপত্যকে খন্ডিত করে একটি নকশা দাঁড় করানো হয়। এ নকশানুযায়ী নির্মিত শহীদ মিনারটি ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করেন শহীদ বরকতের মা হাসিনা বেগম।
স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে শহীদ মিনার :
একাত্তরের মুক্তি সংগ্রাম চলাকালীন পাক হানাদারদের বিষাক্ত ছোবল থেকে রেহাই পায়নি বাঙালির চেতনার এ কেন্দ্রবিন্দুটি। চরম ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে কাপুরুষতার পরিচয় দিয়ে ভেঙে দেয় শহীদ মিনারটি। কিন্তু ভাঙতে পারেনি বাঙালির চির দুর্মর হৃদয়ের মনোবল। শহীদ মিনার মাটির সাথে মিশিয়ে দিলেও জনতার হৃদয় মিশে গিয়েছিলো ভাষা আন্দোলনে শহীদ দুর্জয় দামালদের রক্তের সাথে। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ মিনারটি ভেঙে দিয়ে পাক বাহিনী সেখানে ‘মসজিদ’ লিখে রাখে।
স্বাধীনতা পরবর্তী শহীদ মিনার :
পরাধীনতার জিঞ্জির ভেঙে স্বাধীনতার মুক্ত বিহঙ্গ ছিনিয়ে আনার পর ১৯৭২ সালে নতুন করে শহীদ মিনার নির্মাণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। কিন্তু এবারও মূল নকশাকে পরিহার করা হয়। ১৯৬৩ সালের সংক্ষিপ্ত ও খন্ডিত নকশার ভিত্তিতে দ্রুত নির্মাণ কাজের সমাপ্তি টানা হয়।
১৯৭৬ সালে নতুন করে একটি নকশা অনুমোদিত হয়েছিলো। কিন্তু নানা কারণে সেটি আর আলোর মুখ দেখেনি। ১৯৮৩ সালে শহীদ মিনারের চত্বরকে বর্ধিত করা হয়। বর্তমান শহীদ মিনারটি এভাবেই বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের চেতনার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্ব-মহিমায়।


Post a Comment