বাপ-দাদাদের মুখে শুনে আর পেপার পত্রিকা পড়ে জেনেছি আগের দিনে আবাহনী মোহামেডানের খেলা হলে নাকি সারা দেশে ফুটবলের অন্তত কিছুও যারা জানে তারা নাকি দুই ভাগে ভাগ হয়ে যেত। খেলার সপ্তাহখানেক আগে থেকে চায়ের টেবিলে, দোকানের বেঞ্চে, স্টেডিয়াম পাড়ায় চলত ম্যাচের গবেষনা আর ম্যাচের পর সপ্তাহখানেকের বেশি সময় ধরে চলত ম্যাচের পোস্টমর্টেম। এখনকার প্রজন্মের খুব কম ছেলেমেয়েই আছে যারা বাংলাদেশের ফুটবল তথা ঘরোয়া যদিও সেই ছোটবেলা থেকে হোমড়াচোমড়া কর্মকর্তাদের মুখে শুনে আসছি অচিরেই বাংলাদেশের ফুটবল এশীয় মানে পৌছাবে। আমি একজন খুব সাধারন দর্শক বা সমর্থক হিসেবে চিন্তা করি আমাদের ফুটবলের এই হাল কেন। খুব গভীর গবেষনায় না গিয়ে সাদামাটা কথায় আমি কিছু চিন্তাভাবনা তুলে ধরি। সচলায়তনে দেশের অনেক সমস্যা নিয়ে অনেক লেখা নিয়মিত আসে। সেই তুলনায় এই বিষয়টি সামান্য। তবে এটাও ঠিক যে খেলাধুলাই একমাত্র জিনিস যা আমাদের পুরো জাতিকে একসাথে হাসাতে পারে অথবা একসাথে কাঁদাতে পারে। আর আমাদের যে একটা ফুটবল ঐতিহ্য ছিল যা এখন মূমুর্ষ অবস্থায় আছে সেটা তো অস্বীকার করার উপায় নাই।
ফুটবলের কোন খোজখবর রাখে। জানি না সুদূর ভবিষ্যতে এমন দিন আসবে কিনা যখন তরুন ছেলেমেয়েরা আদৌ বিশ্বাস করবে আমাদেরও একটা ফুটবল ঐতিহ্য ছিল এবং সালাহউদ্দিন, সালাম মুর্শেদী, আসলাম, কায়সার হামিদ, সাব্বিররা একেকজন এমন সেলিব্রেটি ফুটবলার ছিলেন যাদের খেলা দেখতে তো বটেই প্র্যাকটিস দেখার জন্য পর্যন্ত মাঠে ভীড় জমত। আমি ফুটবলবোদ্ধা নই। আমি খুব সাধারন একজন ফুটবলপ্রেমী। পত্রপত্রিকার মাধ্যমে দেশের ফুটবলের নিয়মিত খোজখবর রাখার চেষ্টা করি। আমার কাছে মনে হয় আমাদের ফুটবল একটা গন্ডি থেকে কেন যেন বের হতে পারছে না। দশ বছর আগে যে অবস্থায় ছিল এখন তার থেকে উন্নতি তো হয়নিই বরং আরো খারাপ হয়েছে।
বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ন্ত্রঙ্কারী সংস্থা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। বাফুফের বর্তমান প্রেসিডেন্ট এককালের স্বনামধন্য ফুটবলার কাজী সালাহউদ্দিন। তিনি যখন ২০০৮ এ প্রথম বাফুফের সভাপতির দায়িত্ব নেন তখনও ফুটবলের অবস্থা বিশেষ ভাল ছিল না। তখন তার বলা একটি কথা আমার বেশ মনে ধরেছিল। তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরপরই বলেছিলেন আমি মাঠে খেলেছি, টেকনিক্যাল লোক। খেলোয়াড় বা কেউ যদি নিজের হান্ড্রেড পার্সেন্ট না দেয় আমার চোখে ধরা পড়ে যাবে। কথাটা পড়ে বুঝলাম অবশেষে ফুটবলটা একজন যোগ্য লোকের হাতে পড়ল। স্বপ্ন দেখতে চাইলাম বাংলাদেশ এখন দক্ষিন এশিয়ার সেরা হবে। এশিয়ার মাঝারি শক্তির দলগুলোর সাথে অন্তত লড়াই করবে। দেখতে দেখতে কাজী সালাহউদ্দিনের প্রথম কিস্তির চার বছরের মেয়াদ শেষ হল। এসময় বাংলাদেশ ফুটবল দলের বলার মত কোন সাফল্য নেই। তবে অনেকে হয়ত বলবেন বাংলাদেশের ফুটবল কিছু পেয়েছে। কি পেয়েছে? বাংলাদেশে মেসির মত খেলোয়াড় খেলে গেছে। আর্জেন্টিনা মোটামুটি পুরো শক্তির দল নিয়ে খেলে গেছে নাইজেরিয়ার সাথে। বিশ্বের মানুষের কাছে বাংলাদেশকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া গেছে যে আমাদের দেশের মানুষ ফুটবলকে ভালবাসে। ফিফা প্রেসিডেন্ট সেফ ব্লাটারকে নিয়ে এসেছেন সালাহউদ্দিন। তিনি বিপুল অর্থ সাহায্যের আশ্বাস দিয়ে গেছেন। এদিকে সালাহউদ্দিনও আশ্বাস দিলেন পরেরবার নির্বাচিত হলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে নিয়ে আসবেন। তিনি আরো চার বছরের জন্য বাফুফে সভাপতিও নির্বাচিত হলেন। কিন্তু এই আর্জেন্টিনা নাইজেরিয়া ম্যানইউ দিয়ে বাংলাদেশের ফুটবল দলটার কি লাভ হল? আর্জেন্টিনা নাইজেরিয়া খেলায় টিকেটের উচ্চমূল্য ধার্য করায় বাফুফে শুনছিলাম ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ক্ষতি না হলেও দেশের ফুটবলের যে কোন দৃষ্টিগোচর লাভ হয়নি তা তো পরিস্কার।
বাংলাদেশের ফুটবলের বেহাল দশার মূল কারন ঘরোয়া ফুটবলের অত্যন্ত দুর্বল কাঠামো। ঘরোয়া ফুটবলের সবচেয়ে বড় অংশ হচ্ছে পেশাদার লীগ যার নাম বি-লীগ। এছাড়া ফেডারেশন কাপ দিয়ে বরাবর মৌসুম শুরু হয়। গত দুবছর সুপার লীগ নামে কোটি টাকার টুর্নামেন্ট বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল কিন্তু এবছর তা বাদ পড়ে যাচ্ছে। পরের বছর থেকে আবার আদৌ হবে কিনা তার কোন ঠিক নেই। এবছরের বি-লীগ শুরুর পর থেকেই নানা অজুহাতে তা বাধাগ্রস্থ হয়েছে। কখনো বৃষ্টির কারনে, কখনো হরতাল, কখনো বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে সমুদ্রজয়ের সভার কারনে টানা অনেকদিন ধরেই বিরতি পড়েছে। এর ফলে ক্লাবগুলো যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তেমনি ঘনঘন বিরতিতে খেলোয়াড়দের মনোসংযোগও বিচ্যুত হয়। দেশের পেশাদার লীগের ব্যবস্থাপনাতে যখন এত অনিয়ম তখন সেখানে ভাল মানের ফুটবল আসা করাই বোকামি। তাছাড়া আন্তর্জাতিক কোন ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করা তো সেখানে অসম্ভব ব্যাপার।
ব্যবস্থাপনা ত্রুটির থেকেও আরো ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে পাতানো খেলা। পাতানো খেলার ঘটনা যে শুধু আমাদের দেশে ঘটে তাই না, অনেক বড় বড় দেশের ফুটবলেও পাতানো খেলার অনেক নজির আছে। তবে যেকোনো অপরাধের যখন ন্যায় বিচার এবং যথাযথ শাস্তির প্রয়োগ থাকে না তখন সেই অপরাধটি ক্রমাগত হতে থাকবে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেবে এটাই স্বাভাবিক। পাতানো খেলা দেশের ঘরোয়া লীগের প্রায় প্রতিটি আসরে ঘটে থাকলেও অজানা কারনে কেন যেনো কখনই কোন কঠিন শাস্তি দেওয়া হয় না। ২০১০-১১ এর পেশাদার লীগের চ্যাম্পিয়ন হ্য় শেখ জামাল ক্রীড়া চক্র। লীগ শেষ হওয়া মাত্র প্রমানিত হল তারা লীগের অপর একটি দল রহমতগঞ্জের সাথে পাতানো খেলায় জড়িত ছিল। শাস্তি হিসাবে উভয় দলের আর্থিক জরিমানা করা হল। কোন পয়েন্ট কাটা হল না, চ্যাম্পিয়নশীপে হাত দেওয়া হল না, কাউকে বহিস্কারও করা হল না। এমন হাস্যকর শাস্তির বিধান পাতানো খেলাকে উৎসাহিতই করে। অথচ একটা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রয়োগ হয়ত কয়েক বছরের জন্য পাতানো খেলাকে বন্ধ করতে পারতো। অন্তত এতো বাজে ফুটবলের প্রদর্শনী সত্ত্বেও যেসব দর্শক মাঠে গিয়ে খেলাটা দেখে তারা অন্তত নিজেদের প্রতারিত মনে করতো না। গত বছরের হাস্যকর শাস্তির ফল এ বছরের লীগে পাওয়া যাচ্ছে। এবছরের লীগে ব্রাদার্স ইউনিয়ন ও রহমতগঞ্জের (সেই একই দল) খেলা পাতানো ছিল তার যৌক্তিক প্রমান পাওয়ায় তদন্ত চলছে। এক্ষেত্রে রহমতগঞ্জের রেলিগেশন এড়ানোর জন্য তাদের অনুকূলে ম্যাচ ছেড়েছে এক সময়ের তৃ্তীয় শক্তি ব্রাদার্স ইউনিয়ন। এতো গেল প্রমানিত হওয়া পাতানো ম্যাচগুলোর কথা। এছাড়া কত কত ম্যাচ যে শুধু চামড়ার চোখেই বোঝা যায় পাতানো অথচ প্রমান হয় না বা প্রমান করা হয় না তা বাদই দিলাম।
এবার আসি বিদেশী খেলোয়াড় প্রসঙ্গে। এবছরের লীগের নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটা দল ছয়জন বিদেশী নিবন্ধন করতে পারবে এবং এক ম্যাচে সর্বাধিক চারজন খেলাতে পারবে। প্রথম লেগ শেষে নতুন করে নিবন্ধন করা যাবে। এ পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু দুই একজন বাদে যে অত্যন্ত নিম্নমানের বিদেশী খেলোয়াড় দেশের সবচেয়ে বড় পেশাদার লীগে খেলতে আসে তা হতাশাব্যাঞ্জক। এসব খেলোয়াড়গুলোর বেশিরভাগেরই স্কিল বলতে কিছু নেই, আছে শুধু বিশাল দেহ। মাঠে খেলার চেয়ে বলপ্রয়োগেই এদের আগ্রহ বেশি। এসব খেলোয়াড়রা খেলার সৌন্দর্য নষ্ট করেই শেষ না, বরং মারামারি এমনকী রেফারীকে হুমকি ধামকি দেওয়ার ব্যাপারেও ওস্তাদ। দুঃখের ব্যাপার ক্লাবগুলোর বিদেশী খেলোয়াড় বাছাই এর ব্যাপারে দক্ষতা খুবই কম। বেশিরভাগ ক্লাবগুলোই আফ্রিকার দেশগুলো থেকে সস্তায় পাওয়া খেলোয়াড়দের ব্যাপারেই বেশি আগ্রহী। এমনকি খুব কম ক্লাবই আছে যারা নিবন্ধনের আগে এসব খেলোয়াড়গুলোর পর্যাপ্ত স্কিল টেস্ট নেয়। ফলে কোনরকম পরীক্ষা ছাড়াই পাশ করা যায় বলে অনেক আফ্রিকান ফুটবলারদের কাছেই বাংলাদেশ বেশ ভাল পছন্দ। তাছাড়া ক্লাবগুলোর সম্পর্কে এমন অভিযোগ আছে যে বিদেশী খেলোয়াড়দের পাওনা টাকা নিয়মিত দেওয়া হয় না। ফলে খেলোয়াড়রাও ইচ্ছে মত প্র্যাকটিসে আসে, ইচ্ছে মত চলে যায়। তারপরও কোন কারনে কিছু কিছু ক্লাবের বিদেশী খেলোয়াড়প্রীতি অনেক। গত বছর বিদেশী খেলোয়াড়দের সুযোগ দিতে যেয়ে বিগ বাজেটের দল শেখ জামাল দেশে্র প্রধান স্ট্রাইকারকে সাইড বেঞ্চে বসিয়ে রাখে ম্যাচের পর ম্যাচ। এবছরের লীগে এমন খবরও দেখেছি দেশের খেলোয়াড়রা নিজের দলের বিদেশী খেলোয়াড়দের সাথে মাঠেই বাক-বিতন্ডায় জড়িয়েছেন। তাদের অভিযোগ বিদেশী খেলোয়াড়রা নাকি খালি নিজেদের মধ্যে পাস দেয়, দেশী খেলোয়াড়দের পাস দেয় না। এই যদি হয় খেলার অবস্থা তাহলে ফুটবল বাঁচবে কিভাবে!
এবার দেশের খেলোয়াড়দের প্রসঙ্গে আসি। ২০১১-১২ এর বি-লীগের প্রথম লেগের দশ ম্যাচ শেষে দেশের প্রধান দুই স্ট্রাইকারের গোলসংখ্যা ছিল চার এবং দুই! খেলোয়াড়দের খেলা দেখে কখনোই মনে হয়না যে তারা পুরো নব্বই মিনিট পর্যাপ্ত স্ট্যামিনা নিয়ে খেলার উপযুক্ত। বেশিরভাগ খেলোয়াড়দের ফিটনেসের অবস্থা ভালো না যার প্রতিফলন দেখা যায় অন্য দেশগুলোর সাথে খেলার সময়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের সাথে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের ফিটনেসের পার্থক্য পরিস্কার হয়ে ওঠে। নামে পেশাদার লিগ হলেও খেলোয়াড়দের মধ্যে পেশাদারিত্বের ছিটেফোটাও দেখা যায় না। দলের প্রতি কমিটমেন্ট, সার্বক্ষনিক ফুটবল চিন্তা, স্কিল ডেভেলপমেন্ট এগুলোর বড় অভাব। অনেক খেলোয়াড়ের জাতীয় দলের অনুশীলনে না এসে খ্যাপ খেলতে যাওয়ার নজিরও আছে। দেশের বয়সভিত্তিক ফুটবল কাঠামোর মানও তত উন্নত নয়। জেলাভিত্তিক ফুটবল হলেও দেশের বড় দলগুলোর তেমন কোন জুনিয়র ফুটবল টিম নেই বা জুনিয়রদের জন্য বড় দলগুলোকে নিয়ে কোন টুর্নামেন্ট নেই। দেশের ফুটবলের সবচেয়ে জনপ্রিয় দুই দল আবাহনী-মোহামেডানসহ সবগুলো দলের যদি অনূর্ধ্ব-১৬ বা অনূর্ধ্ব-১৯ দল থাকতো এবং এই দলগুলোর মধ্যে নিয়মিত খেলা হত, তাহলে ছোটবেলা থেকেই খেলোয়ারদের মধ্যে স্কিল ডেভেলপমেন্ট, চাপ নেওয়ার ক্ষমতা, কমিটমেন্ট, পেশাদারিত্ব ইত্যাদি তৈরী হত যেটা ইংল্যান্ড, স্পেন বা ইতালির বড় বড় দলগুলোতে দেখা যায়। তাছাড়া ক্লাবগুলোরও একটা ভালো খেলোয়াড় পাইপলাইন থাকতো যা তাদের মূল দল গঠনে বড় ভূমিকা রাখতে পারতো। সেক্ষেত্রে সস্তামানের বিদেশী খেলোয়াড়দের উপর নির্ভরশীলতাও দূর হত।
আরেকটা বিষয়ের দিকে নজর দেই যেটা থেকে বাফুফে কিছুতেই দায়মুক্ত হতে পারে না। তা হল জাতীয় দলের জন্য একজন ভালো ও দীর্ঘমেয়াদী কোচের ব্যবস্থা করা। শেষ কবে একজন সফল কোচ মেয়াদ শেষ করে বিদায় নিয়েছেন তা বোধহয় বাফুফের কর্মকতারাও বলতে পারবেন না। প্রতিবারই দেখা যায় নিয়োগ দেওয়ার পর বাবুফের কোচ পছন্দ হয় না অথবা কোচের ফেডারেশনের সাথে বনিবনা হয় না। ফেডারেশন কোচের চাহিদা অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে না এই অভিযোগ অনেক পুরোনো। কিন্তু বছরের পর বছর কোচ ধরে রাখতে না পারার ব্যর্থতা অবশ্যই বাফুফের। নিয়োগের পর যদি কোচ পছন্দ না হয় তো সেটা নিয়োগের আগেই ভালোমত খোজখবর করে দেখা উচিৎ। যেই দলের একজন কোচ নেই যে বছরখানেক ধরে দেশের ফুটবলকে কাছ থেকে দেখেছে, সেই দলের খেলোয়াড়দের থেকে ভালো কিছু আশা করা বোকামি। একটা ফুটবল ফেডারেশন যদি দেশের জাতীয় দলের জন্য একটা ভালো কোচের ব্যবস্থা করতে না পারে তো সেই ফেডারেশন পারেটা কি! দেশের জাতীয় দলের কোচ নেই আর ওদিকে আমি আর্জেন্টিনা-ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড নিয়ে আসলাম, এমনই যদি অবস্থা হয় তো ফেডারেশনের লোকদের চিন্তা-ভাবনার গভীরতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে।
এতোকিছুর পরও কিন্তু দেশের মানুষ ফুটবল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় না। এখনো মাঠে যদি আবাহনী মোহামেডানের কোন শিরোপা নির্ধারনী খেলা হয়, স্টেডিয়াম কানায় কানায় ভরে যায়। স্টেডিয়ামের বাইরে দশগুন দামে কালোবাজারে টিকেট বিক্রি হয়। তাও কিন্তু মানুষ টিকেট কিনে খেলা দেখতে আসে। তিন বছর আগে সাফ ফুটবলে বাংলাদেশ যখন সেমিফাইনালে ভারতের সাথে খেলবে, আমি নিজে দেখেছি মানুষ পঞ্চাশ টাকার টিকেট চারশ টাকায় কিনে মাঠে ঢুকছে। দেশের প্রধান দুটি সমর্থনপুষ্ট দল আবাহনী-মোহামেডান যদি ভালো দল গঠন না করে, পরস্পরের প্রতিদ্বন্দীতায় আসতে না পারে তাহলে কিন্তু দর্শক গ্যালারি ভরবে না। দেশের ফুটবল উন্নয়নে বাফুফের যেমন উদ্যোগী হতে হবে, তেমনি ক্লাবগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। অথচ দুঃখের বিষয় দেশের ক্লাবগুলোর তেমন কোন ভালো আবাসন ব্যবস্থা নেই। এমনকি মোহামেডানের মত দলের নিজস্ব কোন মাঠও নেই। এই ব্যাপারগুলোতে ক্লাবগুলোর আরো যত্নবান হওয়া উচিৎ। দেশের ফুটবলের মান্নোয়নে নিচের পদক্ষেপগুলো, যা মোটামুটি সবাই জানে, বাফুফে ও ক্লাবগুলোর যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করা উচিৎঃ
১। ঘরোয়া ফুটবলে পেশাদারিত্ব বাড়ানো।
২। ফুটবলের জন্য সারা দেশের মধ্যে অন্তত তিনটি মাঠের ব্যবস্থা রাখা যেখানে মারাত্মক প্রাকৃতিক দূর্যোগ ছাড়া (অথবা রাজনৈতিক!) খেলা বন্ধ হবে না।
৩। ঘরোয়া ফুটবলের ক্যালেন্ডার বাস্তবায়ন করা এবং টুর্নামেন্টগুলো আরো আকর্ষনীয় ও প্রতিযোগিতামূলক করা।
৪। জাতীয় দলের জন্য ভালো ও দীর্ঘমেয়াদী কোচের ব্যবস্থা করা।
৫। বয়সভিত্তিক ফুটবল টুর্নামেন্ট বাড়ানো।
৬। সারাদেশে পর্যাপ্ত ফুটবল একাডেমী তৈরী করা যা যেকোন ফুটবলারের স্কিল ডেভেলপমেন্টে ভূমিকা রাখতে পারে।
৭। পেশাদার লীগের বড় দলগুলোর বয়সভিত্তিক দলগঠন বাধ্যতামূলক করা এবং ওই দলগুলোর মধ্যে নিয়মিত খেলার ব্যবস্থা করা।
৮। খেলোয়াড়দের ফিটনেস ও ইনজুরিকালীন সুবিধা বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া।
৯। ক্লাবগুলোর নিজস্ব মাঠ ও আবাসন সুবিধা বৃদ্ধি করা।
১০। ক্লাবগুলোর বিদেশি খেলোয়াড় নিয়োগে আরো যত্নবান হওয়া।
১১। জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে পেশাদারী মনোভাব চালু করা।
১২। সর্বোপরি পাতানো খেলা রোধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া।
আমার বিশ্বাস দেশের ফুটবল নিয়ে মানুষ এখনো স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দেয়নি। তা না হলে ভালো কোন খেলায় এখনো কেন উপচে পড়া ভিড় হবে। বল যখন দেশের ছেলেদের পায়ে আসে তখন পেছন থেকে বলতে শুনি, “বল এবার লাল জামা চিন্সে ভাই, নইড়্যা বসেন!”। আমি জানি অনেকে এখনো আশা রাখে আমরা অন্তত দক্ষিন এশিয়ার সেরা দল হবো, এশীয়ার সেরা দলগুলোর সাথে সমানে সমানে লড়াই করব। বিশ্বকাপের বাছাই পর্ব দশ বছরের মধ্যে পেরোতে না পারি, অন্তত প্রতি বছর একটা লক্ষ্য নিয়ে প্রতিযোগীতায় নামব, যে লক্ষ্য হবে আগের বছরের চেয়ে বেশি কিছু। আর আমরা দেশের পতাকা নিয়ে খেলা দেখতে যাবো, বাড়ি ফেরার সময় মুখে হাসি থাকুক বা চোখে অস্রু থাকুক, মনটা অন্তত দেশের ফুটবলাররা জিতে নেবে।
ফুটবলের কোন খোজখবর রাখে। জানি না সুদূর ভবিষ্যতে এমন দিন আসবে কিনা যখন তরুন ছেলেমেয়েরা আদৌ বিশ্বাস করবে আমাদেরও একটা ফুটবল ঐতিহ্য ছিল এবং সালাহউদ্দিন, সালাম মুর্শেদী, আসলাম, কায়সার হামিদ, সাব্বিররা একেকজন এমন সেলিব্রেটি ফুটবলার ছিলেন যাদের খেলা দেখতে তো বটেই প্র্যাকটিস দেখার জন্য পর্যন্ত মাঠে ভীড় জমত। আমি ফুটবলবোদ্ধা নই। আমি খুব সাধারন একজন ফুটবলপ্রেমী। পত্রপত্রিকার মাধ্যমে দেশের ফুটবলের নিয়মিত খোজখবর রাখার চেষ্টা করি। আমার কাছে মনে হয় আমাদের ফুটবল একটা গন্ডি থেকে কেন যেন বের হতে পারছে না। দশ বছর আগে যে অবস্থায় ছিল এখন তার থেকে উন্নতি তো হয়নিই বরং আরো খারাপ হয়েছে।
বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ন্ত্রঙ্কারী সংস্থা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। বাফুফের বর্তমান প্রেসিডেন্ট এককালের স্বনামধন্য ফুটবলার কাজী সালাহউদ্দিন। তিনি যখন ২০০৮ এ প্রথম বাফুফের সভাপতির দায়িত্ব নেন তখনও ফুটবলের অবস্থা বিশেষ ভাল ছিল না। তখন তার বলা একটি কথা আমার বেশ মনে ধরেছিল। তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরপরই বলেছিলেন আমি মাঠে খেলেছি, টেকনিক্যাল লোক। খেলোয়াড় বা কেউ যদি নিজের হান্ড্রেড পার্সেন্ট না দেয় আমার চোখে ধরা পড়ে যাবে। কথাটা পড়ে বুঝলাম অবশেষে ফুটবলটা একজন যোগ্য লোকের হাতে পড়ল। স্বপ্ন দেখতে চাইলাম বাংলাদেশ এখন দক্ষিন এশিয়ার সেরা হবে। এশিয়ার মাঝারি শক্তির দলগুলোর সাথে অন্তত লড়াই করবে। দেখতে দেখতে কাজী সালাহউদ্দিনের প্রথম কিস্তির চার বছরের মেয়াদ শেষ হল। এসময় বাংলাদেশ ফুটবল দলের বলার মত কোন সাফল্য নেই। তবে অনেকে হয়ত বলবেন বাংলাদেশের ফুটবল কিছু পেয়েছে। কি পেয়েছে? বাংলাদেশে মেসির মত খেলোয়াড় খেলে গেছে। আর্জেন্টিনা মোটামুটি পুরো শক্তির দল নিয়ে খেলে গেছে নাইজেরিয়ার সাথে। বিশ্বের মানুষের কাছে বাংলাদেশকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া গেছে যে আমাদের দেশের মানুষ ফুটবলকে ভালবাসে। ফিফা প্রেসিডেন্ট সেফ ব্লাটারকে নিয়ে এসেছেন সালাহউদ্দিন। তিনি বিপুল অর্থ সাহায্যের আশ্বাস দিয়ে গেছেন। এদিকে সালাহউদ্দিনও আশ্বাস দিলেন পরেরবার নির্বাচিত হলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে নিয়ে আসবেন। তিনি আরো চার বছরের জন্য বাফুফে সভাপতিও নির্বাচিত হলেন। কিন্তু এই আর্জেন্টিনা নাইজেরিয়া ম্যানইউ দিয়ে বাংলাদেশের ফুটবল দলটার কি লাভ হল? আর্জেন্টিনা নাইজেরিয়া খেলায় টিকেটের উচ্চমূল্য ধার্য করায় বাফুফে শুনছিলাম ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ক্ষতি না হলেও দেশের ফুটবলের যে কোন দৃষ্টিগোচর লাভ হয়নি তা তো পরিস্কার।
বাংলাদেশের ফুটবলের বেহাল দশার মূল কারন ঘরোয়া ফুটবলের অত্যন্ত দুর্বল কাঠামো। ঘরোয়া ফুটবলের সবচেয়ে বড় অংশ হচ্ছে পেশাদার লীগ যার নাম বি-লীগ। এছাড়া ফেডারেশন কাপ দিয়ে বরাবর মৌসুম শুরু হয়। গত দুবছর সুপার লীগ নামে কোটি টাকার টুর্নামেন্ট বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল কিন্তু এবছর তা বাদ পড়ে যাচ্ছে। পরের বছর থেকে আবার আদৌ হবে কিনা তার কোন ঠিক নেই। এবছরের বি-লীগ শুরুর পর থেকেই নানা অজুহাতে তা বাধাগ্রস্থ হয়েছে। কখনো বৃষ্টির কারনে, কখনো হরতাল, কখনো বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে সমুদ্রজয়ের সভার কারনে টানা অনেকদিন ধরেই বিরতি পড়েছে। এর ফলে ক্লাবগুলো যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তেমনি ঘনঘন বিরতিতে খেলোয়াড়দের মনোসংযোগও বিচ্যুত হয়। দেশের পেশাদার লীগের ব্যবস্থাপনাতে যখন এত অনিয়ম তখন সেখানে ভাল মানের ফুটবল আসা করাই বোকামি। তাছাড়া আন্তর্জাতিক কোন ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করা তো সেখানে অসম্ভব ব্যাপার।
ব্যবস্থাপনা ত্রুটির থেকেও আরো ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে পাতানো খেলা। পাতানো খেলার ঘটনা যে শুধু আমাদের দেশে ঘটে তাই না, অনেক বড় বড় দেশের ফুটবলেও পাতানো খেলার অনেক নজির আছে। তবে যেকোনো অপরাধের যখন ন্যায় বিচার এবং যথাযথ শাস্তির প্রয়োগ থাকে না তখন সেই অপরাধটি ক্রমাগত হতে থাকবে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেবে এটাই স্বাভাবিক। পাতানো খেলা দেশের ঘরোয়া লীগের প্রায় প্রতিটি আসরে ঘটে থাকলেও অজানা কারনে কেন যেনো কখনই কোন কঠিন শাস্তি দেওয়া হয় না। ২০১০-১১ এর পেশাদার লীগের চ্যাম্পিয়ন হ্য় শেখ জামাল ক্রীড়া চক্র। লীগ শেষ হওয়া মাত্র প্রমানিত হল তারা লীগের অপর একটি দল রহমতগঞ্জের সাথে পাতানো খেলায় জড়িত ছিল। শাস্তি হিসাবে উভয় দলের আর্থিক জরিমানা করা হল। কোন পয়েন্ট কাটা হল না, চ্যাম্পিয়নশীপে হাত দেওয়া হল না, কাউকে বহিস্কারও করা হল না। এমন হাস্যকর শাস্তির বিধান পাতানো খেলাকে উৎসাহিতই করে। অথচ একটা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রয়োগ হয়ত কয়েক বছরের জন্য পাতানো খেলাকে বন্ধ করতে পারতো। অন্তত এতো বাজে ফুটবলের প্রদর্শনী সত্ত্বেও যেসব দর্শক মাঠে গিয়ে খেলাটা দেখে তারা অন্তত নিজেদের প্রতারিত মনে করতো না। গত বছরের হাস্যকর শাস্তির ফল এ বছরের লীগে পাওয়া যাচ্ছে। এবছরের লীগে ব্রাদার্স ইউনিয়ন ও রহমতগঞ্জের (সেই একই দল) খেলা পাতানো ছিল তার যৌক্তিক প্রমান পাওয়ায় তদন্ত চলছে। এক্ষেত্রে রহমতগঞ্জের রেলিগেশন এড়ানোর জন্য তাদের অনুকূলে ম্যাচ ছেড়েছে এক সময়ের তৃ্তীয় শক্তি ব্রাদার্স ইউনিয়ন। এতো গেল প্রমানিত হওয়া পাতানো ম্যাচগুলোর কথা। এছাড়া কত কত ম্যাচ যে শুধু চামড়ার চোখেই বোঝা যায় পাতানো অথচ প্রমান হয় না বা প্রমান করা হয় না তা বাদই দিলাম।
এবার আসি বিদেশী খেলোয়াড় প্রসঙ্গে। এবছরের লীগের নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটা দল ছয়জন বিদেশী নিবন্ধন করতে পারবে এবং এক ম্যাচে সর্বাধিক চারজন খেলাতে পারবে। প্রথম লেগ শেষে নতুন করে নিবন্ধন করা যাবে। এ পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু দুই একজন বাদে যে অত্যন্ত নিম্নমানের বিদেশী খেলোয়াড় দেশের সবচেয়ে বড় পেশাদার লীগে খেলতে আসে তা হতাশাব্যাঞ্জক। এসব খেলোয়াড়গুলোর বেশিরভাগেরই স্কিল বলতে কিছু নেই, আছে শুধু বিশাল দেহ। মাঠে খেলার চেয়ে বলপ্রয়োগেই এদের আগ্রহ বেশি। এসব খেলোয়াড়রা খেলার সৌন্দর্য নষ্ট করেই শেষ না, বরং মারামারি এমনকী রেফারীকে হুমকি ধামকি দেওয়ার ব্যাপারেও ওস্তাদ। দুঃখের ব্যাপার ক্লাবগুলোর বিদেশী খেলোয়াড় বাছাই এর ব্যাপারে দক্ষতা খুবই কম। বেশিরভাগ ক্লাবগুলোই আফ্রিকার দেশগুলো থেকে সস্তায় পাওয়া খেলোয়াড়দের ব্যাপারেই বেশি আগ্রহী। এমনকি খুব কম ক্লাবই আছে যারা নিবন্ধনের আগে এসব খেলোয়াড়গুলোর পর্যাপ্ত স্কিল টেস্ট নেয়। ফলে কোনরকম পরীক্ষা ছাড়াই পাশ করা যায় বলে অনেক আফ্রিকান ফুটবলারদের কাছেই বাংলাদেশ বেশ ভাল পছন্দ। তাছাড়া ক্লাবগুলোর সম্পর্কে এমন অভিযোগ আছে যে বিদেশী খেলোয়াড়দের পাওনা টাকা নিয়মিত দেওয়া হয় না। ফলে খেলোয়াড়রাও ইচ্ছে মত প্র্যাকটিসে আসে, ইচ্ছে মত চলে যায়। তারপরও কোন কারনে কিছু কিছু ক্লাবের বিদেশী খেলোয়াড়প্রীতি অনেক। গত বছর বিদেশী খেলোয়াড়দের সুযোগ দিতে যেয়ে বিগ বাজেটের দল শেখ জামাল দেশে্র প্রধান স্ট্রাইকারকে সাইড বেঞ্চে বসিয়ে রাখে ম্যাচের পর ম্যাচ। এবছরের লীগে এমন খবরও দেখেছি দেশের খেলোয়াড়রা নিজের দলের বিদেশী খেলোয়াড়দের সাথে মাঠেই বাক-বিতন্ডায় জড়িয়েছেন। তাদের অভিযোগ বিদেশী খেলোয়াড়রা নাকি খালি নিজেদের মধ্যে পাস দেয়, দেশী খেলোয়াড়দের পাস দেয় না। এই যদি হয় খেলার অবস্থা তাহলে ফুটবল বাঁচবে কিভাবে!
এবার দেশের খেলোয়াড়দের প্রসঙ্গে আসি। ২০১১-১২ এর বি-লীগের প্রথম লেগের দশ ম্যাচ শেষে দেশের প্রধান দুই স্ট্রাইকারের গোলসংখ্যা ছিল চার এবং দুই! খেলোয়াড়দের খেলা দেখে কখনোই মনে হয়না যে তারা পুরো নব্বই মিনিট পর্যাপ্ত স্ট্যামিনা নিয়ে খেলার উপযুক্ত। বেশিরভাগ খেলোয়াড়দের ফিটনেসের অবস্থা ভালো না যার প্রতিফলন দেখা যায় অন্য দেশগুলোর সাথে খেলার সময়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের সাথে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের ফিটনেসের পার্থক্য পরিস্কার হয়ে ওঠে। নামে পেশাদার লিগ হলেও খেলোয়াড়দের মধ্যে পেশাদারিত্বের ছিটেফোটাও দেখা যায় না। দলের প্রতি কমিটমেন্ট, সার্বক্ষনিক ফুটবল চিন্তা, স্কিল ডেভেলপমেন্ট এগুলোর বড় অভাব। অনেক খেলোয়াড়ের জাতীয় দলের অনুশীলনে না এসে খ্যাপ খেলতে যাওয়ার নজিরও আছে। দেশের বয়সভিত্তিক ফুটবল কাঠামোর মানও তত উন্নত নয়। জেলাভিত্তিক ফুটবল হলেও দেশের বড় দলগুলোর তেমন কোন জুনিয়র ফুটবল টিম নেই বা জুনিয়রদের জন্য বড় দলগুলোকে নিয়ে কোন টুর্নামেন্ট নেই। দেশের ফুটবলের সবচেয়ে জনপ্রিয় দুই দল আবাহনী-মোহামেডানসহ সবগুলো দলের যদি অনূর্ধ্ব-১৬ বা অনূর্ধ্ব-১৯ দল থাকতো এবং এই দলগুলোর মধ্যে নিয়মিত খেলা হত, তাহলে ছোটবেলা থেকেই খেলোয়ারদের মধ্যে স্কিল ডেভেলপমেন্ট, চাপ নেওয়ার ক্ষমতা, কমিটমেন্ট, পেশাদারিত্ব ইত্যাদি তৈরী হত যেটা ইংল্যান্ড, স্পেন বা ইতালির বড় বড় দলগুলোতে দেখা যায়। তাছাড়া ক্লাবগুলোরও একটা ভালো খেলোয়াড় পাইপলাইন থাকতো যা তাদের মূল দল গঠনে বড় ভূমিকা রাখতে পারতো। সেক্ষেত্রে সস্তামানের বিদেশী খেলোয়াড়দের উপর নির্ভরশীলতাও দূর হত।
আরেকটা বিষয়ের দিকে নজর দেই যেটা থেকে বাফুফে কিছুতেই দায়মুক্ত হতে পারে না। তা হল জাতীয় দলের জন্য একজন ভালো ও দীর্ঘমেয়াদী কোচের ব্যবস্থা করা। শেষ কবে একজন সফল কোচ মেয়াদ শেষ করে বিদায় নিয়েছেন তা বোধহয় বাফুফের কর্মকতারাও বলতে পারবেন না। প্রতিবারই দেখা যায় নিয়োগ দেওয়ার পর বাবুফের কোচ পছন্দ হয় না অথবা কোচের ফেডারেশনের সাথে বনিবনা হয় না। ফেডারেশন কোচের চাহিদা অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে না এই অভিযোগ অনেক পুরোনো। কিন্তু বছরের পর বছর কোচ ধরে রাখতে না পারার ব্যর্থতা অবশ্যই বাফুফের। নিয়োগের পর যদি কোচ পছন্দ না হয় তো সেটা নিয়োগের আগেই ভালোমত খোজখবর করে দেখা উচিৎ। যেই দলের একজন কোচ নেই যে বছরখানেক ধরে দেশের ফুটবলকে কাছ থেকে দেখেছে, সেই দলের খেলোয়াড়দের থেকে ভালো কিছু আশা করা বোকামি। একটা ফুটবল ফেডারেশন যদি দেশের জাতীয় দলের জন্য একটা ভালো কোচের ব্যবস্থা করতে না পারে তো সেই ফেডারেশন পারেটা কি! দেশের জাতীয় দলের কোচ নেই আর ওদিকে আমি আর্জেন্টিনা-ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড নিয়ে আসলাম, এমনই যদি অবস্থা হয় তো ফেডারেশনের লোকদের চিন্তা-ভাবনার গভীরতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে।
এতোকিছুর পরও কিন্তু দেশের মানুষ ফুটবল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় না। এখনো মাঠে যদি আবাহনী মোহামেডানের কোন শিরোপা নির্ধারনী খেলা হয়, স্টেডিয়াম কানায় কানায় ভরে যায়। স্টেডিয়ামের বাইরে দশগুন দামে কালোবাজারে টিকেট বিক্রি হয়। তাও কিন্তু মানুষ টিকেট কিনে খেলা দেখতে আসে। তিন বছর আগে সাফ ফুটবলে বাংলাদেশ যখন সেমিফাইনালে ভারতের সাথে খেলবে, আমি নিজে দেখেছি মানুষ পঞ্চাশ টাকার টিকেট চারশ টাকায় কিনে মাঠে ঢুকছে। দেশের প্রধান দুটি সমর্থনপুষ্ট দল আবাহনী-মোহামেডান যদি ভালো দল গঠন না করে, পরস্পরের প্রতিদ্বন্দীতায় আসতে না পারে তাহলে কিন্তু দর্শক গ্যালারি ভরবে না। দেশের ফুটবল উন্নয়নে বাফুফের যেমন উদ্যোগী হতে হবে, তেমনি ক্লাবগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। অথচ দুঃখের বিষয় দেশের ক্লাবগুলোর তেমন কোন ভালো আবাসন ব্যবস্থা নেই। এমনকি মোহামেডানের মত দলের নিজস্ব কোন মাঠও নেই। এই ব্যাপারগুলোতে ক্লাবগুলোর আরো যত্নবান হওয়া উচিৎ। দেশের ফুটবলের মান্নোয়নে নিচের পদক্ষেপগুলো, যা মোটামুটি সবাই জানে, বাফুফে ও ক্লাবগুলোর যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করা উচিৎঃ
১। ঘরোয়া ফুটবলে পেশাদারিত্ব বাড়ানো।
২। ফুটবলের জন্য সারা দেশের মধ্যে অন্তত তিনটি মাঠের ব্যবস্থা রাখা যেখানে মারাত্মক প্রাকৃতিক দূর্যোগ ছাড়া (অথবা রাজনৈতিক!) খেলা বন্ধ হবে না।
৩। ঘরোয়া ফুটবলের ক্যালেন্ডার বাস্তবায়ন করা এবং টুর্নামেন্টগুলো আরো আকর্ষনীয় ও প্রতিযোগিতামূলক করা।
৪। জাতীয় দলের জন্য ভালো ও দীর্ঘমেয়াদী কোচের ব্যবস্থা করা।
৫। বয়সভিত্তিক ফুটবল টুর্নামেন্ট বাড়ানো।
৬। সারাদেশে পর্যাপ্ত ফুটবল একাডেমী তৈরী করা যা যেকোন ফুটবলারের স্কিল ডেভেলপমেন্টে ভূমিকা রাখতে পারে।
৭। পেশাদার লীগের বড় দলগুলোর বয়সভিত্তিক দলগঠন বাধ্যতামূলক করা এবং ওই দলগুলোর মধ্যে নিয়মিত খেলার ব্যবস্থা করা।
৮। খেলোয়াড়দের ফিটনেস ও ইনজুরিকালীন সুবিধা বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া।
৯। ক্লাবগুলোর নিজস্ব মাঠ ও আবাসন সুবিধা বৃদ্ধি করা।
১০। ক্লাবগুলোর বিদেশি খেলোয়াড় নিয়োগে আরো যত্নবান হওয়া।
১১। জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে পেশাদারী মনোভাব চালু করা।
১২। সর্বোপরি পাতানো খেলা রোধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া।
আমার বিশ্বাস দেশের ফুটবল নিয়ে মানুষ এখনো স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দেয়নি। তা না হলে ভালো কোন খেলায় এখনো কেন উপচে পড়া ভিড় হবে। বল যখন দেশের ছেলেদের পায়ে আসে তখন পেছন থেকে বলতে শুনি, “বল এবার লাল জামা চিন্সে ভাই, নইড়্যা বসেন!”। আমি জানি অনেকে এখনো আশা রাখে আমরা অন্তত দক্ষিন এশিয়ার সেরা দল হবো, এশীয়ার সেরা দলগুলোর সাথে সমানে সমানে লড়াই করব। বিশ্বকাপের বাছাই পর্ব দশ বছরের মধ্যে পেরোতে না পারি, অন্তত প্রতি বছর একটা লক্ষ্য নিয়ে প্রতিযোগীতায় নামব, যে লক্ষ্য হবে আগের বছরের চেয়ে বেশি কিছু। আর আমরা দেশের পতাকা নিয়ে খেলা দেখতে যাবো, বাড়ি ফেরার সময় মুখে হাসি থাকুক বা চোখে অস্রু থাকুক, মনটা অন্তত দেশের ফুটবলাররা জিতে নেবে।

Post a Comment