সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ল্যাখা সবাই নিশ্চয়ই কিছু না কিছু পড়ছেন? ভদ্রলোক থান ইটের সমান কিছু উপন্যাস ল্যাখলেও মূলত কবি মানুষ। প্রেমপত্র ল্যাখতে যাইয়া নাকি গদ্যের হাত পাকছে। হাউস মাস্টর ছিলেন, পরে আম্রিকা ঘুইরা ওস্তাদী ল্যাখকের তকমা পাইয়া এখন ফুলটাইম ল্যাখক। ‘দেশ’ পত্রিকার সবচেয়া জাঁহাবাজ রাইটারদের অন্যতম।
সুনীল ক্যামনে শুরু? ঐ পর্থমে নীরা সিরিজের কোব্তে, তার্পরে কেউ কথা রাখেনি, যদি নির্বাসন দাও, নিখিলেশ ইত্যাদি
ইত্যাদি। তার্পরে চটি সাইজের বই গুলা, আর ইট্টু লায়েক হওয়ার পরে থান ইটা সাইজ, মানে সেই সময়, প্রথম আলো আর পূর্ব-পশ্চিম। আইজকা প্রথম আলো নিয়া ইট্টু গ্যাঁজানোর খায়েশ রাখি। তয় আগেই কইয়া দেই, সকলের ভালা লাগবো না।সুনীলরে ভালা পাইতাম, কারণ হ্যায় বাঙাল(আম্মো বাঙাল, হ্যায়ও বাঙাল। স্বজনপ্রীতি মাইন্যা নিয়াও আমি নির্লজ্জ! হে হে) এইবার ঈদে অনেক দিন পরে বাড়ির ধুলামাখা বুকশেলফ থেইক্যা প্রথম আলো বই দুইডা আবার নামাইলাম। ‘সেই সময়’ এ যদি তিনি বাঙালি রেনেঁসা নিয়া ল্যাখেন তো ‘প্রথম আলো’ হইতেছে বাঙালির সমাজ সচেতনতা তথা রাজনৈতিক সচেতনতা তথা গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব(হ, হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতারে সুগারকোটিং করলে যা হয় আর কি!) এর ঔপন্যাসিক বয়ান। শেষ যখন পড়ছিলাম তখন কলেজে পড়ি, রুমান্টিক মনন, আবেগী, দ্যাশপ্রেম দ্যাখলেই ভালা লাগে। কাজেই ভরত, ভূমিসুতা আর রবিবাবুরে পাংখা লাগছিল। অনেকদিন পর আবার পড়ার সময় নিজেই অবাক হয়া দেখলাম যে মিজাজ বিলা হয়া যাইতেছে, তাও বিস্ময়ের সাথে পড়তে পড়তে দুইখণ্ড শ্যাষ কইর্যা রাগে ছুঁইড়াই ফালাইয়া দিলাম।
ক্যান?
ওয়েল, তাইলে তো অনেককথাই কওয়া লাগে। কিকি প্রসংগ আইছে বইদুইডায়? ত্রিপুরার রাজাগো বিলাস আর কামড়া-কামড়ি ও অকাতরে বাংলাসাহিত্যের জন্য পয়সাদান। রবীন্দ্রনাথ; তার জীবন; ভাবী আর ভাস্তির লগে প্লেটোনিক প্রেম(প্রেম বলে প্লেটোনিক! হাহ!); তার রাজনৈতিক, জমিদারী আর সমাজতাত্ত্বিক কর্মকাণ্ড। ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার আর তার বিজ্ঞান সাধনা। জগদীশ চন্দ্র বসু আর তার কাজ। প্রভু(!) শ্রীরামকৃষ্ণ। স্বামী বিবেকানন্দ। ভগিনী নিবেদিতা ওরফে মার্গারেট নোবল আর তাগোরে হিন্দু তাবলিগী কাজকাম। জাপানী বিপ্লবী ওকাকুরার ব্যর্থ মিশন। বিপ্লবী শ্রী অরবিন্দ ও তাদের স্বাধীনতা লাভের কার্যক্রমের সূচনা। বাল গঙ্গাধর তিলক এবং তার শিবাজী উৎসব(হিন্দু-মুসলিম প্রকাশ্য বিভেদের প্রথম সূচনাকারী)। গিরিশচন্দ্র আর তার থিয়েটার। আরো কিছু থাকতে পারে তয় গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় নাই আমার কাছে।
বইদুইডার টাইমফ্রেম হইলো কিশোর রবীন্দ্রনাথ থেইক্যা বঙ্গভঙ্গের সূচনা পর্যন্ত। মানে ১৮৭০-৭৫ থেইক্যা ১৯০৫-১৯০৬ পর্যন্ত। জিনিসডা খুবই ইন্টারেস্টিং। কারণ ঠিক শুরুর কয়েক বছর আগে ঘইটা গেছে প্রলয়ঙ্করী নীলবিদ্রোহ আর ফরায়েজী আন্দোলন। ‘সেই সময়’ উপন্যাসে নীলবিদ্রোহ নিয়া হালকা গ্যাঁজাইলেও এইহানে কবি বড্ড নিরব। কারণ কি? রবীন্দ্রনাথের বাপ জমিদার হিসাবে নীলবিদ্রোহের বিপক্ষে ছিলেন কিংবা নেহায়েতই বাঙাল চাষাভুষাদের কাম-কাজ বইলা? ফরায়েজী আন্দোলন কি সোশ্যাল রিফর্মেশন ছিলো না? নাকি এইডাও বাঙাল চাষাভুষা, (তাও আবার মুসলমান!) বইল্যা অপাঙতেয়? টাইমফ্রেমের শ্যাষটাও ইন্টারেস্টিং! বঙ্গভঙ্গের আইনপাশ আর তা নিয়া গণমানুষের বিক্ষোভ! বাঙালি নাকি জাগতাছে! হে হে।
বঙ্গভংগের কারণ হিসাবে উনি সেই ত্যানাপ্যাচানি ইংরেজ ষড়যন্ত্র আনছেন। পুরাডাই যে লর্ড কার্জনের একার গোয়ার্তুমি তা দ্যাহানোর জন্য কার্জনের চৌদ্দগুষ্টি ঘাটছেন(আরো নাকি লেখার ইচ্ছা ছিলো! বাঁইচ্চা গেছি!)। আবার এইডাও চাইপা যাইতে পারেন নাই যে কার্জনের আর সব কামের বেশিরভাগই সাধারণ মাইনসের উপকারেই লাগছে। তাইলে বংগভংগ কি সেরেফ ইংরেজ প্রভুদের খামখেয়ালী?
এইহানেই মজা! কোলকাতার জমিদার প্রভুদের রঙিন চশমায়(হাজার বাঙাল হইলেও) দ্যাখলে এইডারে ইংরেজ প্রভুদের খামখেয়ালীই মনে অইবো। তৎকালীন পূর্ববঙ্গ ছিলো নেহায়েতই একডা জমিদারী। বিভিন্ন জমিদার থাকবেন কলকাতায়। মাঝে মাঝে আইসা খাজনা-ফাজনা নিয়া যাইবেন। প্রজাদের জন্য যতডা তার চেয়া ইংরেজ প্রভুদের কাছ থেইক্যা খানবাহাদুর-খানবাহাদুরনী টাইটেল পাওনের লাইগ্যা কিছু ইস্কুল-টিস্কুল আর হাসপাতাল বানাইয়া দিবেন। নিচু বাঙালদের আরও কিছু যে লাগতে পারে এইডা তারা আর না ভাবলেও লর্ড কার্জনের মতো চিকনা বুদ্ধির লোক ঠিকই বুঝছিলেন(কারণ তিনি দ্যাখছেন, এই বাঙালগুলা খালি কথাই কয়না, খেপলে প্রয়োজনে লাঠিও ধরে; কাজেই বেশিদিন এইরম একচেটিয়া শোষণ করতে থাকলে বিস্ফোরিত হইতে টাইম লাগবো না।) কাজেই তিনি পূর্ববঙ্গ আর আসাম নিয়া আরেকটা প্রদেশ বানাইলেন। পূর্ববঙ্গ বাসীও খোশ! নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হইবো, নতুন কলকারখানা হইবো। কষ্ট কইরা কলকাতা যাইয়া ‘সভ্য’ হওয়া লাগবো না। দ্যাশের কুটিরশিল্পের জন্য ভালা দাম পাওয়া যাইবো। মধ্যস্বত্ত্বভোগী কমার কারণে ফসলের দামও ইট্টু বেশি পাইবো। আর ‘বাঙাল’ রিলেটেড রেসিজম(হ, সুগারকোটিং না কইর্যাই কইলাম!) থেইক্যাও কিছুডা রেহাই পাওয়া যাইবো।
কিন্তু তাইলে আমাগো কলকাতার জমিদার সমাজের কি হবে? তাদের কলকারখানাও তো লাটে উঠবে? কাজেই শুরু হলো তুমুল বিক্ষোভ। অত্যন্ত লক্ষণীয় ভাবে এর পেছনে দায়ী গোষ্ঠি হিসাবে চিহ্নিত করা হইলো ইংরেজ এবং মুসলিম দের।(হ, সুগারকোটিং না কইরা কইলে কওয়া যায়, এই কোলকাতা কেন্দ্রিক ‘বাঙাল’ বিদ্বেষের
পিছনে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার ব্যাপক ভূমিকা আছে।) ফকির-সন্যাসী বিদ্রোহ, নীল-বিদ্রোহ, ফরায়েজী মুভমেন্ট(যেইহানে স্বাধীন একডা অঞ্চল প্রতীষ্ঠা করছিলো বাঙালরা) এইসবগুলা ‘বাঙাল’ পরিচালিত মুভমেন্টে যেইহানে হিন্দু-মুসলিম ফারাকের কুনো নামগন্ধও আছিলো না, সেইহানে সুকৌশলে ঘটি-বাঙালদের মইদ্যে এইডা ঢুকায়া দিলো তারা। ফলাফল?
তীব্র মুসলিম বিদ্বেষী বঙ্কিমের উপন্যাসের আদলে এবং আদর্শে স্বাধীনতা মুভমেন্ট শুরু হয়া গেলো। ঢাকার উর্দু ভাষাভাষী নবাবরা এই সুযোগে আপামর বাঙাল মুসলমানগো মগজ ধোলাই কইরা মুসলীম লীগের বিশাল ঘাঁটি বানাইয়া ফেলাইলো(বাঙাল পীর-মুর্শিদী-মুসলমান সুফী-সহজীয়া-আর বাউল ঘরানার শান্তিবাদী মুসলমান আর এইসব সুন্নী এবং লম্পটিয়া ইম্পেরিয়ালিস্টিক নবাবদের ইসলামরে গোলাইয়া ফেলিলে ভুল হইবেক!)। কোনোকালেও যেইহানে বাঙালদের দ্যাখতে আহে নাই, সেইহানে উত্তর ভারতের ফর্সা ‘খাঁটি’ মুসলমানদের আনাগোনা বাইড়া গেলো। এবং তার সর্বশেষ ফলাফল হইলো হিন্দু-মুসলমানরা নিজেগো মইদ্যে ব্যাপক মারামারি-কাটাকাটি কইরা ভারত স্বাধীন কইর্যা ছিনায়া নিলো ইংরেজদের কাছ থেইক্যা(বিশ্বের আর কোনো কলোনী এইরম সার্কাসের মাধ্যমে স্বাধীন হইছে বইলা আমার জানা নাই।)
১৯০৫ হইলো ঠিক এইসব বিষবৃক্ষের রক্তবীজ! যার প্রথম চারা গজায় ১৯১১ সালে।
কিন্তু কবি এই পুরা ইতিহাসের চাক্কা ঘুরাইয়া দ্যাওয়া ১৯০৫-১৯১১ নিয়া এক্কেরে নিরব! ‘তাতে নাকি ইতিহাসের কচকচি বড্ড বেশি হয়ে যেত!’(ল্যাহকের নিজের ভাষায়?) নাকি নিজেগোরে জমিদারী মনোভাব বাইর অইয়া যাইতো?? তহন ভারত ছিলো স্রেফ এট্টা কলোনী। তার প্রদেশ দুডা হইলেই কি আর দশডা হইলেই কি? প্রশাসনিক কাজের বাইরে কি এমন গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য বহন করে তা? এহন দিনাজপুর ভাইঙ্গা যদি বিরামপুর, ফুলবাড়ি, হিলি নিয়া আরেকডা বিরামপুর জেলা হয় তাইলে চেতনের কারণ কি? কারণডা সৈয়দ মুজতবা আলী বইলা গেছেন। ‘ভারতের আর সব প্রদেশ হইলো স্রেফ প্রদেশ। আর বাংলা হইলো দেশ। কালচার, মানুষ সব মিলায়া পূর্ণাঙ্গ একটা দেশ। কাজেই তার আমলে যহন কোনো বাঙালি পরিচয় দিতো বাইরে, তহন পয়লাই কইতো আমি বাঙালি’। আমি খালি তার লগে আরেট্টু এড করি। সেই দেশের ভিত্রে আরেকডা ছদ্ম উপনিবেশ ছিলো আমাগো এই বর্তমান বাংলাদেশ। যার হাতছাড়ার ভয় থেইক্যাই ১৯০৫ এর আন্দুলন এবং যার থেইক্যাই হিন্দু-মুসলিম ক্যাচালের পরথম প্রাতিষ্ঠানিক শুরু। যার কারণ পুরাডাই অর্থনৈতিক, কুনোভাবেই ধর্মীয় না।
আইচ্ছা বঙ্গভংগ বাদ। তাইলে আর কি কি রাজনৈতিক ব্যাপার থাকে ঐ বইয়ে। অত্যন্ত হাসির কথা! আর খালি আছে স্বদেশী আন্দোলন এর শুরু নাম দিয়া হাস্যকর কিছু চ্যাপ্টার, মারাঠীদের চ্যাপেকর ভাইদের কাম যেইগুলা প্রত্যেকডাই ইফেক্ট। কজ নিয়া কুনো বাতচিত নাই।
আর আছে বাংলা থিয়েটারে আলাপ। জগদীশের বিজ্ঞান সাধনা এবং অত্যন্ত বিচিত্র কারণে রামকৃষ্ণ আর স্বামী বিবেকানন্দ নিয়া কচকচি। ক্যান রে ভাই! সাদা চামড়ারা কিছু কল্কে দিছিলো বইল্যা এইরম এবসার্ড একটা বিষয় নিয়া এত্ত পাতা খরচ করা লাগবো? ভারতের কালচারাল বা পলিটিকাল উত্তরণে কি কামে আইছে এই হাস্যকর অবতারতাত্ত্বিক কাজকাম?
আমার বিচারে বইদুইডা হইলো ‘কোলকাতার বাবু সমাজের চোখে কীভাবে শুধু কোলকাতা দিয়েই পুরা বাংলার কার্যক্রম চালানো যায় এবং কোলকাতার সেই সময়ের বাবুয়ানা’। পূর্ববাংলা তো দূরের কথা, মালদহ, মুর্শিদাবাদও এই বইয়ে নাই। যারা ১৮৭০-১৯০৫ এর কোলকাতার বয়ান পড়তে চান তারা পড়তারেন, কিন্তু যদি দাবী করা হয় এই বই সেই সময়ের ইতিহাস নিয়ে ফিরে দ্যাখা টাইপ তাইলে তা কুনোভাবেই সঠিক হইবোনা। তাই আমাগো মানে বাঙালগো ইতিহাস আমাদের চোখে আবার বয়ান করাডা খুবই জরুরী হয়া গেছে।
সাধে কী আর আহমদ ছফা আনন্দবাজার গোষ্ঠীর উপ্রে এত্ত বিলা আছিলেন!
http://www.somewhereinblog.net/blog/infamous_bd/29242650
About these a
Post a Comment