আজকাল ক্রিকেট দেখে শান্তি পাই না! শান্তি পাই না এ কথার চেয়ে মজা লাগে না এই কথাটা বেশি যুক্তিযুক্ত হবে। শান্তি পাওয়া বা মজা লাগার এই ক্রমহ্রাসমান অনুভুতির প্রক্রিয়া অনেক দিনের। খেলাটা এখন এতটাই বানিজ্যিকরন হয়েছে যে, বিজ্ঞাপনের জ্বালায় এখন ওভারের মাত্র ৫টি বল দেখা যায়, ব্যাটসম্যান আউট হলে বিজ্ঞাপন ওভারের মাঝেও ঢুকে পড়ে আর টেলিকাস্ট যদি বিতিভিতে হয় তাইলেত কথাই নাই। আজ কমেন্ট্রি বক্সে রিছি বেনো, রবিন জ্যাকম্যান আর টনি কোজিয়ারদের মধুর কমেন্ট্রি শোনা যায় না বরং স্লিভলেস টপ আর শর্ট স্কার্ট পরা ললনাদের দেখা যায় বেশি।
ক্রিকেট খেলা এখন উপভোগের জন্য নয় বরঞ্চ চোখ ভরে দেখার বিষয়। কপিল, লিলি, হোল্ডিংদের মতো বিনয়ী বোলার আর মিয়ানদাদ, তেন্দুলকারদের মতো প্রতিভাবান ব্যাটসম্যানদের দেখা পাওয়া যায় না। বর্তমান খেলোয়াড়দের দেখে মনে হয় একদল হিংস্র নেকড়ে শুধু শিকারের (টাকার) পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছে। গুরুজনরা বলতেন “অর্থই সব অনর্থের মূল” তারা একরত্তিও যে মিথ্যা বলতেন না তার প্রকৃষ্ট উদাহারন আজকের যুগের আসিফ, বাট আর আমিরেরা। বোর্ড আর খেলোয়াড়েরা অবিরাম ছুটে চলছে অর্থের পিছনে আর তাদের পিছনে ছুটে চলছে লগ্নিকারক আর বাজিকরেরা।

১৯৭৭ সালে কেরি প্যাকার নামের অস্ট্রেলিয়ান এক ব্যাবসায়ি ক্রিকেটের আমূল পরিবর্তনের সূচনা করেছিলেন। তখনকার দিনেই তিনি অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ডকে $১.৫ মিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার সেধেছিলেন টেস্ট আর শেফিল্ড শিল্ড ম্যাচের টিভিস্বত্ত কেনার জন্য কিন্তু বোর্ডের “না”! শান্ত শিষ্ট ব্যাবসায়ি এইবার তাদেরকে দেখে নেয়ার ছক আঁকতে লাগলেন আর তার হাত ধরেই “ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেটের’’ গোড়াপত্তন হলো। ৫০ জন বিদ্রুোহী ক্রিকেটারদের নিয়ে নিজেই শুরু করলেন সেই বিখ্যাত “ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেট’’ টুর্নামেন্টটি। রাতের বেলায় আলোর নিচে, রঙ্গিন কাপড় পড়ে সাদা বলে খেলা প্রথমবারেই বাজিমাত করে দিল। ১৯৭৭ সালের আগে জিবন্ত কিংবদন্তি মাইকেল হোল্ডিং যেখানে প্রতি টেস্টের জন্য পেতেন ২০০ ডলার আর ওয়ার্ল্ড সিরিজে যোগ দেয়ার জন্য ২৫ হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলারে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। কেরি প্যাকারের হাত ধরে কিন্তু ক্রিকেট আধুনিক যুগে প্রবেশ করতে পেরেছিল। তিনি খেলোয়াড়দের অর্থনৈতিক মুক্তি এনে দিয়েছিলেন আর সার্বিকভাবে ক্রিকেটকে আরও উপভোগ্য করে তুলতে পেরেছিলেন। ৮০ আর ৯০‘য়ের দশকে ক্রিকেটাররা অনেকটা পেশাদার ছিলেন কিন্তু তারা টাকার জন্য খেলতেন না, খেলতেন নিজের দেশের আর খেলাটাকে মন দিয়ে ভালবাসতেন বলে।
প্যাকারকে অনুসরন করে ২০০৮ সালে ললিত মোদি ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগ (আইপিএল) চালু করলেন আর তাতে ভারতীয় বোর্ড আর অংশগ্রহনকারী খেলোয়াড়দের ব্যাংক ব্যালেন্স এতটাই স্ফিত হল যে তারা নিজেদের আইন কানুনের উর্ধে মনে করা শুরু করলেন। আজ আইপিএল একটা ব্র্যান্ড যার বাজার মূল্য প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকার উপর! আইপিএলের বদৌলতে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই) বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ও ক্ষমতাবান খেলাধুলা নিয়ন্ত্রঙ্কারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আইপিএলে খেলোয়াড়েরা বেতনের হিসাবে ইউরোপের ফুটবল খেলোয়ারদের সমান অর্থ কামিয়ে থাকেন। পুরানো এক হিসাব অনুযায়ী ভারতে ক্রিকেটের বাজার প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার মত, আজকের বাজার দর আরও বেশি হওয়ারই কথা আর ভারতীয়দের ক্রিকেট পাগলামোকে (ভালো অর্থে পাঠক) পুঁজি করে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের এই রমরমা অবস্থা। জিটিভি(এসসেল গ্রুপ) ২০০০ সাল থেকে চালিয়ে আসা টিভিস্বত্তের (বিসিসিআই ও আইসিসি’র বিভিন্ন প্রতিযোগিতা) যুদ্ধে ফেল মারতে মারতে ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে ক্যারি প্যাকারের বিদ্রোহী সিরিজের আদলে ২০০৭ সালে “ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লীগ(ICL)” নামে এক টি-২০ টুর্নামেন্ট চালু করল কিন্তু হায় শুরুতেই তাতে চোখ পড়ল বড় নেকড়ে বিসিসিআই এর, তাদের বিষাক্ত আঁচড়ে ক্ষত বিক্ষত হতে হল আইসিএলকে। দুই হেভিওেয়েট ব্যাবসায়ি (দুঃখিত বিসিসিআইকে ব্যাবসায়ী বললাম) গ্রুপের মুষ্টিযুদ্ধে ক্রিকেট স্বার্থ আবার সাইড লাইনে। বিসিসিআই ঘোষণা দিল যে সব ভারতীয় ক্রিকেটার আইসিএলে খেলবে তাদেরকে বিসিসিআই আয়োজিত সব প্রতিযোগিতায় নিষিদ্ধ করা হবে। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের প্ররোচনায় অন্যান্য দেশের বোর্ডও আইসিএলকে অপাংতেও ঘোষণা করল, সেই সাথে ক্রিকেট ও ক্রিকেটারদের মানহানিই শুধু হলনা তাদের রুজি রোজগারেও হাত পড়ল। পাঠক মনে পড়ে কি বাংলাদেশের তরুন কিছু খেলোয়াড়দের (আফতাব, ধিমান, কাপালি, ফরহাদ রেজা ও অন্যান্য) বিবর্ণ মুখগুলি? আইসিএল আর বিসিসিআই এর টানা-হেঁচড়ায় ধিমান ঘোষের মতো প্রতিভাবান খেলোয়াড়রা প্রায় হারিয়েই গেলেন।
আজ ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের সেই দাপুটে দিন নেই, এক কোথায় চেয়ে চিনতে চলা আর এমন সময় ক্রিস গেইলের মতো খেলোয়াড়ের জাতীয় দলে অনুপস্থিতি খুবই পীড়া দায়ক। হয়ত তার খ্যাপাটে স্বভাবের সাথে বোর্ড মানিয়ে চলতে পারছেনা কিন্তু ব্যাপার হল বেশি আয়ের অন্য সুযোগ না থাকলে ক্রিস গেইলের অনুপস্থিতা কি এত লম্বা হত? জাতীয় দলে না হয় অনুপস্থিত কিন্তু এই প্রতিভাবান খেলোয়াড় খুবই ব্যাস্ত, অস্ট্রেলিয়ান বিগ ব্যাশ, বিপিএল, দক্ষিণ আফ্রিকার টি-২০ টুর্নামেন্ট, আইপিএল, ইংলিশ টি-২০ টুর্নামেন্ট, তিনি আজ পরিণত হয়েছেন এক ধনাঢ্য যাযাবরে। আরেক প্রতিভাবান খেলোয়াড় কেভিন পিটারসন, জিনি ক্যারিয়ার মধ্যগগনে থাকার সময়েই ইতিমধ্যে অন্তর্জাতিক অডিআই ও টি-২০ থেকে অবসর নিয়ে ফেলেছেন যাতে বেশি টাকা কামানোর আইপিএলে বেশি সময় দিতে পারেন! কি বোঝলেন? এভাবে যদি চলতে থাকে সেই দিন আর বেশি নাই যেদিন প্রাইভেট ক্রিকেট লীগই হবে সবার ঠিকানা, হা হা হা!
৯০’র দশকে খেলার দুনিয়ায় সিগারেট কোম্পানির বিনিয়োগ ছিল চোখে পড়ার মতো, যা ক্রিকেট থেকেও বাদ যায়নি, ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে আর ভারতীয় জাতীয় দলের টাইটেল স্পন্সর ছিল ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর “উইলস’’ ব্র্যান্ড। পরে আইসিসি ও বিসিসিআই টোব্যাকোর লগ্নিচক্র থেকে বের হয়ে আসে। ভারতের ১ হাজার কোটি টাকার ক্রিকেট বাজারকে টোব্যাকো কোম্পানি এত সহজে ফেলে দিতে পারছিলনা আর তাই তারা খেলার সামগ্রী তৈরি করা শুরু করল যাতে আবার টাইটেল স্পন্সরশিপ বাগানো যায়। ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যাক্তিদের এহেন কর্মকাণ্ড কত শত হাজার মানুষের হাতে ধুমপানের মত মরন অভ্যাস গড়ে দিয়েছে তার কোন হিসাব নাই।
এবার আসা যাক যাদের হাত ধরে বর্তমান ক্রিকেটাররা বৈধ অবৈধ আর অনৈতিক নেশায় বুঁদ হয়ে আছেন তাদের পালায়। প্রথমেই নাম আসে ললিত মোদির, মার্কিন মুলুক থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহন শেষে তিনি ফ্রেঞ্ছাইজি (অরিজিনালি ইয়াংকি আইডিয়া) ভিত্তিক টি-২০‘র যে মডেল ভারতে দাড় করালেন তা পুরা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলো। ক্ষমতার দৃশ্যপটে (চেয়ারম্যান ও কমিশনার, আইপিএল) এসে তিনি প্রথমেই শায়েস্তা করলেন বেয়াড়া আইসিএলকে এতেই দমে যাননি রোজগারহীন করলেন অনেক ক্রিকেটারকে (যদিও প্রাথমকভাবে আইসিএলকে ল্যাংড়া-লোলা করেছিলো বিসিসিআই)। ভবিষ্যতে কেউ যাতে আইপিএলকে টেক্কা দিতে না পারে সেজন্য টুর্নামেন্টটিকে তিনি আইসিসির এফটিপিতে (ফিউচার ট্যুর প্লান) ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলেন। সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে এক্ষেত্রে আবারও হার মানতে হল টাকা ওয়ালা বিসিসিআই এর কাছে। এখন এফটিপির বদৌলতে ক্রিকেট ক্যালেন্ডারে দুই মাস আইপিএল ছাড়া আর কিছুই নাই। বাংলাদেশ, জিম্বাবুয়ের প্রায় সব খেলোয়াড় আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ইংল্যান্ডের অধিকাংশ খেলোয়াড়ের কোনও কাজ থাকে না এই সময়ে কারন তাদেরকে আইপিএলের কোনও দল টানেনা। বর্ষার ৪ মাস আর আইপিএলের ২ মাস সব মিলিয়ে বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের ৬ মাস কোন কাজই থাকে না। এটা বলা যায় যে, ক্রিকেটের বানিজ্যিকরনের কারনে ছোট দেশগুলির ক্রিকেটের স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি বিরাট ক্ষতি হচ্ছে। ললিত মোদি এতটাই ক্ষমতাবান ছিলেন যে দুর্নীতিতে তার জড়িয়ে পড়া ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। হলও তাই, ২০১০ সালে প্রায় ২২টি অভিযোগে তাকে বরখাস্ত করল বিসিসিআই। ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে তিন তিনটি ফ্রেঞ্ছাইজির শেয়ার কিনেছিলেন, অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে আত্মীয় স্বজন আর বন্ধুবান্ধবকে নতুন ফ্রেঞ্ছাইজির (কচি আর পুনে) শেয়ার পাইয়ে দিয়েছিলেন, ফ্রেঞ্ছাইজিদের সাথে করা চুক্তির ব্যাপারে টুইট করেছিলেন, ক্রিস কেয়ার্নসকে ২০০৮এ ম্যাচ গড়াপেটায় অভিযুক্ত করেছিলেন যা পরে লন্ডনের কোর্টে মিথ্যা প্রমানিত হয়েছিলো এছাড়া তিনি আরও ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। শেয়ারের কারবারি ছিলেন এলেন স্ট্যানফোর্ড, তার হটাৎ খেয়াল চাপল তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর ইংল্যান্ডের মধ্যে একটি মাল্টি মিলিয়ন ডলারের টি-২০ টুর্নামেন্ট আয়োজন করবেন যেই ভাবা সেই কাজ ২০ মিলিয়ন ডলারের সেই টুর্নামেন্ট মাত্রও এক মৌসুম স্থায়ী হয়েছিলো। কারন কিছুই না আবার সেই দুর্নীতি, শেয়ারের ব্যাবসায় ছলচাতুরী আর তহবিল তসরুফের মামলায় ১০০ বছরের উপর জেল, চিন্তা করেন একবার ক্রিকেটের স্বার্থে কর্তা ব্যাক্তিরা কাদের সাথে উঠা বসা করেন!
পাকিস্তানের সাথে চলমান দ্বিতীয় টেস্টে এঞ্জেলা মেতিউজের বলে সেঞ্ছুরি করা হাফিজ কট বিহান্ড ছিলেন কিন্তু তাতে আম্পায়ারের আউট দেননি। মাঠে এই ধরনের বিতর্ক এড়াতে আইসিসি ডিআরএস (ডিসিশন রিভিউ সিস্টেম) পদ্ধতির প্রস্থাব করেছিল, খেলা চলাকালীন প্রায় সব মাঠেই এর কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। প্রযুক্তিটি একবারে ১০০% নিখুত করতে আরও একটু সময় হয়ত লাগত কিন্তু এর মাঝেই মাঠের আম্পায়ারদের দারুন সাহায্য করা শুরু করেছিল। কিন্তু বিধি বাম, বিশ্বের প্রভাবশালী ভারতীয় বোর্ড শুরু থেকেই এর বিরোধীতা করছিলো আর শেষ পেরেকটা ঠুকা হল ভারতের ইংল্যান্ড সফরে “ধবল ধোলাই’’ হওয়ার পর। তাদের নাছোড়বান্দা যুক্তি হল এটা পরিপূর্ণ না, এটা হয়ত ঠিক যে কয়েকটি সিদ্ধান্ত তাদের বিপক্ষে গিয়েছিল কিন্তু এর জন্য প্রযুক্তিকে দায়ী করা যায় না। প্রযুক্তিত আর ভারত-পাকিস্তান বা সাদা-কালো চিনেনা। মাঠে ডিআরএস বাধ্যতামূলক হলে প্রতি ম্যাচে সব বোর্ডকে ৫ হাজার ডলার গুনতে হত। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী বোর্ডের ৫ হাজার ডলারের বিলটি বড্ড বেশি মনে হয়েছিলো তাই ইতিমধ্যে ডিআরএস পদ্ধতির কবর দেয়া হয়ে গেছে। একগুয়ে ব্যাবসায়িক মনোবৃত্তির জন্য আরেকটি ভালো ক্রিকেটীয় উদ্যোগ মাঠে মারা গেল।
খেলোয়াড়েরা কাপড় পড়েন লজ্জা ঢাকতে আর ক্রিকেট বোর্ডগুলি সেই লজ্জা ঢাকতে ফিলা, এডিডাস, নাইকি, রিবকের মত ক্রীড়া সামগ্রী প্রস্তুতকারকদের পিছনে ছুটছে, যদি কোনও ভাবে একটি ভালো ডিল করা যায় তাইলে বিপুল পরিমান টাকা বোর্ডের একাউন্টে ঢুকানো যাবে! নাইকি ইতিমধ্যে বিসিসিআই সাথে প্রায় $৬০ মিলিয়ন ডলারের নতুন চুক্তি করে ফেলেছে, আর টাইটেল স্পন্সরশিপ বাবদ প্রতি ম্যাচে ভারতীয় বোর্ড সাহারা থেকে পাবে $৭ লাখ ৫০ হাজার ডলার আর বাংলাদেশ চার বছরে সব ধরনের স্পন্সরশিপ বাবদ আয় করবে প্রায় $ ১ কোটি ১৪ লাখ ডলার বছরে প্রায় $ ২৮ লাখ ৫০ হাজারের মত যা ভারতের চার ম্যাচের পাওয়া অর্থের সমপরিমাণ! স্পন্সরশিপ চুক্তির তালিকায় কি নেই, জুতা-মোজা থেকে বাউন্ডারির রশি পর্যন্ত সব কিছুই এখন বিকোয়।
দেশে দেশে বোর্ড আর খেলোয়াড়দের মাঝে যে আকাশসম পার্থক্য তা অনেক অনিয়মের জন্ম দিচ্ছে। একসময় অস্ট্রেলিয়ার একচেটিয়া দাপটে ক্রিকেট বিশ্বকে তটস্থ থাকতে হত আর এখন ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। তাদের খেয়াল খুশি মতই আইন কানুন তৈরি হচ্ছে, ক্রিকেট সূচিতে তাদের মতামতটাকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে, প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন টেস্ট ক্রিকেটে আমরা ১০ বছর পার করলেও এখন পর্যন্ত ভারতের সাথে তাদের মাটিতে খেলাই হয়নি! বিসিসিআই টাকার গরমে প্রতিবেশী এক দেশকে একঘরে করে রেখেছে, বিপিএলে নিজেদের খেলোয়াড়দের ছাড়ত দেয়নি উল্টো পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের ডাকায় বিসিসিআই উষ্মা প্রকাশ করেছে, শ্রীলংকা বোর্ড প্রধান রানাতুঙ্গাকে বরখাস্ত করতেও তাদের ইন্ধন ছিল। ক্রিকেটে মেরুকরন প্রায় সম্পূর্ণ, বিসিসিআই এর সাথে থেকে হয় কামাও নয়ত একঘরে হয়ে থাকও।
কলকাতা ফ্রেঞ্ছাইজিতে গৌতম গাম্ভিরকে আনতে শাহরুখ খানকে ১৯ কোটি ২০ লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছিলো, সে হিসাবে প্রতি রানের জন্য ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা, সাকিবকে তারা দলে টেনে ছিলো ৩ কোটি টাকার কিছু বেশি কিছু দিয়ে। আইপিএলে ৯০ জন বিদেশী খেলোয়াড় খেলার সুযোগ পেয়ে থাকেন, বাকিদের পরবর্তী আসরের দিকে হা করে চেয়ে থাকতে হয়। কেউ খেলছে আর কেউ খেলছেনা (বরং পড়ুন আয় করছেনা!) এটা অনেকের মানসিক পীড়ার কারন হয়ে দাড়ায়। বিশাল অংকের আয়ের সুযোগ হারিয়ে অনেকে নৈতিকতাও বিসর্জন দেন, পকিস্তানের বাট, আমির আর আসিফকে দেখুন। আবার আরো অর্থ কামানোর নেশা আইপিএলে খেলতে থাকা অনেককে বাজিকরদের কাছে নিয়ে যায়। এদের দেখলে মনে হয় টাকা কামানোটাই ক্রিকেট খেলার উদ্দেশ্য ভালবাসা-টালবাসা আর দেশ ভক্তি বলতে কিছু নাই।

লেখাটা ইতিবাচক উপাদান দিয়ে শেষ করতে চাই। চারদিকে অর্থের ঝনঝনানি কিন্তু অনেক ভালো ক্রিকেটারের মন গলাতে পারেনি। তাদের কাছে নৈতিকতা ও দেশাত্ত্ববোধের স্থান অর্থের অনেক উপরে। এইরকম একজন খেলোয়াড়ের নাম হাশিম আমলা যিনি এখন পর্যন্ত আইপিএলে নাম লেখান নাই। যারা তার টেস্ট ইনিংস দেখেছেন তারা বুঝবেন কার কথা বলছি (টেস্টে স্ট্রাইকিং রেট ৫১), এরকম পারফরম্যান্স নিয়েও তিনি প্রাইভেট টি-২০ টুর্নামেন্টের ধারে কাছেও নেই। নিজের জার্সিতে মদের বিজ্ঞাপন লাগাননা তাই তাকে প্রতি ম্যাচে ২০০ ডলার করে জরিমানা দিতে হয় তারপরেও নৈতিকতার সাথে আপোস নয়। পাঠকরা হয়ত বলতে পারেন তার এই আচরণের সাথে ক্রিকেটের কি সম্পর্ক? তিনি পেশাদার ক্রিকেটার কিন্তু ক্রিকেট মার্সেনারি নন, ক্রিকেট খেলেন ভালোলাগা থকে শুধু অর্থ উপার্জনের জন্য নয়। ক্রিকেটাররা যদি আস্তে আস্তে বাড়তি অর্থ কামাইয়ের উপর নৈতিকতার স্থান দেন তাইলে বোর্ডের অর্থলিপ্সা একসময় বন্ধ হবে। আজকের দিনে ক্রিকেট আর ব্যাবসা একে অপরের সাথে মিলেমিশে আছে কিন্তু শুধু টাকার জন্য ক্রিকেটের সুন্দর আবেদনকে উপেক্ষা করা বোকামি।
ক্রিকেট খেলা এখন উপভোগের জন্য নয় বরঞ্চ চোখ ভরে দেখার বিষয়। কপিল, লিলি, হোল্ডিংদের মতো বিনয়ী বোলার আর মিয়ানদাদ, তেন্দুলকারদের মতো প্রতিভাবান ব্যাটসম্যানদের দেখা পাওয়া যায় না। বর্তমান খেলোয়াড়দের দেখে মনে হয় একদল হিংস্র নেকড়ে শুধু শিকারের (টাকার) পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছে। গুরুজনরা বলতেন “অর্থই সব অনর্থের মূল” তারা একরত্তিও যে মিথ্যা বলতেন না তার প্রকৃষ্ট উদাহারন আজকের যুগের আসিফ, বাট আর আমিরেরা। বোর্ড আর খেলোয়াড়েরা অবিরাম ছুটে চলছে অর্থের পিছনে আর তাদের পিছনে ছুটে চলছে লগ্নিকারক আর বাজিকরেরা।
১৯৭৭ সালে কেরি প্যাকার নামের অস্ট্রেলিয়ান এক ব্যাবসায়ি ক্রিকেটের আমূল পরিবর্তনের সূচনা করেছিলেন। তখনকার দিনেই তিনি অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ডকে $১.৫ মিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার সেধেছিলেন টেস্ট আর শেফিল্ড শিল্ড ম্যাচের টিভিস্বত্ত কেনার জন্য কিন্তু বোর্ডের “না”! শান্ত শিষ্ট ব্যাবসায়ি এইবার তাদেরকে দেখে নেয়ার ছক আঁকতে লাগলেন আর তার হাত ধরেই “ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেটের’’ গোড়াপত্তন হলো। ৫০ জন বিদ্রুোহী ক্রিকেটারদের নিয়ে নিজেই শুরু করলেন সেই বিখ্যাত “ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেট’’ টুর্নামেন্টটি। রাতের বেলায় আলোর নিচে, রঙ্গিন কাপড় পড়ে সাদা বলে খেলা প্রথমবারেই বাজিমাত করে দিল। ১৯৭৭ সালের আগে জিবন্ত কিংবদন্তি মাইকেল হোল্ডিং যেখানে প্রতি টেস্টের জন্য পেতেন ২০০ ডলার আর ওয়ার্ল্ড সিরিজে যোগ দেয়ার জন্য ২৫ হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলারে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। কেরি প্যাকারের হাত ধরে কিন্তু ক্রিকেট আধুনিক যুগে প্রবেশ করতে পেরেছিল। তিনি খেলোয়াড়দের অর্থনৈতিক মুক্তি এনে দিয়েছিলেন আর সার্বিকভাবে ক্রিকেটকে আরও উপভোগ্য করে তুলতে পেরেছিলেন। ৮০ আর ৯০‘য়ের দশকে ক্রিকেটাররা অনেকটা পেশাদার ছিলেন কিন্তু তারা টাকার জন্য খেলতেন না, খেলতেন নিজের দেশের আর খেলাটাকে মন দিয়ে ভালবাসতেন বলে।
প্যাকারকে অনুসরন করে ২০০৮ সালে ললিত মোদি ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগ (আইপিএল) চালু করলেন আর তাতে ভারতীয় বোর্ড আর অংশগ্রহনকারী খেলোয়াড়দের ব্যাংক ব্যালেন্স এতটাই স্ফিত হল যে তারা নিজেদের আইন কানুনের উর্ধে মনে করা শুরু করলেন। আজ আইপিএল একটা ব্র্যান্ড যার বাজার মূল্য প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকার উপর! আইপিএলের বদৌলতে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই) বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ও ক্ষমতাবান খেলাধুলা নিয়ন্ত্রঙ্কারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আইপিএলে খেলোয়াড়েরা বেতনের হিসাবে ইউরোপের ফুটবল খেলোয়ারদের সমান অর্থ কামিয়ে থাকেন। পুরানো এক হিসাব অনুযায়ী ভারতে ক্রিকেটের বাজার প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার মত, আজকের বাজার দর আরও বেশি হওয়ারই কথা আর ভারতীয়দের ক্রিকেট পাগলামোকে (ভালো অর্থে পাঠক) পুঁজি করে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের এই রমরমা অবস্থা। জিটিভি(এসসেল গ্রুপ) ২০০০ সাল থেকে চালিয়ে আসা টিভিস্বত্তের (বিসিসিআই ও আইসিসি’র বিভিন্ন প্রতিযোগিতা) যুদ্ধে ফেল মারতে মারতে ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে ক্যারি প্যাকারের বিদ্রোহী সিরিজের আদলে ২০০৭ সালে “ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লীগ(ICL)” নামে এক টি-২০ টুর্নামেন্ট চালু করল কিন্তু হায় শুরুতেই তাতে চোখ পড়ল বড় নেকড়ে বিসিসিআই এর, তাদের বিষাক্ত আঁচড়ে ক্ষত বিক্ষত হতে হল আইসিএলকে। দুই হেভিওেয়েট ব্যাবসায়ি (দুঃখিত বিসিসিআইকে ব্যাবসায়ী বললাম) গ্রুপের মুষ্টিযুদ্ধে ক্রিকেট স্বার্থ আবার সাইড লাইনে। বিসিসিআই ঘোষণা দিল যে সব ভারতীয় ক্রিকেটার আইসিএলে খেলবে তাদেরকে বিসিসিআই আয়োজিত সব প্রতিযোগিতায় নিষিদ্ধ করা হবে। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের প্ররোচনায় অন্যান্য দেশের বোর্ডও আইসিএলকে অপাংতেও ঘোষণা করল, সেই সাথে ক্রিকেট ও ক্রিকেটারদের মানহানিই শুধু হলনা তাদের রুজি রোজগারেও হাত পড়ল। পাঠক মনে পড়ে কি বাংলাদেশের তরুন কিছু খেলোয়াড়দের (আফতাব, ধিমান, কাপালি, ফরহাদ রেজা ও অন্যান্য) বিবর্ণ মুখগুলি? আইসিএল আর বিসিসিআই এর টানা-হেঁচড়ায় ধিমান ঘোষের মতো প্রতিভাবান খেলোয়াড়রা প্রায় হারিয়েই গেলেন।
আজ ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের সেই দাপুটে দিন নেই, এক কোথায় চেয়ে চিনতে চলা আর এমন সময় ক্রিস গেইলের মতো খেলোয়াড়ের জাতীয় দলে অনুপস্থিতি খুবই পীড়া দায়ক। হয়ত তার খ্যাপাটে স্বভাবের সাথে বোর্ড মানিয়ে চলতে পারছেনা কিন্তু ব্যাপার হল বেশি আয়ের অন্য সুযোগ না থাকলে ক্রিস গেইলের অনুপস্থিতা কি এত লম্বা হত? জাতীয় দলে না হয় অনুপস্থিত কিন্তু এই প্রতিভাবান খেলোয়াড় খুবই ব্যাস্ত, অস্ট্রেলিয়ান বিগ ব্যাশ, বিপিএল, দক্ষিণ আফ্রিকার টি-২০ টুর্নামেন্ট, আইপিএল, ইংলিশ টি-২০ টুর্নামেন্ট, তিনি আজ পরিণত হয়েছেন এক ধনাঢ্য যাযাবরে। আরেক প্রতিভাবান খেলোয়াড় কেভিন পিটারসন, জিনি ক্যারিয়ার মধ্যগগনে থাকার সময়েই ইতিমধ্যে অন্তর্জাতিক অডিআই ও টি-২০ থেকে অবসর নিয়ে ফেলেছেন যাতে বেশি টাকা কামানোর আইপিএলে বেশি সময় দিতে পারেন! কি বোঝলেন? এভাবে যদি চলতে থাকে সেই দিন আর বেশি নাই যেদিন প্রাইভেট ক্রিকেট লীগই হবে সবার ঠিকানা, হা হা হা!
৯০’র দশকে খেলার দুনিয়ায় সিগারেট কোম্পানির বিনিয়োগ ছিল চোখে পড়ার মতো, যা ক্রিকেট থেকেও বাদ যায়নি, ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে আর ভারতীয় জাতীয় দলের টাইটেল স্পন্সর ছিল ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর “উইলস’’ ব্র্যান্ড। পরে আইসিসি ও বিসিসিআই টোব্যাকোর লগ্নিচক্র থেকে বের হয়ে আসে। ভারতের ১ হাজার কোটি টাকার ক্রিকেট বাজারকে টোব্যাকো কোম্পানি এত সহজে ফেলে দিতে পারছিলনা আর তাই তারা খেলার সামগ্রী তৈরি করা শুরু করল যাতে আবার টাইটেল স্পন্সরশিপ বাগানো যায়। ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যাক্তিদের এহেন কর্মকাণ্ড কত শত হাজার মানুষের হাতে ধুমপানের মত মরন অভ্যাস গড়ে দিয়েছে তার কোন হিসাব নাই।
এবার আসা যাক যাদের হাত ধরে বর্তমান ক্রিকেটাররা বৈধ অবৈধ আর অনৈতিক নেশায় বুঁদ হয়ে আছেন তাদের পালায়। প্রথমেই নাম আসে ললিত মোদির, মার্কিন মুলুক থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহন শেষে তিনি ফ্রেঞ্ছাইজি (অরিজিনালি ইয়াংকি আইডিয়া) ভিত্তিক টি-২০‘র যে মডেল ভারতে দাড় করালেন তা পুরা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলো। ক্ষমতার দৃশ্যপটে (চেয়ারম্যান ও কমিশনার, আইপিএল) এসে তিনি প্রথমেই শায়েস্তা করলেন বেয়াড়া আইসিএলকে এতেই দমে যাননি রোজগারহীন করলেন অনেক ক্রিকেটারকে (যদিও প্রাথমকভাবে আইসিএলকে ল্যাংড়া-লোলা করেছিলো বিসিসিআই)। ভবিষ্যতে কেউ যাতে আইপিএলকে টেক্কা দিতে না পারে সেজন্য টুর্নামেন্টটিকে তিনি আইসিসির এফটিপিতে (ফিউচার ট্যুর প্লান) ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলেন। সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে এক্ষেত্রে আবারও হার মানতে হল টাকা ওয়ালা বিসিসিআই এর কাছে। এখন এফটিপির বদৌলতে ক্রিকেট ক্যালেন্ডারে দুই মাস আইপিএল ছাড়া আর কিছুই নাই। বাংলাদেশ, জিম্বাবুয়ের প্রায় সব খেলোয়াড় আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ইংল্যান্ডের অধিকাংশ খেলোয়াড়ের কোনও কাজ থাকে না এই সময়ে কারন তাদেরকে আইপিএলের কোনও দল টানেনা। বর্ষার ৪ মাস আর আইপিএলের ২ মাস সব মিলিয়ে বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের ৬ মাস কোন কাজই থাকে না। এটা বলা যায় যে, ক্রিকেটের বানিজ্যিকরনের কারনে ছোট দেশগুলির ক্রিকেটের স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি বিরাট ক্ষতি হচ্ছে। ললিত মোদি এতটাই ক্ষমতাবান ছিলেন যে দুর্নীতিতে তার জড়িয়ে পড়া ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। হলও তাই, ২০১০ সালে প্রায় ২২টি অভিযোগে তাকে বরখাস্ত করল বিসিসিআই। ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে তিন তিনটি ফ্রেঞ্ছাইজির শেয়ার কিনেছিলেন, অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে আত্মীয় স্বজন আর বন্ধুবান্ধবকে নতুন ফ্রেঞ্ছাইজির (কচি আর পুনে) শেয়ার পাইয়ে দিয়েছিলেন, ফ্রেঞ্ছাইজিদের সাথে করা চুক্তির ব্যাপারে টুইট করেছিলেন, ক্রিস কেয়ার্নসকে ২০০৮এ ম্যাচ গড়াপেটায় অভিযুক্ত করেছিলেন যা পরে লন্ডনের কোর্টে মিথ্যা প্রমানিত হয়েছিলো এছাড়া তিনি আরও ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। শেয়ারের কারবারি ছিলেন এলেন স্ট্যানফোর্ড, তার হটাৎ খেয়াল চাপল তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর ইংল্যান্ডের মধ্যে একটি মাল্টি মিলিয়ন ডলারের টি-২০ টুর্নামেন্ট আয়োজন করবেন যেই ভাবা সেই কাজ ২০ মিলিয়ন ডলারের সেই টুর্নামেন্ট মাত্রও এক মৌসুম স্থায়ী হয়েছিলো। কারন কিছুই না আবার সেই দুর্নীতি, শেয়ারের ব্যাবসায় ছলচাতুরী আর তহবিল তসরুফের মামলায় ১০০ বছরের উপর জেল, চিন্তা করেন একবার ক্রিকেটের স্বার্থে কর্তা ব্যাক্তিরা কাদের সাথে উঠা বসা করেন!
পাকিস্তানের সাথে চলমান দ্বিতীয় টেস্টে এঞ্জেলা মেতিউজের বলে সেঞ্ছুরি করা হাফিজ কট বিহান্ড ছিলেন কিন্তু তাতে আম্পায়ারের আউট দেননি। মাঠে এই ধরনের বিতর্ক এড়াতে আইসিসি ডিআরএস (ডিসিশন রিভিউ সিস্টেম) পদ্ধতির প্রস্থাব করেছিল, খেলা চলাকালীন প্রায় সব মাঠেই এর কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। প্রযুক্তিটি একবারে ১০০% নিখুত করতে আরও একটু সময় হয়ত লাগত কিন্তু এর মাঝেই মাঠের আম্পায়ারদের দারুন সাহায্য করা শুরু করেছিল। কিন্তু বিধি বাম, বিশ্বের প্রভাবশালী ভারতীয় বোর্ড শুরু থেকেই এর বিরোধীতা করছিলো আর শেষ পেরেকটা ঠুকা হল ভারতের ইংল্যান্ড সফরে “ধবল ধোলাই’’ হওয়ার পর। তাদের নাছোড়বান্দা যুক্তি হল এটা পরিপূর্ণ না, এটা হয়ত ঠিক যে কয়েকটি সিদ্ধান্ত তাদের বিপক্ষে গিয়েছিল কিন্তু এর জন্য প্রযুক্তিকে দায়ী করা যায় না। প্রযুক্তিত আর ভারত-পাকিস্তান বা সাদা-কালো চিনেনা। মাঠে ডিআরএস বাধ্যতামূলক হলে প্রতি ম্যাচে সব বোর্ডকে ৫ হাজার ডলার গুনতে হত। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী বোর্ডের ৫ হাজার ডলারের বিলটি বড্ড বেশি মনে হয়েছিলো তাই ইতিমধ্যে ডিআরএস পদ্ধতির কবর দেয়া হয়ে গেছে। একগুয়ে ব্যাবসায়িক মনোবৃত্তির জন্য আরেকটি ভালো ক্রিকেটীয় উদ্যোগ মাঠে মারা গেল।
খেলোয়াড়েরা কাপড় পড়েন লজ্জা ঢাকতে আর ক্রিকেট বোর্ডগুলি সেই লজ্জা ঢাকতে ফিলা, এডিডাস, নাইকি, রিবকের মত ক্রীড়া সামগ্রী প্রস্তুতকারকদের পিছনে ছুটছে, যদি কোনও ভাবে একটি ভালো ডিল করা যায় তাইলে বিপুল পরিমান টাকা বোর্ডের একাউন্টে ঢুকানো যাবে! নাইকি ইতিমধ্যে বিসিসিআই সাথে প্রায় $৬০ মিলিয়ন ডলারের নতুন চুক্তি করে ফেলেছে, আর টাইটেল স্পন্সরশিপ বাবদ প্রতি ম্যাচে ভারতীয় বোর্ড সাহারা থেকে পাবে $৭ লাখ ৫০ হাজার ডলার আর বাংলাদেশ চার বছরে সব ধরনের স্পন্সরশিপ বাবদ আয় করবে প্রায় $ ১ কোটি ১৪ লাখ ডলার বছরে প্রায় $ ২৮ লাখ ৫০ হাজারের মত যা ভারতের চার ম্যাচের পাওয়া অর্থের সমপরিমাণ! স্পন্সরশিপ চুক্তির তালিকায় কি নেই, জুতা-মোজা থেকে বাউন্ডারির রশি পর্যন্ত সব কিছুই এখন বিকোয়।
দেশে দেশে বোর্ড আর খেলোয়াড়দের মাঝে যে আকাশসম পার্থক্য তা অনেক অনিয়মের জন্ম দিচ্ছে। একসময় অস্ট্রেলিয়ার একচেটিয়া দাপটে ক্রিকেট বিশ্বকে তটস্থ থাকতে হত আর এখন ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। তাদের খেয়াল খুশি মতই আইন কানুন তৈরি হচ্ছে, ক্রিকেট সূচিতে তাদের মতামতটাকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে, প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন টেস্ট ক্রিকেটে আমরা ১০ বছর পার করলেও এখন পর্যন্ত ভারতের সাথে তাদের মাটিতে খেলাই হয়নি! বিসিসিআই টাকার গরমে প্রতিবেশী এক দেশকে একঘরে করে রেখেছে, বিপিএলে নিজেদের খেলোয়াড়দের ছাড়ত দেয়নি উল্টো পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের ডাকায় বিসিসিআই উষ্মা প্রকাশ করেছে, শ্রীলংকা বোর্ড প্রধান রানাতুঙ্গাকে বরখাস্ত করতেও তাদের ইন্ধন ছিল। ক্রিকেটে মেরুকরন প্রায় সম্পূর্ণ, বিসিসিআই এর সাথে থেকে হয় কামাও নয়ত একঘরে হয়ে থাকও।
লেখাটা ইতিবাচক উপাদান দিয়ে শেষ করতে চাই। চারদিকে অর্থের ঝনঝনানি কিন্তু অনেক ভালো ক্রিকেটারের মন গলাতে পারেনি। তাদের কাছে নৈতিকতা ও দেশাত্ত্ববোধের স্থান অর্থের অনেক উপরে। এইরকম একজন খেলোয়াড়ের নাম হাশিম আমলা যিনি এখন পর্যন্ত আইপিএলে নাম লেখান নাই। যারা তার টেস্ট ইনিংস দেখেছেন তারা বুঝবেন কার কথা বলছি (টেস্টে স্ট্রাইকিং রেট ৫১), এরকম পারফরম্যান্স নিয়েও তিনি প্রাইভেট টি-২০ টুর্নামেন্টের ধারে কাছেও নেই। নিজের জার্সিতে মদের বিজ্ঞাপন লাগাননা তাই তাকে প্রতি ম্যাচে ২০০ ডলার করে জরিমানা দিতে হয় তারপরেও নৈতিকতার সাথে আপোস নয়। পাঠকরা হয়ত বলতে পারেন তার এই আচরণের সাথে ক্রিকেটের কি সম্পর্ক? তিনি পেশাদার ক্রিকেটার কিন্তু ক্রিকেট মার্সেনারি নন, ক্রিকেট খেলেন ভালোলাগা থকে শুধু অর্থ উপার্জনের জন্য নয়। ক্রিকেটাররা যদি আস্তে আস্তে বাড়তি অর্থ কামাইয়ের উপর নৈতিকতার স্থান দেন তাইলে বোর্ডের অর্থলিপ্সা একসময় বন্ধ হবে। আজকের দিনে ক্রিকেট আর ব্যাবসা একে অপরের সাথে মিলেমিশে আছে কিন্তু শুধু টাকার জন্য ক্রিকেটের সুন্দর আবেদনকে উপেক্ষা করা বোকামি।

Post a Comment